সানাই বাড়ি ফিরে তড়িঘড়ি ডাল সেদ্ধ ও ভাত নামিয়ে দিলো । গরম গরম সেদ্ধ ভাত খেয়ে কুহেলি স্কুলে গেলো । টিফিন বানিয়ে দেওয়ার মতো ঘরে কিছু ছিল না । তাই টিফিন ছাড়াই কুহেলিকে স্কুলে যেতে হলো । ক্লাসে ভাল ছাত্রী না হলেও পড়াশুনায় গতানুগতিক । তবুও সে ক্লাসে ফার্স্ট বেঞ্চে বসে । কুহেলি আর পাঁচটা মেয়ের মতো চঞ্চল বা ছট্ফটে নয় । নিজস্ব ঢঙে স্বাভাবিক ছন্দে জীবন যাপন করে । কো-এডুকেট স্কুল । ছেলে ও মেয়ে একসঙ্গে পড়াশুনা । গ্রামবাংলার মধ্যে হাই স্কুল । এতদিন জুনিয়র হাই ছিল । সম্প্রতি মাধ্যমিক পর্যন্ত উন্নীত । উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার ক্ষেত্রে ভরতপুর হাই স্কুল । তারপর কলেজ সালারে । কুহেলি সাইকেলে হাই স্কুল যায় । বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার । তবে গাঁয়ের রাস্তা হলেও পাকা রাস্তা । পাকা রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাতায়াতে সমস্যা নেই । কাঞ্চন নগরের অন্যান্য ছেলে-মেয়ে সাইকেলে স্কুলে যাতায়াত করে । সুতরাং স্কুলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে কুহেলির কোনো সমস্যা নেই । কুহেলি কুছুটা চুপচাপ ! কুহেলি ক্লাসের ছেলে-মেয়ের সাথে ততটা খোলামেলা নয় । নিজেকে সর্বদা গুটিয়ে রাখে । তবুও ক্লাসের মধ্যে বিবেক ছেলেটি তার ভাল বন্ধু ।
কুহেলির চালচলনে সীমাবদ্ধতা দেখে ক্লাসের বিবেক একদিন জিজ্ঞাসা করলো, “কিরে কুহেলি ! তুই আমাদের সাথে খেলতে যাস না কেন ? স্কুল মাঠে সবাই খেলতে গেলে তুই চুপচাপ ক্লাসে বসে থাকিস কেন ? তা ছাড়া তুই কেমন যেনো নিজেকে গুটিয়ে রাখিস ! এটা ঠিক নয় । সবার সঙ্গে হেসে-খেলে মিশবি । দেখবি তোর মন ভাল থাকবে ।“
উত্তরে কুহেলি বলল, “আমার ভাল লাগে না । আমি নীচু জাতের মেয়ে । সকলে আমার সঙ্গে মিশতে ততটা আন্তরিক নয় ! তাই চুপচাপ ক্লাসেই বসে থাকি । তবে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে গাঁয়ের মাঠে খেলতে যাই । সেখানে গাঁয়ের সব বন্ধুদের সাথে খেলি ।“
“নীচু জাতের হলেও তুই তো মানুষ । তুই আমাদের বন্ধু । সুতরাং কখনও হীনমন্যতায় ভূগবি না । যতটা পারবি, মনের আনন্দে হৈচৈ করে সময়টা কাটিয়ে দিবি । এখন চল, মাঠে খেলবি !” বিবেক কুহেলিকে জোর দিলো ।
কুহেলির আচরণ সেইরকম ! মাঠে যাওয়ার হেলদোল নেই । তাই বিবেককে বলল, “তোরা মাঠে যা । আমি পরে আসছি ।“
অগত্যা বিবেক বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে খেলতে শুরু করলো । বিবেক জানে কুহেলিদের পরিবার ঝাড়খণ্ড থেকে এসেছে । তারা সাঁওতাল সম্প্রদায়ভুক্ত । কুহেলির দাদুর দূর সম্পর্কের আত্মীয় কঞ্চন নগরের ঘনশ্যাম ঘড়ামী । ঘনশ্যাম ঘড়ামীর পরামর্শে তাদের পরিবার কাঞ্চন নগরে বসবাস শুরু করে । সেই সময় ঝাড়খণ্ডে তাদের গ্রামে তীব্র অভাব অনটন শুরু হয়েছিল । তা ছাড়া গাঁয়ে শুরু হয়েছিল মহামারী । মারাত্মক ব্যাধির প্রকোপে পড়ে গ্রামের মানুষেরা । সেই সময় বাঁচার তাগিদে কিছু মানুষ অসমের বিভিন্ন জায়গার