কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (ধারাবাহিক উপন্যাস, চতুর্দশ পর্ব) : দিলীপ রায়।

0
397
     অবশেষে প্রমোদ পাকাপাকিভাবে অনীশার দোকানে এসে উঠলো । এছাড়া উপায় নেই । বাড়ি্তে প্রমোদ ত্যাজ্যপুত্র  । বাড়িতে ফিরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ । তাই অনীশার সাথে ব্যবসায় হাত লাগালো  প্রমোদ । দোকানটা আরও কীভাবে বড় করা যায় সেই ব্যাপারে দুজনের ধ্যান-জ্ঞান । কাজে তারা এখন অনেক বেশী চাঙা । বেঁচে থাকার পথ এখন দোকান থেকে আয়ের উপর । তা ছাড়া চায়ের দোকানের পাশাপাশি খাবারের রেস্টুরেন্টের উপর তারা জোর দিলো । ধীরে ধীরে স্টেশন চত্বরে দোকানটির কলেবর বৃদ্ধি পেলো । 
    বেশ কিছুদিন পর চায়ের দোকানের পাশাপাশি খাবারের দোকান চালু হয়ে গেলো  । অনেক টোটোওয়ালা, ভ্যান-ওয়ালা, অনীশার খাবারের দোকানের নিয়মিত খরিদ্দার । দুপুরে ডাল, ভাত, তরকারি, মাছের ঝোল দিয়ে হোটেল চালু । পেট পুরে খাওয়া, অথচ খরচাও খুব কম । যার জন্য অনীশার খাবারের দোকানে ক্রমশ ভিড় বাড়ছে  ।  রাতে রুটি তরকারি, ডিমের ওমলেট্‌ । ট্রেনের অনেক যাত্রী যাওয়া-আসার রাস্তায় অনীশার হোটেলে ঢুকছেন । খাবার খেয়ে  খরিদ্দারেরা  পরিতৃপ্ত । 
   স্টেশন এলাকায় একটিমাত্র খাবারের দোকান । রাস্তার পাশে হোটেল খোলার জন্য  হোটেলের প্রতি খরিদ্দারদের দৃষ্টি সর্বক্ষণ । অনীশা ও প্রমোদ দুজনে আলাদাভাবে হোটেলের কাজ ভাগ করে  নিলো । খাবারের দোকানের দায়িত্ব রইল প্রমোদের উপর । খরিদ্দারের চাহিদা অনুসারে বাজার করা এবং খাবারের  আয়োজন করা, প্রমোদের দায়িত্ব ।  খরিদ্দারদের রুচি অনুযায়ী হোটেলের খাবারের প্রস্তুতি । প্রমোদ সেই কাজটা খুব যত্ন সহকারে পালন করছে । যার জন্য হোটেলের সুনাম খুব তাড়াতাড়ি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল । অন্যদিকে অনীশার দায়িত্ব, চায়ের দোকান ঠিকমতো চালু রাখা । যদিও অনীশা দীর্ঘদিন ধরে চায়ের দোকান সামলাচ্ছে, সেই কারণে তার চায়ের দোকান ভীষণ ভাল চলছে ।  দোকানের আয় থেকে এখন  তাদের হাসিমুখে সংসার । 
      কঙ্কাবতী ঘোতনকে তাগাদা দিলো, অনীশাদের দো-তলায় শীঘ্র দোকান খুলতে । কিন্তু দোকান খোলা নিয়ে ঘোতনের ছিল ভীষণ আড়ষ্টতা  । এতদিন তার সারা শরীরে আলস্য ভর করে ছিল । মায়ের কথা শুনে তার  টনক নড়ল । ঘোতনের আন্তরিক উপলব্ধি, এবার তাকে দোকান খোলার উপর নজর দিতে হবে । তার  একটাই চিন্তা, দোকান খোলার পুঁজির সংস্থান ? 
