বাবলা নদীর কিনারা দিয়ে মাটির রাস্তা । নদীর পশ্চিম দিকে অর্থাৎ রাস্তা ঘেঁষে প্রকাণ্ড একটি বট গাছ । সেই বট গাছের নীচে স্কুটার রাখলো । তারপর নদীর খুব কাছাকাছি গিয়ে কুহেলি ও শীতল বসলো । নদীর কিনারে বসে নদীর জলের মৃদুমন্দ ঢেউয়ের দিকে দুজন তাকিয়ে । দুজনে চুপচাপ । অল্পবিস্তর বাতাস বইছে । সেই বাতাসে নদীর জলে মৃদুমন্দ ঢেউ । বৈকালিন পরিবেশটি তাদের কাছে মনোমুগ্ধকর । একজন পুরুষের সাথে ফাঁকা জায়গায় এইভাবে পাশাপাশি বসে থাকা কুহেলির জীবনে প্রথম । শীতল এখন পুরোপুরি যুবক । দুদিন পরে কলেজে ভর্তি হবে । অন্যদিকে কুহেলি একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হবে । তার শারীরিক স্থিতি দেখলে যে কেউ বলবে, কুহেলি পুরোপুরি বিয়ের উপযুক্ত । এইরূপ দুজন ছেলে-মেয়ে পাশাপাশি বসে বাবলা নদীর জলের দিকে তাকিয়ে । রাস্তা দিয়ে পথ চলতি মানুষ কৌতুহলি দৃষ্টিতে কুহেলি ও শীতলের দিকে তাকাতে তাকাতে নিজ গন্তব্যস্থানে ছুটছেন । সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে । কিছুক্ষণের মধ্যে সন্ধ্যা নামবে । তবুও তারা নির্বিকার । পাশাপাশি চুপচাপ বসে ভাবনার জগতে নিমজ্জিত । বাড়ি ফেরার হেলদোল নেই । কুহেলির একদম বাড়ি ফেরার তাড়া নেই । শীতলও তেমনি । শীতল মনেপ্রাণে চাইছে আরও দু-দণ্ড কুহেলির পাশে বসে থাকতে । কেননা তার জীবনেও এইভাবে বসে থাকার সুযোগ এই প্রথম । তাই কুহেলির উষ্ণ স্পর্শ শীতলের মনকে উতলা করে তুলছে । তার মনের গহন গাঙে রীতিমতো চলছে কুহেলিকে ভাললাগার ঝড় । ভালবাসার তৃষ্ণায় শীতল এখন তৃষ্ণার্ত । কুহেলি এই মুহূর্তে তার পাশ থেকে উঠে যাক, সেটা শীতল কিছুতেই চাইছে না । কলেজ জীবনে প্রবেশের আগে কুহেলির স্পর্শানুভূতিতে শীতল বিভোর ।
হঠাৎ চারিদিকে অন্ধকার । কুহেলি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে, কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেছে । যেকনো মুহূর্তে ঝড় উঠবে । আকাশের অবস্থা ভাল না । আকাশে মেঘের অবস্থা দেখে কুহেলির ধারণা, ঝড় ও বৃষ্টি দুটোই হওয়ার সম্ভাবনা ।
শীতল তখনও বা-হাতটা কুহেলির ডান হাতের উপর রেখে ভাবনার জগতে আবিষ্ট । যদিও এতক্ষণ কুহেলির হাতের ছোঁয়ায় শীতল তার শরীরে একটা অদ্ভূত ধরনের আনন্দে মোহিত হয়েছিল । অন্যদিকে শীতলের হাতের ছোঁয়ায় কুহেলিও এক চরম আনন্দানুভূতিতে আত্মহারা ছিল । আকাশের অবস্থা অবলোকন করে কুহেলি আর স্থির থাকতে পারলো না । বাধ্য হয়ে শীতলকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “আকাশের অবস্থা ভাল না । আকাশের দিকে তাকাও । মনে হচ্ছে শীঘ্র ঝড় উঠবে !”
