কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (ধারাবাহিক উপন্যাস, পঞ্চদশ পর্ব) : দিলীপ রায়।

0
522
     কয়েক মাস কেটে গেলো । ঘোতনের দোকান এখন অনেক চালু । দোকানের আয় থেকে পুঁজিও অনেক  বেড়েছে  ।  ঘোতন দোকানে খুব খাটছে । তার ইচ্ছা, ভাল ভাল ব্রান্ডের কাটা-কাপড় রাখা । যাতে তার টেলারিং ঢুকে একজন চাইলে, জামা-প্যান্টের কাপড় কিনে প্যান্ট-শার্ট বানাতে পারবেন । সেইজন্য ঘোতনের অতিরিক্ত খাটুনি । 
     অন্যদিকে কঙ্কাবতী ঘোতনকে অনবরত তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে বিয়ের জন্য । হরিবল্লভপুরের বনমালী ঘটক কঙ্কাবতীর পিছনে লেগে রয়েছে  । তাঁর হাতে নাকি তিনজন সুন্দরী পাত্রী রয়েছে । তাড়াতাড়ি যোগাযোগ না করলে তারাও  হাত-ছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা । বনমালীর তর সইছে না । তাঁর রোজ একবার করে তাগাদা দেওয়া চাই । তিনজন মেয়ের মধ্যে একজন মেয়ের বাবার নাম লাখহরি । তিনি সোমপাড়া বাজারের বড় ব্যবসায়ী । তিনি  ব্যবসায়ী পাত্র খোঁজ করছেন । বনমালীর কাছে ঘোতনের খবর পেয়ে তিনি উঠেপড়ে লেগেছেন ঘোতনকে জামাই করার জন্যে । লাখহরির মেয়ের বয়স বেশী । গায়ের রঙ চাপা ।  চাপা থাকার কারণে পাত্র ঠিকমতো জুটছিলো না । যার জন্য বয়স বেশী । লাখহরিবাবু  ভাবলেন, ঘোতনকে কিছু টাকা পয়সা দিলে তাঁর মেয়েকে বিয়ে করতে ঘোতন রাজি হয়ে যাবে । তা ছাড়া খোঁজ খবর নিয়ে লাখহরিবাবু জেনেছেন, দোকানটা বাড়াতে  ঘোতনের এখন অনেক টাকার দরকার ! সুতরাং এই সুযোগে ঘোতনকে টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে  বোঝাতে পারলে তাঁর মেয়ে বিয়ের একটা বিহিত হবে । নতুবা মেয়ের দিকে তাকালে তাঁর ভীষণ কষ্ট ! মেয়ের সমবয়সী মেয়েদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে । একমাত্র তাঁর মেয়ের বিয়ে বাকী । সেইজন্য মেয়েটা বিষণ্ণতায় ভুগছে  । 
    বনমালী কঙ্কাবতীর সাথে দেখা করে লাখহরির মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিলো । লাখহরিবাবুর নগদ টাকা যৌতুক দেওয়ার প্রস্তাবও, বনমালী কঙ্কাবতীকে জানালো  । কিন্তু কঙ্কাবতী বনমালীকে বুঝিয়ে বলল, “বিয়ে করবে ঘোতন । পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ছেলের মতামতকেই মা হিসাবে কঙ্কাবতী গুরুত্ব দেবে । তাতে লাখহরির মেয়েকে ঘোতন পছন্দ করলে কঙ্কাবতীর কোনো আপত্তি নেই ।  কঙ্কাবতীর নগদ টাকার  উপর কোনো লোভ নেই । সে গতরে খেটে উপার্জন করার পক্ষপাতী । তার মতে, পরিশ্রম করে স্বচ্ছতার সঙ্গে বেঁচে থাকার মধ্যে আনন্দ অপরিসীম ! 