    ঘোতনের ইচ্ছা ছিল, রেডিমেড গার্মেন্টসের দোকান খোলার  । কিন্তু মহাজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে যেটা বুঝেছে তাতে ব্যবসা শুরুর সময় বেশ কিছু নগদ টাকার দরকার ! নতুবা নতুন দোকানের ক্ষেত্রে মহাজনেরা বাকীতে কারবার করতে রাজি  নয় । প্রথমে নগদ টাকা দিয়ে মাল তুলতে হবে । তারপর কাজের হালহকিকৎ দেখে ধার-বাকীতে লেনদেন । সুতরাং দোকান খোলার প্রারম্ভে ঘোতনের মোটা টাকা দরকার । দোকান খুলতে গিয়ে ঘোতনের অভিজ্ঞতা মাকে সবিস্তারে জানালো । তাই কঙ্কাবতী নিজেও  শহরে কাপড়ের ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা করলো । তাঁদের সেই এক বক্তব্য, নতুন দোকানের ক্ষেত্রে বিনা পয়সায় মাল দিতে তাঁরা গররাজি ।
     মাকে হতাশ অবস্থায় দেখে ঘোতন তার মত বদলালো । পুঁজির অভাবে  রেডিমেড গার্মেন্টসের দোকান আর খুলতে চায় না ।  সে টেলারিং দোকান  খুলতে চায় । ইতিমধ্যে সে টেলারিংয়ের কাজ অনেকটাই শিখেছে । টেঁয়া স্টেশন বাজারে আলম ফকিরের টেলারিং দোকানে বসে কাপড় কাটা এবং সেলাইয়ের কাজ ঘোতনের  অনেকটাই রপ্ত  । আলম ফকির আন্তরিকতার সাথে ঘোতনকে কাজ শিখিয়েছে । এর পেছনে একটা কারণও রয়েছে  । একবার কিছু উটকো মস্তানদের  পাল্লায় পড়ে তার দোকান বন্ধ হওয়ার উপক্রম । জোরজুলুম করে পঞ্চাশ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জঘন্য ধান্দা ছিল ! উটকো মস্তানদের ষড়যন্ত্র টের পেয়ে উপযাজক হয়ে আলম ফকিরকে বাঁচাতে ঘোতন ষড়যন্ত্রকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ।  যার জন্য সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিল আলম ফকির । তার অনেকদিন পর যখন ঘোতন আলম ফকিরের কাছে কাজ শিখতে গেলো, তখন আলম ফকির সাদরে স্বাগত জানিয়ে ঘোতনকে কাজ শেখাবার প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হলো । আলম ফকির বলেছিল, “কাজটা শিখতে কিছুদিন সময় লাগবে । কিন্তু মনোযোগ দিয়ে কাজ শিখলে ভবিষ্যতে টেলারিং দোকান খুললে স্থায়ী আয়ের একটা বন্দোবস্ত হবে ।“ তাই ঘোতন এখন  ভাবছে,  সেই আলম  ফকিরের ভবিষ্যতবাণী ঘোতনের জীবনে ফলে গেলো । ঘোতন টেলারিং দোকান খুলতে চলেছে  ।
     ঘোতন ছুটলো আলম ফকিরের কাছে । কীভাবে দোকান খুলবে এবং টেলারিং দোকানে কী কী সামগ্রী লাগবে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ  বিবরণ লিখে আনলো  । সেই সময় আলম ফকির ঘোতনকে আরও বলল, “প্রয়োজনে সে সবরকম সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ।“ আলম ফকিরের আশ্বস্থতা পেয়ে ঘোতন যারপরনাই  আনন্দে উদ্বেলিত ।
      ইতিমধ্যে আলম ফকির একটি পুরানো সেলাই মেশিন ঘোতনকে দিয়েছে । ঊষা কোম্পানীর মেশিন । মেশিনটির অবস্থা এখনও অনেক ভাল । চালু মেশিন । ঘোতন ঠিক করলো, ঐ পুরানো মেশিন দিয়ে তার টেলারিং দোকান চালু করবে । তারপর স্থানীয় ব্যাঙ্কের স্মরণাপন্ন হবে । লোনের জন্য । লোন না নিলে দোকানটা সাজাতে পারবে না । ইতিমধ্যে ব্যাঙ্কের স্থানীয় শাখায় দেখা করে এসেছে । লোনের ব্যাপারে শাখা প্রবন্ধক যেভাবে পরামর্শ দিয়েছেন । সেদিকেই হাঁটছে ঘোতন ।
    কঙ্কাবতী চাইছে, ঘোতন শারীরিক কসরত করে নিজের পায়ে দাঁড়াক । 
    অনীশার রেস্টুরেন্টের উপরের তলায় দোকান ঘর সাজালো ঘোতন । খুব সাধারণভাবে দোকান ঘর সাজিয়ে তুললো । পুরানো একটি সেলাই মেশিন । তার সাথে কিছু সরঞ্জাম যেমন মাপ করার ফিতে ও স্কেল, কাপড় কাটার কাঁচি, বিভিন্ন রঙের সুতো, ইত্যাদি । স্টেশনে যাওয়ার পথে দোকান হওয়ায় সুবাদে কিছুদিনের মধ্যে ঘোতনের টেলারিং দোকান মানুষের  নজরে পড়লো । দোকানে ক্রমশ ভিড় বাড়ছে । ছেঁড়া ফাটা কাপড় যেমন সেলাইয়ের জন্য তেমনি নতুন শার্ট, প্যান্ট, পায়জামা,  ব্লাউজ, সায়া, ইত্যাদি তৈরীর জন্য খরিদ্দারদের ভিড় বাড়ছে  । তবে ডোরাকাটা চেক লুঙ্গির সেলাই  প্রতিদিন থাকছে । লুঙ্গি অর্থাৎ দুই মুখ জোড়া লাগানো কাপড় যাকে বলে কাছা-কোঁচাহীন ধুতি পরনের চল এলাকায় বেশী । যার জন্য প্রতিদিন বেশ কয়েকটি  লুঙ্গি সেলাইয়ের কাজ থাকে । 
     কাজের প্রতি ঘোতনের খুব মনোযোগ । ব্যবসায় সে দাঁড়াতে চায় । আশেপাশের ঝুটঝামেলা থেকে সে এখন অনেক দূরে । ঝুটঝামেলার কারণে মাঝে মাঝে ডাক এলে তাদের সরাসরি “না” করে দিচ্ছে  । তার একটাই বক্তব্য, তাকে তার  ভবিষ্যত জীবনের কথা ভাবতে হবে । নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে । সুতরাং কোনোরকম অপ্রীতিকর কাজে সে আর জড়াতে চায় না । ঘোতনের সংসার-প্রীতি অনেকের আবার  অপছন্দ, যার জন্য তারা মাঝে মাঝে ঘোতনকে উত্ত্যক্ত করে । কিন্তু ঘোতন তার নিজের সিদ্ধান্তে অটল । ফলে তার বিরূদ্ধে কিছু বন্ধু-বান্ধবের রোষ বাড়ছে । সেটা ঘোতন টের পেয়েও নির্বিকার ।  ঐসব উটকো ছেলেদের কীভাবে টাইট দিতে হয় সেই ঔষধ তার জানা । সেইজন্য উটকো ছেলেদের তড়পানিতে ডরায় না ঘোতন । তার মাথায় একটাই চিন্তা, ব্যবসা বাড়ানো ! 