কুহেলির ধাক্কায় ভাবনার জগত ছেড়ে শীতল স্বভাবিক ছন্দে ফিরলো । আকাশের অবস্থা দেখে শীতল চমকে উঠলো ! তাই তো, শীঘ্র ঝড় উঠবে । ঝড় বৃষ্টির আগে বাড়ি ফিরতে না পারলে হিতে বিপরীত হবে । বলা ভাল, কুহেলির স্পর্শের স্বাদ বিঃস্বাদ হয়ে তার জীবনে নানান অশান্তি সৃষ্টি হবে । বাড়িতে অহেতুক নানান কটু কথার সম্মুক্ষীণ হতে হবে । একেই কুহেলিকে শীতলদের বাড়িতে পছন্দ করে না । তার উপর ঝড় বৃষ্টির সময় দুজনের একসঙ্গে সময় কাটানো বাড়িতে ভালভাবে মেনে নেবে না । বরং শুরু হবে নানান অশান্তি । তাই তড়িঘড়ি স্কুটি স্টার্ট দিলো শীতল । স্কুটির সিটের পেছনে কুহেলি ।
নোনাই নদীর ব্রিজ পর্যন্ত যেতে-না-যেতেই ঝড় উঠলো । ঝড়ের দাপটে স্কুটি নিয়ে তারা এগোতে পারছে না । রাস্তা সুনসান ! লোক জনের চিহ্ন নেই । ব্রিজের উপর ওঠার মুখে পঞ্চায়েত থেকে তৈরী করা একটা বসার শেড । সেটা আবার ভাঙাচোরা । ছাদের টিন উধাও । সেখানে স্কুটি দাঁড় করালো । ঠিক সেই মুহূর্তে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি । শেডের এক কোনে দুজনে দাঁড়িয়ে । বৃষ্টির জলের ঝাপটায় দুজনে ভিজে একশা ! কুহেলিকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে শীতল কুহেলিকে কাছে টেনে নিয়ে দাঁড় করালো । কুহেলি তখন শীতলের আবদারে বাধা দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই । তাই শীতলের সমস্ত আবদারে সায় দিলো কুহেলি ।
বৃষ্টি থেমে গেছে !
চারিদিকে অন্ধকার । ব্রিজ পার হয়ে অনেকটা রাস্তা । বাড়ি ফেরার জন্য তারা ব্যাকুল ! বৃষ্টির ঠাণ্ডা জলে ভিজে কুহেলির শরীর শীতে কাঁপছে । ভেজা অবস্থায় দুজন স্কুটিতে পুনরায় উঠলো । স্টার্ট দিলো স্কুটি । বৃষ্টিতে ভেজার জন্য স্কুটি হাতে স্টার্ট নিচ্ছিলো না । শেষে পায়ে কিক্ দিয়ে শীতল স্কুটি স্টার্ট দিলো । কুহেলিকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে শীতল বাড়ি ফিরলো ।
বাড়িতে সানাই ও পান্তা মাসি । পান্তা মাসি আড় চোখে কুহেলির শরীরের দিকে বিশ্রিভাবে তাকালো । কুহেলির মনে হলো, শীতলের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে সে খুব বড় পাপ কাজ করে ফেলেছে । অন্যদিকে সানাই ছুটে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্না ভেজা গলায় বলল, “এতক্ষণ তোর জন্য টেনশনে আমি ঘামছিলাম । তুই বাড়িতে ফেরায় আমি শান্তি পেলাম । তুই শিগগির ঘরে গিয়ে জামা কাপড় পাল্টিয়ে আয় ।“
ঐদিকে পান্তা মাসি তড়পাচ্ছে । পান্তা মাসি সানাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেই চলেছে, “মেয়েটাকে এখন থেকে সাবধান করতে না পারলে শীঘ্র গোল্লায় যাবে । শীতলের সঙ্গে মেলামেশা আমার একদম ভাল লাগছে না । আপনি মেয়েটাকে বোঝান । নতুবা শীতল মেয়েটার অনেক ক্ষতি করে ফেলবে ।“
সানাই যত বোঝাতে চাইছে, “মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ঢুকলো । জামা কাপড় ছাড়ুক । আগে কুহেলি স্বাভাবিক হোক । তারপর এসব কথা বলা যাবে । এইসব কথা শুনলে মেয়েটা কষ্ট পাবে ।“ সানাই মেয়েটাকে কোনোভাবে কষ্ট দিতে নারাজ । কিন্তু পান্তা মাসি সমানে বকবক করেই যাচ্ছে ।
স্নানের ঘর থেকে বেরিয়ে কুহেলি সানাইকে বলল, “বাবা, এক কাপ চা বসাও । গরম গরম চা খেলে ঠাণ্ডাটা কমবে ।“
আমি চা বানাতে যাচ্ছি মা ।
“আপনি যাবেন কেন ? আমি বাড়িতে রয়েছি, সুতরাং আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি ।“ পান্তা মাসি সানাইকে রান্না ঘরে যেতে বাধা দিয়ে বলল ।
“না পান্তা মাসি । তোমাকে চা বানাতে হবে না । আজ চা বানাতে বাবা যাক । কেননা বাবা আদা দিয়ে সুন্দর চা বানায় ।“ কুহেলি উল্টে পান্তা মাসিকে চা বানাতে বাধা দিলো ।
ভুল বুঝলো পান্তা মাসি । তাই সানাইকে বলল, “আপনার গুণধর মেয়ে এখন আমার হাতের বানানো চা খাবে না । সবটাই আমার কপাল । আপনাকে আগেও বলেছি এখনও বলছি, এই মেয়ে আপনার কপাল পুড়াবে ।“
পান্তা মাসির কথাগুলি কুহেলির ভাল লাগলো না । সে এখন বড় হয়েছে । তার নিজস্ব বোধবুদ্ধি হয়েছে । তা ছাড়া এই মুহূর্তে সে খুব ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত । তাই পান্তা মাসিকে শুনিয়ে বলল, “তুমি আমাকে ওসব কথা কেন বলছো ? আমি বাবার কাছে বায়না ধরেছি, বাবা আমার চা বানিয়ে দেবে । আর তা ছাড়া…………!”