চা বাগানে কাজের খোঁজে ছুটে গিয়েছিল । তারা আজও ঝাড়খণ্ডে ফেরেনি । কিন্তু কুহেলির দাদু ডেরা বাঁধে কাঞ্চন নগরে । জাতে সাঁওতাল হলেও বর্তমান সময়ে কেউ তাদের সাঁওতাল হিসাবে জানে না । গ্রামটা আগাগোড়া কায়েত পাড়া, তাই আশেপাশের গ্রামের মানুষজন জানে কাঞ্চন নগরে যারা বাস করে তারা প্রায় সকলে কায়েত । হাতে গোনা গোটা কয়েক পরিবার নীচু সম্প্রদায়ভুক্ত । অনেক খাটাখাটুনি করে কুহেলির দাদু কাঞ্চন নগরে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করে । মাঠে চাষের জমি বাড়ায় । কমপক্ষে পয়তাল্লিশ বিঘে চাষের জমি । কাঞ্চন নগরে আসার পর অতো সহজে তারা দাঁড়াতে পারেনি । কুহেলির দাদুকে অনেক ঝড়ঝাপ্টা পোহাতে হয়েছিল । দাদুকে প্রথমে গাঁয়ে গাঁয়ে মাছ বিক্রি করে সংসার চালাতে হয়েছিল । তারপর ধান সেদ্ধ করে চাল তৈরীর ব্যবসা । আস্তে আস্তে তিন খানা গাই গরু কিনে দুধের ব্যবসা ! দুধ বিক্রি করে টাকা উপার্জন । প্রথমে মাঠে জলাশয় ঘেঁষে দশ বিঘে জমি । সেই জমিতে চাষ আবাদ করে কুহেলির দাদুর বাড়-বাড়ন্ত ।
কুহেলির ঠাকুমার চিকিৎসার জন্য বিঘে পাঁচেক জমি বিক্রি করতে হয়েছিল । দাদুর আগে ঠাকুমা বিদায় নিয়েছিলেন । দাদু বেঁচে থাকতে সানাই ও কানাইকে সমান ভাগে চাষের জমি ভাগ করে দিয়ে গেছেন । কানাই অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল । সানাই কিছুটা আলস্যের কারণে সংসারে উন্নতি করতে পারেনি । তার উপর পত্নী বিয়োগ হওয়ার পর সানাই ঘাম ঝরা পরিশ্রম একদম করে না । চাষের জমিতে যেটুকু ফসল হয় তাতেই সানাইয়ের সংসার ভালভাবে চলে যায় । যদিও তার অর্ধেক জমি ভাগে দেওয়া । সেখান থেকে অর্ধেক ফসল তার ঘরে ঢোকে । বাপ-বেটি তাদের ঠিকঠাক চলে যাচ্ছে । সেইজন্য সানাই বেশী খাটতে রাজি নয় । অন্যদিকে কানাই দিন রাত পরিশ্রম করে নিজে চাষ করার জন্য আরও কয়েক বিঘা চাষের জমি ইতিমধ্যে বাড়িয়েছে । তার দুই ছেলে ও তিন মেয়ে । সানাইয়ের আগে কানাইয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হয় । কানাইয়ের ভরা সংসার । বাড়িতে চাষবাসের প্রচুর কাজকর্ম । কানাইয়ের দুই ছেলে স্কুলে যাওয়ার নাম করেনি । তাই তারা চাষের কাজে নিয়োজিত । ফলে কানাইয়ের স্বচ্ছল পরিবার ।
কাঞ্চন নগর গ্রামে জাতপাত নিয়ে কচলাকচলি তুঙ্গে । ছোট্ট একটি গ্রাম । অথচ মানুষের মধ্যে জাতপাত প্রথা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ । গ্রামের অনেক অনুষ্ঠানে ঘড়ামি, জেলে, কামার, সাঁওতালদের পরিবারেরা নিমন্ত্রিত হয় না । বরং বলা চলে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের নিমন্ত্রণ করা হয় না । ছোঁয়াছুঁয়িতে জাত যেতে পারে । এই অছিলায় তাদের ব্রাত্য রাখে । এটা এখন সানাইদের কাছে গা-সওয়া ! তাই গ্রামের মানুষের সাথে প্রয়োজন ছাড়া সানাই মেশে না ।
তারপর…………
তারপর বিবেক লক্ষ্য করলো কুহেলি গুটি গুটি পায়ে মাঠে ঢুকছে । তখন বিবেক বল নিয়ে মাঠে খেলছিল । খেলা বন্ধ রেখে কুহেলিকে বলল, “এতক্ষণে তোর মাঠে আসার সময় হলো ।“
