কঙ্কাবতী প্রমোদের বাড়ি গিয়ে হতাশ ! প্রমোদের বাড়িতে আদর-আপ্যায়ন দূরে থাক তার বাবা-মায়ের ব্যবহারে মর্মাহত । প্রমোদের বাবার অমানবিক ব্যবহারে উদ্বিগ্ন ! হতাশ হয়ে অনিন্দ কঙ্কাবতীকে বলল, “এখানে অনীশার বিয়ে দেওয়া চাপ হয়ে দাঁড়াবে ।“
অনিন্দকে আশ্বস্ত করে কঙ্কাবতী বলল,”ধীরে, আগেভাগে নেতিবাচক মন্তব্য করো না । আজকের ঘটনাটা নিয়ে প্রমোদের সঙ্গে আলাদা বসে আলোচনা করলে জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে যাবে ।“
কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে মাকে ঘোতন বলল, “আমাদের জাতি ও আমাদের পরিবার সম্বন্ধে তাঁরা অনেক আগেই অবগত । তা সত্ত্বেও কেন বিশ্রিভাবে প্রমোদের বাবা বললেন, আপনাদের সম্প্রদায়ে আমরা আত্মীয়তা করতে পারব না । তা ছাড়া তিনি আরও বললেন, আমাদের পরিবার নাকি তাঁদের অপছন্দ ? এইসব কথা বলার পেছনে তাঁদের কী অভিপ্রায়, বোঝা গেলো না ।“
“প্রমোদ বাড়িতে অনীশার সঙ্গে তার ভাব-ভালবাসার বিষয়টি ভালভাবে বোঝাতে পারেনি । অথবা অনীশাকে ভালবাসে, একথাটাও বাড়িতে জানায়নি । ফলে বাড়ির লোকজন ভাবছেন, পাঁচটা পরিবার যেমন মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ছেলের বাড়ি হাজির হন তেমনি আমরাও আমাদের মেয়ে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে প্রস্তাব নিয়ে তাঁদের বাড়ি হাজির হয়েছি । যার জন্য প্রমোদের বাবা ঘুণাক্ষরেও মেয়ের সম্বন্ধে ইতি বৃত্তান্ত জানতে চাইলেন না । জাত-পাতের ইস্যু তুলে আমাদের বিদায় দিলেন ।“ এই কথাগুলি ছেলের প্রশ্নের উত্তরে বলেই কঙ্কাবতী আবার বলল, “প্রমোদকে এবার দায়িত্ব নিতে হবে তার বাবা-মাকে বোঝানোর । তাহলে তাঁরা আর তাঁদের ছেলের বিয়ে আমাদের অনীশার সাথে বিয়ে দিতে গররাজি হবেন না । আমরা এখানে এসেছি অনীশার কথার উপর নির্ভর করে । আমরা কিন্তু প্রমোদের সাথে কোনোরকম আলাপ আলোচনা করিনি । সুতরাং এবার ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে পরবর্তী সিদ্ধান্তে আসতে হবে ।“
কঙ্কাবতী সবাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো ।
উন্মুখ হয়ে বসেছিলো অনীশা । বাবা-মায়ের ফ্যাকাশে মুখ দেখে অনীশা কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পেলো না । তাই সে আগ বাড়িয়ে কিছু জানতেও চাইলো না । বরং কঙ্কাবতী অনীশার কাছে এসে বলল, “তুই একটু প্রমোদকে খবর দে, সে যেনো সত্বর আমাদের সাথে দেখা করে ।“ আর একটা কথা, “প্রমোদের বাড়ি গিয়ে আমরা ভাল খবর আনতে পারিনি ।“
“কী হয়েছে, আমাকে একটু খুলে বলবে ?” মাকে জোর দিলো অনীশা ।
প্রমোদের বাবা আমাদের পরিবারের সঙ্গে তাঁর ছেলের বিয়ে দিতে অনিচ্ছুক !
অনীশা জানতে চাইলো, “কেন অনিচ্ছুক, সেই ব্যাপারে কিছু কী বলেছে ?”