       দেখতে দেখতে ঘোতনের এক বছর কেটে গেলো । কঙ্কাবতী ঘোতনকে তাগাদা দিচ্ছে বিয়ে করার জন্য । ঘোতনের এখন বিয়ের বয়স, বরং বলা চলে বিয়ের মোক্ষম সময় । তাই বিয়েতে ঘোতনকে রাজি করানো । কিন্তু ঘোতন এই মুহূর্তে বিয়ে করতে চাইছে না । সে দোকানটাকে আরও বাড়াতে চায় ! 
      ব্যাঙ্ক থেকে অল্প কিছু লোন পেলো ।  তাতে নতুন একটা মেশিন কিনলো  এবং প্যান্ট-শার্টের জন্য কাপড় কিনলো । দোকান ঘরটাও কাঠের আসবাব দিয়ে সাজালো । দোকান ঘরটা এমনভাবে সাজালো খরিদ্দারেরা দোকানে ঢুকে তাদের সন্তুষ্টি  প্রকাশ করে ঘোতনকে বলতে বাধ্য হল, “এতদিনে মনে হচ্ছে সত্যিকারের টেলারিং দোকানে ঢুকলাম ।“ খরিদ্দারদের কথাগুলি ঘোতনকে খুব তৃপ্তি দেয় । 
      প্যান্ট শার্ট কাটিং করতে গিয়ে কোনো সমস্যা হলে সোজা টেঁয়ার আলম ফকিরের দোকানে । তার কাছ থেকে ভাল করে বুঝে তারপর প্যান্টের বা শার্টের কাপড়ের কাটিং  ।                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                           এইভাবে ঘোতন নিজেকে সমৃদ্ধ করতে থাকলো । এর মধ্যে স্থানীয় এক ভদ্রলোক পর্দার কাপড় সেলাইয়ের অর্ডার দিলেন । সেই কাজ হাতছাড়া করলো না ঘোতন । রাত-দিন অতিরিক্ত খেটে সেই অর্ডার পালন করলো । এইভাবে তার টেলাইং   কাজের সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেলো ।
        ঘোতনের টেলারিং দোকান থেকে আয়ের পরিমান ক্রমশ বাড়ছে । সংসার চালাতে মাকে নিয়মিত টাকা দিচ্ছে ঘোতন । যদিও তার সব বোনেরা কিছু না কিছু কাজ করছে, ফলে তাদের জন্য ঘোতনের চিন্তা কম । তবে বোনদের বিভিন্ন আবদার কঙ্কাবতী মেটায় । ঘোতন ও অনীশা এক বিল্ডিংয়ে সুন্দর ও লাভজনকভাবে  ব্যবসা চালাচ্ছে ।  ভাই-বোনের ব্যবসা দেখে অনেকের মুখে এখন আলোচনার বিষয়, “কঙ্কাবতীর ছেলে-মেয়েগুলি ভীষণ কর্মঠ ।“ 
     ব্যাঙ্কের ম্যানেজারবাবু পোস্ট-স্যাঙ্ক (Post Sanction Inspection)  ইন্সপেকশনে এলেন । তিনি টেলারিং দোকান দেখে ভীষণ উৎফুল্ল । ঘোতনের কাজকর্মের বর্তমান অবস্থান ও ব্যবসার গতিধারা দেখে তিনি নিশ্চিত হলেন, “যোগ্য জায়গায় লোনটা দেওয়া হয়েছে ।“ মিষ্টি খেতে পীড়াপীড়ি করলো ঘোতন । তিনি কিছুই খেলেন না । কিন্তু টেলারিং থেকে  ব্যাঙ্কে ফিরে যাওয়ার আগে বললেন, “এক কাপ চা দাও বরং চা খেয়ে ওঠা যাক ।“ 
     চা খেয়ে বিদায় নিলেন ম্যানেজারবাবু । 

 চলবে