শুনে কুহেলি এক ঝলক হাসি দিয়ে বলল, “তোকে আগেই বলেছি স্কুলের খেলার মাঠে আসতে আমার ভাল লাগে না ।“
টিফিন টাইম শেষ । ক্লাসের ঘন্টা বেজে উঠলো । সবাই ক্লাসে ছুটলো । পরের ক্লাসটা ভুগোল মাস্টার মশাইয়ের । কিন্তু জানা গেলো ভুগোলের মাস্টার মশাই স্কুলে আসেননি । তাই ইংরেজির মাস্টার মশাই ক্লাস নেবেন । ইংরেজি কুহেলির প্রিয় বিষয় । ইংরেজি পড়তে ও লিখতে কুহেলির খুব ভাল লাগে । ক্লাসে স্যার ঢুকেই কুহেলিকে খোঁজ করলেন । বোর্ডে গরু নিয়ে দশ লাইন লিখতে বললেন । লিখতে গিয়ে দুটো বানান ভুল করলো কুহেলি । তার জন্য শাস্তি হিসাবে মাস্টার মশাই কুহেলিকে ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসতে বললেন । তারপর বানান দুটো সুন্দরভাবে স্যার বুঝিয়ে দিলেন । পরেরদিন সবাইকে “আমাদের দেশ” নিয়ে দশ লাইন লিখে আনতে বললেন । মাস্টার মশাই চলে গেলেন । তারপর আরও দুটি ক্লাসের পর স্কুল ছুটি হলো । ছুটির পর বাড়ি ফিরে কুহেলি দেখলো, পান্তা মাসি তাদের বাড়িতে । তার বাবার সঙ্গে গল্প মস্করায় মত্ত । বাবার সঙ্গে পান্তা মাসির ঘনিষ্টভাবে মেলামেশা কুহেলির একেবারেই না-পসন্দ ! তাই পান্তা মাসির আগমন কুহেলির ভাল লাগলো না । সোজা ঘরে ঢুকে বইয়ের ব্যাগটা রেখে বাথরুমে ঢুকে গেলো ।
সানাই কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল, কুহেলি পান্তা মাসিকে পছন্দ করে না । তবুও মেয়ের অপছন্দকে আমল দিতে চাইনি সানাই । উল্টে সানাই ভেবেছিল, কুহেলিকে ভালভাবে বুঝিয়ে বললে পান্তা মাসির প্রতি তার রাগ কমে যাবে । পান্তা মাসি স্বেচ্ছায় বাড়ির কাজকর্ম করে দিচ্ছে । রান্না করে দিচ্ছে । যার জন্য তাদের সংসারে অনেকটাই সুরাহা ! তা ছাড়া পান্তা মাসি নিয়ম করে কুহেলিদের বাড়ি আসে । রান্না করা ছাড়াও ইদানীং দু-দণ্ড বসে কুহেলির বাবার সঙ্গে নানান বিষয়ে শলা-পরামর্শ করে । সানাই ক্রমশ ঘর গৃহাস্থলির ব্যাপারে পান্তা মাসির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে । অন্যদিকে কুহেলি ক্রমশ বড় হচ্ছে । সে এখন ক্লাস এইটে । সানাই চাইছে, তার মেয়ে পড়াশুনায় ভাল হোক । কুহেলির জন্য এখন তিনজন প্রাইভেট মাস্টার । পাশের গ্রাম সিসগ্রাম থেকে একজন অঙ্কের মাস্টার বাড়ি এসে পড়ায় । আর বাকী দুজন মাস্টারের বাড়ি গিয়ে কুহেলি পড়ে আসে । সাইকেলে যাতায়াত । সকালে একজন এবং সন্ধ্যাবেলায় অন্যজন । সকালে বিজ্ঞানের বিষয় ছাড়াও বাংলাটাও শেখে । অন্যদিকে সন্ধ্যাবেলায় ইংরেজি । সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফেরার সময় কুহেলির সঙ্গে সানাই থাকে । প্রচুর পরিশ্রম করার জন্য কুহেলি ক্লাসে ভাল রেজাল্ট করলো । কুহেলির রেজাল্ট দেখে সানাই খুব খুশী । মেয়ের মাথায় হাত রেখে সানাই গর্বের সঙ্গে বলল, “তুই যতোদূর ইচ্ছা পড়বি । আমি তোকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবো । সমাজে তুই মাথা উঁচু করে বাঁচবি, আমি সেটা দেখে যেতে চাই ।“ এই কথা বলার পর সানাইয়ের চোখে জল ।
বাবা ! তুমি কাদছো ?
