লুকিয়ে থাকা একটি স্মৃতি।

0
598


সামনেই বড় দিন। খ্রিস্টমাস ডে। এই দিন গুলোতে প্রতিটি মানুষ প্রাণভরে ছুটি উপভোগ করে। কেউ পিকনিক, কেউ বেরিয়ে পড়ে ভ্রমনের নেষায়। আসুন আমরা জেনে নেবো এমন কিছু ভ্রমনের স্থান।
জায়গাটার নাম লুকলা।নেপালের বিশাল বিশাল পাহাড়ের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে থাকা গ্রামের এটি একটি ছোট্ট গ্রাম।কিখেয়াল হলো কাঠমান্ডু তো অনেক বার ঘোরা হলো  এবারে ছোট ছোট ফ্লাইটে এই গ্রাম গুলো ঘুরে দেখার। একঘন্টা ও লাগলো না আমরা একেবারে হিমালয়ের গহনে চলে এলাম ।দুটো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে  দশ বারো জন যাত্রী নিয়ে ছোট ছোট প্লেনগুলো
আসে।দিনে দু তিন বার। এতো সরু নামার পথ ভয় হয় এইবুঝি পাহাড়ের ধাক্কা লেগে যাবে ।কিন্তু  নিয়মিত এই পরিবহণ ব্যবস্থা চলেছে।যেমন কাঠমান্ডু থেকে পোখরা বা জুমসুং এটিও তাই।প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা বলছি।শুনেছি  ওখান থেকে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে যাওয়া  শুরু হয়। তখন আমার  একান্ত প্রিয় মানুষ টি আমার সঙ্গী ছিলেন ।আমরা দু জনে থাকলে পৃথিবীর যে কোন  জায়গাতেই ইচ্ছে হলে চলে যেতাম। তখন লুকলার সন্ধান পেয়ে ঐখানে যাওয়া ই মনস্থ করলেন ।অনেক অনেক পাহাড়ে ঘুরেছি এতো নির্জন বিচ্ছিন্ন  পাহাড়ে কখনও  যাই নি।তখন  দুটি হোটেল ছিল  নাম মনে নেই।একদম খালি ।সব অভিযাত্রী দল বেরিয়ে গেছে।ওরাই হোটেল দুটিতে থাকেন ।সবাই  চলে গেছে  অভিযানে।আমরা খুব সহজেই  সুন্দর  আপ্যায়ন পেলাম।ম্যানেজার আমাদের মতো ট্র্যাভেলার পেয়ে ভীষণ খুশী ।সাধারণত এরকম ট্র্যাভেল কেউ করে না।ওনার সাথে সারাদিন বসে কতো গল্প শুনে আমাদের  এই নির্জন পাহাড়ের দিনগুলো এতো মোহনীয় হয়ে  উঠেছিল  আজ এতোবছর পরেও স্মৃতি  অম্লান হয়ে  আছে ।
এতো সুন্দর পাহাড়ের রূপ আগে দেখিনি ।যেন বিশাল হিমালয়ের একদম
অভ্যন্তরে ঢুকে পড়লাম।চারিদিক পাহাড়ে পাহাড়ে ঘেরা তার মাঝে ছোট্ট একটি গ্রাম ।লুকলা এয়ারপোর্টে বললে
ঠিক বলা হবে না।ছোট্ট প্লেনটি কোনমতে হেলে দাঁড়িয়ে পরে।ওই ঝুলন্ত
অবস্থায় যাত্রীরা নামা ওঠা করে।চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না ।বিশ্বের
একমাত্র বিপজ্জনক এয়ারপোর্টে নামে খ্যাত এই লুকলা এয়ারপোর্টে ।
।এখানে সাধারণত
গ্রামবাসী  আর এভারেস্ট অভিযাত্রী রাই আসেন ।এখান থেকেই শুরু হয়  এভারেস্ট বেস ক্যাম্প যাত্রা । অভিযাত্রীরা এখান থেকেই ট্রেকিং শুরু করেন।এখন অবশ্য  এয়ারপোর্ট হয়ে গেছে ‘তেনজিং নোরগে  এয়ারপোর্ট’। আমি পঁচিশ তিরিশ বছর আগের কথা বলছি।যখন  শুধুই নাম শুনেছি।গুগুল ছিল না ইন্টারনেট ছিল  না কেবল ম্যাপ দেখে দেখে ঘুরে বেড়িয়েছি।একটা নেশার মতো পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে এতো আনন্দ  পেতাম  আজ এই স্মৃতি যে কী মধুর বুঝতে  পারছি।
