আবদুল হাই, বাঁকুড়াঃ বাঙালির ‘বার মাসে তের পার্বণে’র সূত্র ধরে ‘ফাল্গুন মাসের সংক্রান্তিতে রাড় বাংলায় ঘরে ঘরে পালিত হল ‘ঘাটু উৎসব’ । এই চিত্র উঠে এল বাঁকুড়া জেলার ইন্দাস ব্লকের দশরথবাটি গ্ৰামের কয়েকটি পরিবারে।
ঘাটুর অবয়ব গোবরের ডেলা, চোখ আঁকা হয় সিঁদুর দেওয়া দুটি কড়ি বসিয়ে । ওই অবয়বে দেওয়া হয় হলুদ সুতোর পৈতে । তাঁর বাঞ্চিত ফুল ঘাটুফুল (ভাটফুল ) । ঠাকুরের পরিধেয় বস্ত্র হলুদে ভেজানো নেকড়া । ঘাটুকে বসানো হয় মাটির হাঁড়ি ভাঙার টুকরো সমেত এক ছোট বাঁশের ডালিতে । পুজোয় ঝামেলা কম । পুরহিত নয় ,সাধারণত পুজো করেন বাড়ির বয়স্ক মহিলারা । মন্ত্র সেইঅর্থে বেশি কিছু নেই । ভোর ভোর বাড়ির মূল দরজার সামনে গোবরের নেতা বা মাড়ুলী দেওয়া হয় । তারপর ধুপ দীপ জ্বালিয়ে ঘাটু তৈরি করে ঘাটুফুল দিয়ে ঘাটু (ঘন্টা) বাজিয়ে পুজো করা হয় ঘাটুর । বাড়ির চৌহদ্দিতে বসন্ত কালের রোগ জ্বালা যাতে প্রবেশ করতে না পারে ,সেজন্য বাড়ি ঢোকার মূল দরজার বাইরে এই অপদেবতার পূজা করা হয় । প্রসাদ সেরকম থাকে না ,সামান্য চাল ও কলাই । মাটির খলা ভাঙায় প্রদীপ দিয়ে কাজল পাড়া(তৈরি) হয় । ঘাটু পুজো হয়েগেলে শাঁখ বাজিয়ে জলের ধারা দিয়ে অনেক যায়গায় বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় ঘাটুকে । আবার কোথাও কোথাও পূজোর শেষে ঘাটুকে পুকুরের জলে বিসর্জন দেওয়া হয় । তারপর মা ঠাকুমা ঘেটুর কাজল পরিয়ে দেন বাড়ির ছোট বড় সকলকে চোখে , এবং হলুদ নেকড়া বুলিয়ে দেন চোখে । ধারণা ,ঘাটুর কাজল ও হলুদ কাপড় চোখে দিলেই আর জয়বাংলা(চোখ উঠা) সহ চোখের কোন অসুখ হবেই না । কল
ঘাটু আর পাঁচ পাঁচটা বৈদিক দেবতার মত নন । তিনি অপ দেবতা গোষ্টি ভুক্ত । ঘাটু ঠাকুরের সাথে ধর্মঠাকুর, বসন্ত চন্ডী,শীতলা, অলাই চন্ডী (ওলাওঠা রোগের দেবী ) দেবীর সাদৃশ আছে । অনেকের বিশ্বাস এই দেবতারা মূলত চর্ম রোগের সাথে যুক্ত । বসন্ত রায় বা চন্ডী ও শীতলা যেমন বসন্ত রোগের দেবতা ,তেমনি ঘাটু খোঁস পাঁচড়ার দেবতা বলেই পরিচিত । এই রোগের প্রকোপ থেকে রক্ষার জন্য ঘাটুর প্রিয় ফুলকে ব্যবহার করা হয় । আলক্ষ্মীর যেমন লক্ষ্মীতে বিদ্মেষ , ঠিক সেইরকম বিষ্ণুতে বিদ্মেষ ঘাটুর । আলক্ষীর সাথে বিষ্ণুর অভিশপ্ত ঘাটুর অবয়ব গত মিল এক । উভয়ের পূজোর উপকরণ ভাঙা মাটির পাত্র । যেসব ফুলে অন্য দেবতাদের পুজো হয় না ,সেই ফুলেই এনারা প্রীত । তাছাড়া দুই পুজোতে ভাঙা মাটির পাত্র ভাঙা অংশ আবার লাঠিদিয়ে ভাঙা হয় । এছাড়াও ঘাটু ও আলক্ষী পুজোতে ঐ ভাঙ্গা মাটির পাত্র বাজানো হয় । শনি ও ঘাটু ঠাকুরের পুজোর মধ্যেও যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় ,তা হোল আলক্ষী সহ শনি ও ঘাটুর প্রসাদ খেলেই হাত পা ধুয়ে নিজেকেশুদ্ধ করে নিতে হয় বলে জনশ্রুতি আছে ।
ফাল্গুনী সংক্রান্তিকে ঘাটু পূজার যথাযথ সময় নির্ধারণ করা হয়েছে , কারণ প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি রেখেই সমাজে সময়োপযোগী গ্রাম্য বা অপদেবতাদের চিন্তনের প্রসঙ্গ আসে । দেখা যায় উদ্ভুত মহামারি বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে সেই সময় তৎবিষক দেবতার উৎপত্তি ও আরাধনার সঠিক সময় নির্ধারিত হয় । যেমন বর্ষা কালে সাপের উপদ্রব, তাই সাপেদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসার সন্তুষ্টি বিধানে বর্ষা কালকে ওই দেবীর পূজার যথার্থ সময় বলেই বেছে নেওয়া হোল । দেশে যখন কলেরা ওলাওঠা রোগের প্রাদুর্ভাব হোল তখন অলাইচন্ডীর আগমন ঘটল । মল্লভূম তথা বিষ্ণুপুরে মল্লরাজাদের সময় অতি মহামারী দেখা দিয়েছিল বলে জানা যায় । সেই সময় (মৃন্ময়ী পূজার অষ্টমী- নবমীর মধ্যরাত্রে) বিশ্বাসের উপর ভর করে ,এই মহামারীর কবল থেকে সমগ্র বিষ্ণুপুরকে রক্ষা করতে লৌকিক দেবী ‘খচ্চরবাহিনী ‘দেবীর পূজার প্রচলন এভাবেই হয়েছে । এরকমভাবেই শীত ও গ্রীষ্মের সন্ধিক্ষণে অর্থাৎ বসন্তকালে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বসন্ত ও বিভিন্ন ত্বকের রোগ দেখা যায় । তাই এই রোগের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে শীতলা ,বসন্ত কুমারী ও ঘেটুর কল্পনা ও আরাধনার সময় বসন্ত কালকেই ঠিক করা হোল । এজন্যই ঘাটু ঠাকুরের পুজো হয় ফাল্গুন শেষ বা সংক্রাতির দিন । ঘেঁটু পুজোর পর ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা দল বেঁধে অতি উৎসাহে আনন্দে ঘাটুকে নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে চাল, কলাই আদায়ে বের হয়।
বাঁকুড়া থেকে আবদুল হাই এর বিশেষ প্রতিবেদন