তোর মায়ের জন্য মন খারাপ । তোর মা বেঁচে থাকলে রেজাল্ট দেখে তোর মা খুব খুশী হতো । তারপর বিড়বিড় করে বলল, মেয়েটাকে জন্ম দিয়ে অকালে বিদায় নিলো । অথচ মেয়েটার বড় হওয়া দেখে যেতে পারলো না ! অদৃষ্টের কী নিষ্ঠুর পরিহাস !
নবম শ্রেণীতে ওঠার পর কুহেলির পড়াশোনার চাপ আরও বেড়ে গেলো । সংসারের কাজ করতে সময় পায় না বললেই চলে । স্কুল ও প্রাইভেট টিউশন নিয়ে কুহেলি নাজেহাল । তাই রীতিমতো ভীষণ ব্যস্ত । ঘরের কাজ ও চাষের কাজ একসঙ্গে চালাতে গিয়ে সানাইয়ের হিমসিম অবস্থা ! সানাই ঘরের কাজের জন্য একটু বেশীমাত্রায় পান্তা মাসির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লো । পান্তা মাসির সঙ্গে সানাইয়ের মেলামেশা নিয়ে গাঁয়ে গুঞ্জন অহরহ । সবচেয়ে বেশী ফ্যাসাদে পড়তে হচ্ছে কুহেলিকে । কুহেলির স্কুলের বন্ধুরা পান্তা মাসিকে নিয়ে নানান ধরনের তির্যক মন্তব্য করে । সেদিন স্কুলে যাওয়ার সময় গ্রামের কায়েত বাড়ির মনিটুসি বলে কিনা পান্তা মাসি তোর বাবাকে বিয়ে করে ঘর সংসার বাঁধতে চায় । স্কুল থেকে ফেরার সময় গাঁয়ের চৌধুরী বাড়ির মধ্য বয়স্ক ফুল কাকিমা কুহেলিকে জিজ্ঞাসা করলো, “সবজি বিক্রি করে বিধবাটা তোদের বাড়িতে কেন ঘোরাঘুরি করে ? সকালবেলায় ঢুকে বেলা গড়িয়ে গেলেও বাড়ি থেকে বের হওয়ার নাম করে না । আবার সেই সময় তোর বাবাও বাড়ি থেকে কোথাও বের হবে না । ব্যাপারটা কী ?” কুহেলির এইসব কথা একদম ভাল লাগে না । বাবার নামে কেউ কুৎসা রটাক, সেটা কুহেলির না-পসন্দ । অথচ পান্তা মাসিকে বলতেও প[রছে না, “তুমি আমাদের বাড়ি আসবে না ।“ বাবাকে জড়িয়ে পান্তা মাসিকে নিয়ে লোকের বলাবলি, গাঁয়ে আনাচে-কানাচে গুঞ্জন কুহেলির শিশু মনে খুব আঘাত করে । তবুও চুপচাপ থাকে একটাই কারণে, পান্তা মাসি বাড়িতে আসার জন্য ঘর-সংসারের কাজে অনেক সুরাহা ।
তারপর অনেকদিন কেটে গেলো ……………………
সামনে কুহেলির মাধ্যমিক পরীক্ষা । পড়াশুনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত । অন্যদিকে শীতলের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা । তবুও ইতিমধ্যে কুন্তল বাড়িতে এসে কুহেলির পরীক্ষার খোঁজ খবর নিয়ে গেছে । আসলে শীতলদের বাড়ি থেকে কেউ মনেপ্রাণে চায় না , শীতল কুহেলির সঙ্গে মিশুক । শীতলেরা বনেদী পরিবার । শীতলের বাবা হাই স্কুলের শিক্ষক । মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা । অনেক জমি জায়গা । তা ছাড়া কুহেলি সাঁওতালদের মেয়ে । বড় বংশের ছেলে হয়ে কেন সে নীচু বংশের মেয়ের সঙ্গে মিশবে ? উপরন্ত, তার মা নেই । মা না থাকলে শীতলদের পরিবারের ধারণা, মা-হারা মেয়ে খুব সহজে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে । সুতরাং শীতলদের পরিবার গোড়া থেকেই কুহেলির সঙ্গে শীতলের মেলামেশা বন্ধ করতে মরিয়া । কিন্তু শীতল এইসব নিয়ে একটুকু গুরুত্ব দিতে নারাজ । কুহেলির প্রতি পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক, শীতলের কুহেলিকে তার ভাল লাগে । তাই কুহেলির প্রতি শীতলের টান অফুরন্ত । তার মনের গহন গাঙে এখন শুধু কুহেলি বিরাজমান !