পান্তা মাসি প্রতি উত্তরে জানতে চাইল, “আর তা ছাড়া………?”
আর তা ছাড়া তুমি আমাদের বাড়ির কে ? যার উপর ভিত্তি করে তুমি তড়পাচ্ছো !”
কেদে দিলো পান্তা মাসি । কাদতে কাদতে পান্তা মাসি সানাইকে বলল, “তোমার মেয়ে এখন বাড়ির সর্বময় কর্ত্রী ! সুতরাং মেয়েকে আপনার কিছু বলার ক্ষমতা নেই । বরং আপনি এখন মেয়ের দাসানুদাস !”
সানাই কোন্দিকে হেলবে বুঝতে পারছে না । সানাই জানে, পান্তা মাসি ধীরে ধীরে তার হৃদমাঝারে অনেকখানি জায়গা দখল করে নিয়েছে । তাই পান্তা মাসির কথা ফেলাটাও কঠিন ! অন্যদিকে মেয়েও তার একমাত্র অবলম্বন । তাকেও এড়াতে পারছে না । দুইজনের মাঝে নিরুপায় হয়ে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো ।
ঘরে ঢুকে পান্তা মাসি চা বানাতে শুরু করলো । তারপর চা নিয়ে কুহেলিকে যখন দিতে গেলো, কুহেলি রাগে চায়ের কাপ পান্তা মাসির হাত থেকে ঘরের মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিলো ।
সেটা দেখে সানাই রেগে গিয়ে ঠাস্ করে কুহেলির গালে জোরে থাপ্পড় ।
রাগে অভিমানে কুহেলি ঘরের দরজা বন্ধ করে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো ।
রাত বাড়ছে । কুহেলি দরজা খুলছে না । ইতিমধ্যে পান্তা মাসি রাতে খিচুড়ি রান্না করেছে । খিচুড়ি রান্নার একটাই যুক্তি, বৃষ্টি নেমেছে । ঠাণ্ডা আবহাওয়া । সুতরাং খিচুড়ি ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় মানাসই ।
কুহেলির ফোন বেজে উঠলো, “হ্যালো ! তুমি কী করছো ?”
শীতলের ফোন পেয়ে কুহেলি কেঁদে দিলো, “ঘরে শুয়ে আছি । তোমার সাথে ঘুরতে গিয়ে যতো অশান্তি ! অশান্তির মধ্যমণি পান্তা মাসি । বাবা অতটা কিছু বলেননি । কিন্তু পান্তা মাসির সেই এক কথা, শীতল বড় লোকের ছেলে । তার সাথে মিশলে আখেরে কুহেলির সমূহ বিপদ !”