সেসব কিছু বলেননি । শুধুমাত্র তিনি এই মুহূর্তে তাঁর ছেলের বিয়ে আমাদের পরিবারের সাথে দিতে রাজি নন । তাঁর এইটুকু ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন ।
অনীশা আর কথা বাড়ালো না । সে বুঝতে পারলো, কোথাও একটা ভুল বোঝবুঝির শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে । সেটা শোধরানোর জন্য সম্ভবত মা প্রমোদকে ডেকে পাঠালো ।
*****************************
প্রমোদকে ডেকে তার বাবা-মা জানিয়ে দিয়েছেন, চড়ুইডাঙ্গার অনিন্দবাবুর মেয়েকে তাঁরা পুত্রবধূ করে ঘরে তুলতে নারাজ । প্রমোদ অনেক বুঝিয়েছে, কিন্তু তার বাবা-মা কোনো যুক্তি মানতে রাজি নন । ফলে অনীশার সাথে বিয়ের জন্য বাড়ির অনুমতি পাওয়ার ব্যাপারে প্রমোদ প্রচণ্ড হতাশ !
অনীশার পাঠানো খবর পেয়ে প্রমোদ সশরীরে দোকানে হাজির ।
“তোমার বাবা নাকি আমাদের বিয়ে মানতে নারাজ ? কথাটা কী সত্যি ?” অনীশা প্রমোদের কাছে জানতে চাইলো ।
প্রমোদ চুপ করে থাকলো ।
ঠিক সেই সময় অনীশার চায়ের দোকানে কঙ্কাবতী উপস্থিত । প্রমোদকে দেখতে পেয়ে কঙ্কাবতী বলল, “ আমি তোমাকে খোঁজ করছিলাম ?”
কাঁচুমাচু হয়ে প্রমোদ কঙ্কাবতীকে বলল, “ঐদিন আপনাদের প্রতি বাবা-মায়ের ব্যবহারে আমি লজ্জিত । আমি বাবা-মায়ের হয়ে আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ।
“ব্যাপারটা ক্ষমার প্রশ্ন নয় । প্রশ্ন হচ্ছে “তুমি অনীশাকে ভালবাসো” এই কথাটা বাড়িতে বুঝিয়ে বলতে পারোনি । এটা তোমার একধরনের গাফিলতি । বাবা-মাকে আগেভাগে বোঝানো থাকলে তোমার বাবা-মা নিশ্চয় ভাল ব্যবহার করতেন । আমি তোমার বাবা-মায়ের ব্যবহারে এতটুকু বিভ্রান্ত হইনি । আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তুমি তোমার মা-বাবাকে তোমাদের দুইজনের ঘর বাঁধার স্বপ্নের কথা খুলে বোঝাতে পারোনি । তিনি একজন শিক্ষিত মানুষ । স্কুলের মাস্টার মশাই ছিলেন । তাঁর একটা নিজস্ব মতামত রয়েছে । তিনি গাঁয়ের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি । তাই তাঁর ছেলের বিয়ের ব্যাপারে অনেক স্বপ্ন থাকতে পারে । সুতরাং আমার অনুরোধ, তুমি আগে মা-বাবাকে বোঝাও । তারপর তোমাদের চার হাত এক-করার দায়িত্ব আমাদের !” কঙ্কাবতী প্রমোদের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “আমি কী তোমাকে বোঝাতে পারলাম ?”
মাথা নেড়ে তার সম্মতির কথা জানালো প্রমোদ ।
বাবার কাছে নিজের বিয়ের কথা বলতে গিয়ে এবার রীতিমতো ধমক খেলো প্রমোদ । তার বাবার সাফ জবাব, তিনি বেঁচে থাকতে বে-জাতের মেয়েকে কিছুতেই ঘরে তুলতে পারবেন না ।
প্রমোদের বাবা আগেকার ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী । ছেলে-মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে কোনোরকম আপসে যেতে রাজী নন । তাই প্রমোদের বাবা জাত-পাত দেখে পাত্রী নির্বাচন করার পক্ষপাতী । প্রমোদের কোনো যুক্তি তিনি মানলেন না ।
বাবার কড়া ভাষার কচকচানিতে প্রমোদের মনটা ভেঙ্গে চুড়মার । কয়েকদিন চুপচাপ ঘরে বসে কাটিয়ে দিলো । ভাবনার জগতে সে নিমজ্জিত, অতঃপর কী করণীয় ?