       এদিকে ঘোতন বিয়ে করার ব্যাপারে বেঁকে বসলো । ঘোতন চাইছে, স্টেশন চত্বরে একটা বাড়ি বানাতে । হয় মিঁয়া স্টেশন কিংবা বাজারসৌ স্টেশনের আশেপাশে । কেননা তাদের চড়ুইডাঙা গ্রাম থেকে যাতায়াতের  খুব সমস্যা । ব্যবসা চালাতে গেলে স্টেশন চত্বরে বাড়ি হলে সবদিক দিয়ে মঙ্গল । চড়ুইডাঙ্গা গাঁয়ে যেমন বড় ভাই রয়েছে, সে সেখানে জমি জায়গা চাষবাস নিয়ে থাকুক । আর একটা বাড়ি স্টেশন চত্বরে হলে ভাল হয় । সেইজন্য ঘোতন বিয়ে নিয়ে একেবারেই ব্যস্ত নয় । 
       ইতিমধ্যে মিঁয়া স্টেশন লাগোয়া শক্তিপুর যাওয়ার রাস্তার পাশে পাঁচ কাঠা জমি ও বাড়ির খোঁজ পেয়েছে । বাড়িতে  দুখানি ঘর, রান্না ঘর, বাথ রুম ও একটি টিউবওয়েল রয়েছে ।  দামটা নিয়ে ঘোতনের একটু আপত্তি । তবে জায়গাটা ঘোতনের খুব মনে ধরেছে । স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে দশ মিনিট । আবার অন্যদিকে সাইকেলে কয়েক মিনিটের মধ্যে  শক্তিপুর বাজার । জায়গাটা যার, তিনি কর্ণসুবর্ণ স্টেশনের কাছে পাকাপাকিভাবে বাড়ি বানিয়ে  বসবাস করছেন । তিনি আর মিঁয়া ফিরতে চাইছেন না । তাঁর একমাত্র ছেলে সেখানকার হাইস্কুলের  মাস্টার । তাই জায়গাটা বিক্রি করে দেওয়া  তাঁদের উদ্দেশ্য ।
   কঙ্কাবতী জায়গার দাম শুনে চিন্তায় পড়ে গেলো । অতো টাকার জোগাড় কীভাবে হবে সেই চিন্তায় অস্থির । অথচ ঘোতন জায়গাটা কিনতে মরিয়া । 
     বোনেরা ঘোতনের পাশে এসে  দাঁড়ালো  । জমি ও বাড়িটা কেনার ব্যাপারে চার বোন সর্বতোভাবে দাদাকে সহায়তা করলো ।  তারাও চায়, স্টেশনের কাছাকাছি একটি বাড়ি হোক । বোনেদের সহায়তায় আর সামান্য কিছু ধার-দেনা করে ঘোতন বাড়ি-সহ জমিটা কিনলো । 
     জমিটা কেনার জন্য আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে মনীষা যথেষ্ট সহযোগিতা করলো । যার জন্য ঘোতনের পক্ষে জমিটা কিনতে বেশী বেগ পেতে হলো না । 
      জমিটা রেজিস্ট্রি হওয়ার সাথে সাথে গবরডাঙ্গা গ্রাম থেকে ব্রজেশ্বর  কামাল কঙ্কাবতীর বাড়ি এসে উপস্থিত । তাঁর ছোট মেয়ের জন্য । ব্রজেশ্বর কামালের তিন মেয়ে । ছেলে নেই । প্রথম দুই মেয়ে বিবাহিত । বড় জামাই হাসপাতালের স্টাফ । বাড়ি বেলডাঙ্গা  ।  আর দ্বিতীয় জামাই বিডিও অফিসের ক্লার্ক ।  বাড়ি বর্ধমানের রসুলপুরে । ছোট মেয়ের বিয়ে বাকী  । ছোট মেয়েটা সালার কলেজ থেকে স্নাতক । চাকরি-বাকরি নেই । ছোট মেয়ের নাম লতা । লতার ইচ্ছা ছিল, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসার । কিন্তু তার সে আশায় বালি । মানুষের সব আশা পূরণ হয় না । তেমনি লতার চাকরি পাওয়ার আশা পূরণ হলো না । যার জন্য বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে ব্রজেশ্বর কামালের বড্ড দেরী হয়ে গেলো । লতা একটু ডানপিটে ধরনের মেয়ে । গ্রামের  সব ব্যাপারেই তার মাথাব্যথা । গাঁয়ে কে অসুস্থ, কে খেতে পেলো না, সব কিছুতেই  তার জড়ানো  চাই । আপদে-বিপদে সকলের পাশে থাকতে লতা ভীষণ সাবলীল !  ব্রজেশ্বরবাবু  কাঙাল ঘোষের মুখে জানতে পেরেছেন, কঙ্কাবতী   ছেলের বিয়ের জন্য পাত্রীর খোঁজ করছে ! খবর জানা মাত্র ব্রজেশ্বরবাবু  সোজা কঙ্কাবতীর দরবারে ।
   কী আশ্চর্যের ব্যাপার, লতাকে ঘোতনের খুব পছন্দ । তাই  মাকে সরাসরি জানিয়ে দিলো,  “লতাকেই সে বিয়ে করতে চায়  ।“     
                                                          (চলবে)