        আমার লেখা কিন্তু অন্য প্রসঙ্গে চলে যাবে  এখুনি ।যার জন্য  এতো রাতে  কলম ধরেছি।বেশ  মধুর  আতিথেয়তা তে দিন কটি কাটছে।নেপালী মালিক  আমাদের  দু জনের  জন্য  তাঁর হোটেলের সেরা  সেরা পদ রান্না করে খাওয়াচ্ছেন।কী যে যত্ন করেছিলেন তা বলে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমরা চলে আসার  আগের  দিন  একটি মহিলা অভিযাত্রী দল  ফিরলো।আমরা আমাদের ঘর থেকেই  দেখলাম  শ্রান্ত বিধ্বস্ত দলটি সামনের  সবুজ  লনে হাত পা ছড়িয়ে অনেক ক্ষণ চোখ বুজে  শুয়ে রইলো।ঘোড়াওলা কুলীরা সব মালপত্র রেখে  কোথায় চলে গেল ।সুইস অভিযাত্রী ।সব মেম সাহেব ।আমার  খুব  ওদের  দেখতে ভালো  লাগছে ।কী সুন্দর  সব দেখতে।তখনও  অভিযানের পোষাক গড়া।আমি অবাক হয়ে দেখছি।তুমি  এসে বললে এই পাগলী এখনও দাঁড়িয়ে আছো।ব্রেকফাস্ট করতে হবে তো।না এদের  দেখেই পেট ভরে যাবে ।চলো ম্যানেজার ডাকছে।আজ নতুন কি একটা খাওয়াবে।আমি  লজ্জা  পেয়ে তাড়াতাড়ি ওর সঙ্গে ডাইনিংহলে গেলাম।কিন্তু চোখে ওই পরিশ্রান্ত সুন্দর মুখগুলো লেগে রইলো  ।
     তারপর আর  ওদের  দেখিনি।বিকেল বেলা  চা দিতে  এসে বেয়ারা বললো ম্যানেজার সাব আপনাদের  ডেকেছেন । চা খেয়ে  আমরা ওনার ঘরে গেলাম ।বিশাল ঘরে চারিদিকে কাচের বড় বড় জানালা ।সামনে পাহাড়ের নীচে  বিস্তৃত সবুজের ময়দান। একঝলক দেখে মনে হলো এতো সুন্দর ও হতে পারে! উনি  বসেছিলেন । আমরা ঢুকতেই আইয়ে দিদি আইয়ে দাদা বলে উঠে এসে ভেতরে জানালার ধারে সোফাতে বসালেন ।আমাকে  বললেন  দিদিকে দেখে আমার মনে হয়েছে দিদির মনে অনেক প্রশ্ন আছে এই মহিলা অভিযাত্রীদের নিয়ে।আমার তাই মনে হলো এটা দিদিকে দেখাই।পরে বুঝলাম  এবারেগাইড পোর্টারদের সঙ্গে  অভিযাত্রীনীদের বিদায়ের পালা।সে যে কী বিরল দৃশ্য ।সবাই কাঁদছে জড়াজড়ি করে।একটি খুব সুন্দরী বয়সও সবার  থেকে  কম ও তো ওর গাইডকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে  চুমোয় চুমোয় ভরে দিচ্ছে  ।সবার  বিদায়।পালা শেষ হয়ে গেল । ওর আর শেষ হয়না।যেন অনন্ত কাল  এই ভাবেই থাকবে।আর তার সঙ্গে কান্না ।চোখের জলে দুজনেই  ভেসে যাচ্ছে । এরকম একাত্ম  হয়ে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আছে সমস্ত বিশ্ব পৃথিবী ভুলে। আমি  অবাক হয়ে  দেখতে দেখতে ভাবছি এই কালো রোগা ছেলেটির মধ্যে কী পেল এতো কষ্ট ছেড়ে যেতে ! আমার মনটা ও কেমন খারাপ হতে লাগলো ।তখন  ঐ দাদা বললেন  অনেক দিন  ভয়ংকর পরিবেশে পাশাপাশি থাকতে থাকতে  কতো বিপদের মুহূর্তে প্রান দিয়ে যখন ওদের  আগলে রাখে সেই মুহূর্ত গুলো  ওরা ভুলতে পারে না ।ওদের ওপর অগাধ ভরসা আর বিশ্বাস করতে করতে কখন যে ভালোবেসে ফেলে বুঝতেও পারে না।এই ছেড়ে যাওয়ার সময়ে  ওদের প্রচন্ড কষ্ট হয় দিদি। আমি তো অনেক  দেখেছি কী পুরুষ কী মহিলা  কদিনের সফরে ওরা অভিন্ন হৃদয় হয়ে যায়।তাই এই চলে যাওয়াটা বড়োই বেদনার  দিদি।আমি চুপ  করে বসে থাকি ।তখনও  ওরা দুজন দুজনকে এক ভাবে ধরে আছে।আমার বুকের মধ্যে কেমন একটা কষ্ট হতে লাগলো ।যেন আমার কোনও প্রিয়জন ছেড়ে চলে যাচ্ছে । যার সঙ্গে আর জীবনে কোনও দিন দেখা হবে না।
       কতো কী জানা ছিলো না দেখা ছিলো না।এই লুকলা একটা সম্পূর্ণ অচেনা  জগতের ছবি উপহার দিয়েছিল। আমার  প্রিয় মানুষ টি আজ আমার  কাছে  নেই।অনেক দূরে আমায় রেখে চলে গেছে।আমি জানি  এখন  সে আমার  সাথে লুকলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে  আমার কাঁধে হাত  রেখে সেই বিদায়বেলার করুণ দৃশ্য টি দেখতে  দেখতে  আমার দিকে তাকিয়ে আছে।কান্নার শেষ হয় কি?  আমার জানা নেই। ।
 
আমার  পাহাড়ের  একটি  স্মৃতি সবার সাথে শেয়ার করলাম ।

কলমে : শীলা পাল