মাধ্যমিক পরীক্ষার সিট পড়লো ভরতপুর হাই স্কুলে । পরীক্ষা দেওয়ার সময় প্রতিদিন কুহেলির সাথে তার বাবা সঙ্গে যাচ্ছে । একা একা পরীক্ষার সময় কুহেলিকে ছাড়তে সানাই নারাজ । গরম ভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া এবং সঙ্গে টিফিন বাক্স । বাড়ির পাহাড়ায় থাকছে পান্তা মাসি । ভরতপুরে সাইকেলে যাতায়াত । কাঞ্চন নগরের সকল ছেলেমেয়ের সাথে কুহেলির ভরতপুরে যাতায়াত । তাই যাতায়াতে কোনোরকম অসুবিধা হচ্ছে না । হৈচৈ করে পরীক্ষা দিতে যাওয়া । অন্যদিকে কুহেলির মাধ্যমিক পরীক্ষা খুব ভাল হচ্ছে । তবে ভুগোল পরীক্ষা ভাল দেয়নি । ইংরেজি প্রশ্নের ক্ষেত্রে পাঁচ নম্বর উত্তর দিতে পারেনি । অঙ্কেও তেমনি । চার নম্বর ছাড়তে হয়েছে । তাতে কুহেলির ধারণা সে স্টার মার্ক রাখতে সক্ষম হবে । পরীক্ষা দিয়ে কুহেলি খুব খুশী ।
মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ ! কুহেলি এখন চাপমুক্ত ! অনেক হাল্কা ।
পরীক্ষার পর কুহেলির অফুরন্ত সময় ! অন্যদিকে শীতলও তার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা খুব ভাল দিয়েছে । শীতল স্কুলে ভাল ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম । সুতরাং শীতলের পরীক্ষা ভাল হবে সেতা কুহেলি জানতো । পরীক্ষার পর শীতল এখন ঘন ঘন কুহেলির সাথে মিশতে শুরু করলো । পান্তা মাসি আবার কুহেলির সাথে শীতলের মেলামেশাটা পছন্দ করে না । পান্তা মাসির ভয়, “কুহেলি বড় হয়েছে । এখনও তার বোধবুদ্ধি সেভাবে পাকেনি । শীতলেরা বড় লোক । গরীব মানুষের মেয়ের সাথে ঘনিষ্টভাবে মেলামেশা করে পরে তাকে চিনতে পারবে না । ঠিক মাটির ভাঁড়ে চা খাওয়ার মতো । চা খাওয়া হয়ে গেলে মাটির ভাঁড় দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চম্পট । সেই ক্ষেত্রে কুহেলির সর্বনাশ ছাড়া ভাল কিছু হবে না । তাই পান্তা মাসি সানাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, কুহেলি যেনো শীতলের সঙ্গে না মেশে ।“ এখানেই কুহেলির বড্ড রাগ ! পান্তা মাসি কেন কুহেলির ব্যক্তিগত জীবনের নানান ব্যাপারে নাক গলাবে ? সে এখন অনেক বড় । মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে । নিজেকে অনেক বুঝতে শিখেছে । নিজের ভাল-মন্দের ব্যাপারে এখন অনেক বেশী সজাগ ! সুতরাং তার জীবনের চলার পথের ক্ষেত্রে কেউ নাক গলাক, কুহেলির সেটা না-পসন্দ ।
সেদিন রবিবার । বাবা গিয়েছে সালারে । গ্রীষ্মের ধান চাষের জমিতে কীট-পোকা লেগেছে । তার জন্য কীট-নাশক ঔষধ দরকার । সেটা পাওয়া যায় সালারের কৃষি ভাণ্ডার দোকানে । ফিরতে বেলা গড়িয়ে যাবে । কেননা বাড়ি থেকে সাইকেলে ভরতপুর এবং তারপর ভরতপুর থেকে বাসে সালার । যদিও রাস্তা এখন ভাল । ভরতপুর থেকে সালার পৌঁছানো খুব বেশী সময় লাগে না । সালারে কাজ সেরে পুনরায় ভরতপুর । ভরতপুরে কিছু দোকান-বাজার রয়েছে । সেগুলো সেরে ফিরতে ফিরতে অনেক দেরী । তাই বিকালবেলা কুহেলি ভাবলো, শীতলের সঙ্গে ঘুরতে বের হবে । শীতল ভাল স্কুটি চালায় । ওর স্কুটিতে বাবলা নদী পর্যন্ত যাবে ।
ফোন করলো শীতলকে । শীতল ফোন পেয়েই প্রথমে তার পাল্টা প্রশ্ন, “তুই কী ফোন কিনেছিস ?”