বন্ধুবান্ধবদের সাথে শলাপরামর্শ মোতাবেক প্রমোদ সিদ্ধান্ত নিলো, “সে বাবা-মায়ের অমতে অনীশাকে বিয়ে করবে !”
তারপর............?
তারপর হঠাৎ দোকান বন্ধ রেখে অনীশা প্রমোদের সঙ্গে উধাও । কেউ তাদের খোঁজখবর পাচ্ছে না । এমনকি প্রমোদের বাবা কঙ্কাবতীর বাড়ি গিয়ে ছেলের খোঁজ নিয়ে এসেছে । সেখানে তাকে দেখতে না পেয়ে কী করবেন, সেটাই ভাবছেন ! কঙ্কাবতীকেও তার মেয়ে অনীশা কিছুই বলে যায়নি । সবটাই তারা গোপন রেখেছে । যার জন্য কঙ্কাবতী নিজেও তার মেয়ের উধাও হওয়ার ব্যাপারে পুরোটাই অন্ধকারে । তবে কঙ্কাবতী এবার পরিষ্কার বুঝতে পারছে, প্রমোদ তার ভালবাসাকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত । এটা একটা ভাল লক্ষণ । এতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, প্রমোদ সত্যিই অনীশাকে ভালবাসে ।
চারিদিকে খোঁজাখুঁজি । ঘোতন কয়েকটি জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে বোনের কোনো হদিস পেলো না । সম্ভাব্য সব জায়গায় হানা দিয়ে ঘোতন হতাশ ! তার ধারণা, অনীশা ও প্রমোদ পালিয়ে লোকালয় থেকে অনেক দূরে চলে গেছে এবং সেই খবরটা উদ্ধার করাও খুব কঠিন !
প্রমোদের বাবা স্থানীয় পঞ্চায়েতে নালিশ জানালেন, তাঁর ছেলেকে নাকি কঙ্কাবতীর গুণ্ডা ছেলে ঘোতন গায়েব করে দিয়েছে । কোথায় আটকে রেখেছে সেই হদিস এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি । অথচ তার ছেলে প্রচণ্ড গোবেচারা । সে কোনো ঝুটঝামেলার মধ্যে থাকে না । শোনা যাচ্ছে, কঙ্কাবতীর মেয়ে অনীশাকেও পাওয়া যাচ্ছে না । সুতরাং ছক কষে কঙ্কাবতী ও তার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে প্রমোদকে গায়েব করে দিয়েছে । তিনদিন ধরে ছেলেটা নিখোঁজ । অথচ আজ পর্যন্ত জানা গেলো না, “ছেলেটি কোথায় লুকিয়ে রয়েছে ?”
পঞ্চায়েত প্রধান কড়জোড়ে প্রমোদের বাবাকে জানিয়ে দিলেন, দুজনেই অনেক বড় । নিজেরা নিশ্চয় যুক্তি করে পালিয়েছে । সুতরাং সেখানে পঞ্চায়েতের বা পুলিশের ভূমিকা নেই বললেই চলে । দেশের সুনাগরিক হিসাবে এবং অ্যাডাল্ট হিসাবে তাদের যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে আইনগত বাঁধা নেই । সেই সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধে হস্তক্ষেপ করা আইন-বিরোধী ।
তাহলে কী আমার ছেলেকে আর ফিরে পাবো না ?