অন্যদিকে শীতলদের বাড়িতে কুহেলিকে নিয়ে বিশাল হুলস্থুল । শীতল বাড়ির ঘটনাটা কুহেলিকে শোনাতে শুরু করলো, “বাবা-মা কিছুতেই তোর সাথে মিশতে দিতে চাইছেন না ।“
“কিন্তু কেন ?” উতলা হয়ে কুহেলি জিজ্ঞাসা করলো ।
তাঁদের বক্তব্য, “কুহেলি নীচ সম্প্রদায়ের মেয়ে । তা ছাড়া ওদের পূর্ব-পুরুষ ছিল ঝাড়খণ্ডে । জাতের ঠিক নেই । কুহেলি সাঁওতাল নাকি অন্য সম্প্রদায়ভুক্ত ? সেটাই প্রশ্ন চিহ্নের মধ্যে ? তাই এই মেয়ের সাথে শীতলকে মেলামেশা বন্ধ করতে হবে । কীরকম দুঃসাহস মেয়েটার । সেদিনকার মেয়ে, শীতলকে পটিয়ে তার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া ! আস্পর্ধা কম নয় । মেয়েটার বাবাকেও জানিয়ে রাখতে হবে, যাতে কুহেলি শীতলের সঙ্গে না-মেশে ।“
কুহেলি পাল্টা প্রশ্ন করলো, “উত্তরে তুমি কী বললে ?”
“আমি নীরব রইলাম । বাড়িতে একদণ্ড ভাল লাগছে না । সবাই মিলে আমাকে তোর বিরূদ্ধে নানান অভব্য কথা শোনাচ্ছে, যেটা আমার কাছে খুবই বিড়ম্বনার !”
কুহেলি আর কথা না বাড়িয়ে ফোনের লাইনটা কেটে দিলো । শীতলদের বাড়ির কচকচলানি শুনতে কুহেলির একদম ভাল লাগছিল না । তার উপর তাদের জাত নিয়ে অবান্তর কথাবার্তা । ঈশ্বরের অশেষ করুনায় তার জন্ম । জন্ম ও মৃত্যুতে তার কোনো হাত নেই । ঘটনাচক্রে তার সাঁওতাল সম্প্রদায়ে জন্ম । অথচ সমস্ত মানুষের শরীরের অংশ বেলেট দিয়ে কাটলে রক্ত বের হবে এবং সেই রক্তের রঙ লাল ! দেশের সমস্ত স্তরের মানুষের রক্ত লাল হলে, সমাজ ব্যবস্থায় এত ভেদাভেদ কেন ? জাতপাত নিয়ে এত সোরগোল কেন ? এটাই কুহেলির মাথায় ঢুকছে না ! তার মতে, সমস্ত মানুষের একটাই জাত হওয়া উচিত, সেটা হচ্ছে মনুষ্যজাতি বা মানবজাতি !
বাবার ডাকে ঘর থেকে বের হলো, কিন্তু রাত্রিবেলায় খিচুড়ি না খেয়ে শুয়ে পড়লো । কুহেলির শুয়ে পড়া ভালভাবে নিলো না পান্তা মাসি । পান্তা মাসি সানাইয়ের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করতে লাগলো । এমনভাবে কানের কাছে পান্তা মাসি কুহেলির বিরূদ্ধে সানাইয়ের কান ভারী করছে তাতে কুহেলির দেখে মনে হয় পান্তা মাসি সানাইয়ের বিবাহিত স্ত্রী ।
তারপর………………?
তারপর বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো । মাধ্যমিক রেজাল্ট বের হলো । কুহেলির স্টার মার্ক । সানাই মেয়ের রেজাল্ট দেখে খুব খুশী । তার বারবার মনে হচ্ছে কুহেলির মা বেঁচে থাকলে সে ভীষণ খুশী হতো । পান্তা মাসি শুধুমাত্র জানে, পরীক্ষায় পাশ । স্টার মার্ক সম্বন্ধে তার কোনো ধারণা নেই । তাই পান্তা মাসির কাছে কুহেলি শুধুমাত্র মেট্রিক পাশ করেছে । তাতে তার কোনো তাপ-উত্তাপ বা আনন্দ নেই ।
পান্তা মাসি ইতিমধ্যে সানাইয়ের জীবনে অনেকখানি জায়গা করে নিয়েছে । ইতিমধ্যে বার কয়েক সানাইকে বলা হয়ে গেছে, পান্তা মাসিকে যোগ্য মর্যাদা দেওয়ার জন্য । কিন্তু সানাই আমতা আমতা করছে । তার মনে এখনও দ্বিধা ! কেননা সে মেয়েকে খুব ভয় পায় । পান্তা মাসির জন্য মেয়েটা বিগড়ে গেলে মেয়েকে নিয়ে তার আশার জলাঞ্জলি । সানাই চায়, তার মেয়ে পড়াশুনা করে শিক্ষিত হোক । মানুষের মতো মানুষ হোক । তাই পান্তা মাসির ঘ্যানঘ্যানানিতে কর্ণপাত করছে না সানাই ।
( চলবে )