তুই কী পাগল হয়েছিস, আমি ফোন কিনবো কোথা থেকে ?
তবে এই ফোন নম্বরটা কার ?
ফোন ও ফোন নম্বর দুটোই আমার । মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বাবা কিনে দিয়েছেন । আগেই বলেছিলেন, মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে গেলে মোবাইল কিনে দেবেন । সেই কথা রাখতে, বাবা মোবাইলটা গতকাল আমাকে দিয়েছেন । মোবাইলটা বাবা বেশ কিছুদিন আগে বহরমপুর থেকে কিনেছিলেন । কিন্তু আমাকে বলেননি । পাছে আমার পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটে । তাই মোবাইল কিনে সযত্নে ঘরে রেখে দিয়েছিলেন । বলতে পারিস, ফোন থেকে প্রথম ফোন তোকে করলাম । তবে একটা ফোন গতকাল করেছিলাম, সেটা মামার কাছে । বাবা বললেন, মামাকে একটা ফোন করে কথা বলতে । সেই সময় একমাত্র মামাকে একটা ফোন করেছিলাম । তিনি আমার ফোনের কথা শুনে খুব খুশী ।
এবার বলুন ম্যাডাম, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি ?
আমার সঙ্গে ঘুরতে যেতে হবে ।
ঘুরতে ? কিন্তু কোথায় ঘুরতে যাবি ?
তুই স্কুটি নিয়ে আসবি । স্কুটিতে বসে সিদ্ধান্ত নেবো, কোথায় যাবো ?
ঠিক আছে ম্যাডাম । এখন বিকেল তিনটে । আমি চারটের মধ্যে তোর বাড়ি হাজির হচ্ছি । রেডি থাকবি কিন্তু !
আচ্ছা বেশ ! আমি রেডি থাকবো ।
তারপর দুজনে লোহাদহের ঘাটে । বাবলা নদীর পারে । হরিনগরের দিকে এগিয়ে গিয়ে ফাঁকা জায়গায় স্কুটি দাঁড় করালো । এবার শীতল ভাল করে কুহেলির দিকে তাকিয়ে দেখলো, কুহেলি আর সেই ছোট্ট কুহেলি নেই । এখন সে দস্তরমতো বড়োসড়ো মেয়ে । দেখতে কলেজ পাশ করা মেয়ের মতো দেখতে । কুহেলির চেহারার বাধন চিত্তাকর্ষক । অনেক লম্বা । হাসলে গালে টোল পড়ে । তাতে কুহেলিকে দেখতে বেশ লাগে । শীতল অবাক দৃষ্টিতে কুহেলির দিকে তাকিয়ে রইলো । শীতল কুহেলির উপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না ।
শীতলের তাকিয়ে থাকা দেখে কুহেলি চোখের ইশারায় বলল, “ঐভাবে তাকিয়ে কী দেখছো ?”
শীতল কোনোরকম রাখঢাক না করে বলেই ফেললো, “আজ তোকে দেখতে ভীষণ ভীষণ ভাল লাগছে ।“
শীতলের মুখে কুহেলি তার রূপের প্রশংসা শুনে আবেগে উৎফুল্ল । অন্যদিকে লজ্জায় কিছুটা আড়ষ্ঠ ! তবুও তার মনের ভিতর শীতলের মিষ্টি কথাগুলি তোলপাড় করছে, “তোকে ভীষণ সুন্দর লাগছে !”
(চলবে)