“অবশ্যই ফিরে পাবেন । প্রয়োজনে দৈনিক খবরের কাগজে ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দিন ।“ এই কথাগুলি বলে পঞ্চায়েত প্রধান অতিরিক্ত আর একটি বাক্য ব্যয় করলেন না । বরং স্থান ত্যাগ করলেন ।
প্রমোদের বাবা থানা পর্যন্ত গেলেন । সেখানে একটা মিসিং ডায়েরী করলেন । কিন্তু সেখানেও ছেলে ফিরে পাওয়ার কোনো হদিস পেলেন না । কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র তিনি নন । অনেক ভেবেচিন্তে প্রমোদের বাবা জেলা প্রশাসনের স্মরণাপন্ন হলেন ।
এইদিকে প্রমোদ ও অনীশা সোজা রামপুরহাট । তারামায়ের মন্দিরে পুজো দিয়ে পুরোহিতকে প্রমোদ বলল, “ঠাকুর মশাই, আমি ও অনীশা একে অপরকে ভালবাসি এবং দুইজনে বিয়ে করতে চাই । আপনি আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করুন ।“
পুরোহিত মশাই বিয়ের সরঞ্জাম গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন । ঠিক সন্ধ্যা সাতটার সময় পুরোহিত মশাই বিয়ের পিঁড়িতে বর ও কনেকে ডাকলেন । অন্যদিকে তারামায়ের মন্দিরে সন্ধ্যা আরতি চলছে । ঐদিকে সান্ধ্যকালীন মায়ের পূজো এবং এইদিকে প্রমোদ ও অনীশার বিয়ে, দুটিই সমানতালে চলছে । প্রমোদের ও অনীশার বিয়ের সময় পুরোহিত ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি উপস্থিত নেই । হিতে বিপরীত হতে পারে ভেবে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে বিয়ের সময় উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি ।
হঠাৎ পুলিশ নিয়ে বিয়ের আসরে সরাসরি হাজির প্রমোদের বাবা । সঙ্গে প্রমোদের মা ও গাঁয়ের কয়েকজন গণ্যমান্য গ্রামবাসী ।
পুলিশকে উদ্দেশ্য করে প্রমোদের বাবা বললেন, “দেখুন স্যার । নিজের চোখে দেখুন । আমার ছেলেটাকে তুলে এনে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে । আপনি এর একটা বিহিত করুন । মেয়েটার ছোট ভাই এলাকার নামকরা মস্তান । তার অঙ্গুলি হেলনে আমার ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে ।“
পুরোহিতকে পুলিশ বললেন, “এই বিয়ে বন্ধ করুন ।“
বেঁকে বসলো প্রমোদ । তাই প্রমোদ পুরোহিতকে বলল, “আপনি বিয়ের পর্ব চালিয়ে যান । আপনি বিয়ের কাজে থামবেন না ।“
আবার পুলিশ পুরোহিতকে বললেন, “আপনি বিয়ে বন্ধ করুন ।“
পুরোহিত ঠাণ্ডা মাথায় পুলিশ বললেন, “স্যার, আমি বরের নির্দেশ মতো কাজ করছি । যা বলার বিয়ে যিনি করছেন সেই বরকে বলুন ।“
পুলিশ প্রমোদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রমোদবাবু, আপনার বাবা আমাদের কাছে লিখিত নালিশ জানিয়েছেন আপনার নাকি আপনার অমতে বিয়ে হচ্ছে । এটা কী সঠিক ?”
“একদম বেঠিক । আমরা অ্যাডাল্ট । দুজনের পূর্ণ সম্মতিক্রমে এই বিয়ে হচ্ছে । সুতরাং বাবার লিখিত নালিশ এইক্ষেত্রে খাটবে না ।“ বলেই পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে বিয়ের মন্ত্র বলতে শুরু করলো প্রমোদ ।
পুলিশ প্রমোদের বাবার দিকে তাকিয়ে বললেল, “সরি, দুইজনের মতে যেহেতু বিয়েটা সংঘটিত হচ্ছে সেখানে আমাদের কিচ্ছু করার নেই ।“ তারপর পুলিশ যেকজন এসেছিলেন, জিপে উঠে ফিরে গেলেন ।
প্রমোদের বাবা রেগে ছেলেকে শুধুমাত্র মারতে বাকী । যাচ্ছেতাইভাবে গালিগালাজ করলেন । গ্রামের মানুষের সামনে রাগে গজগজ করতে করতে বললেন, “আজ থেকে প্রমোদ আমার ত্যাজ্যপুত্র । আমি তার মুখ দর্শন করতে চাই না ।“ বলেই সবাইকে নিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন ।
( চলবে )