পূর্ব মেদিনীপুর, নিজস্ব সংবাদদাতা:- পুরি, মাহেশের পর পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদলের প্রাচীন রথের নাম রয়ে। সেই রথে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটে।ভিড় এড়াতে পুলিশের উদ্যোগে “গাউড ম্যাপ” তৈরি করা হয়েছে। যা রথ উৎসবে পৌঁছাতে সাহায্য করবে। ২০২৩ সালে ২০ জুন (বাংলার ৪ আষাঢ়১৪৩০ ) মঙ্গলবার মহিষাদলের জগন্নাথদেবের “রথযাত্রা “। লক্ষাধিক ভক্তদের উপস্থিতিতে সমারোহে পালিত হবে রথযাত্রা । প্রথা মেনে রথের রশিতে হাত ছোঁয়াতে হ পুণ্যার্থীরা জড়ো হন মহিষাদলে । মহিষাদল রাজ পরিবারের বর্তমান সদস্য রাজবাড়ী থেকে পালকিতে চড়ে রাজা হরপ্রসাদ গর্গ আসেন রাজাবাহাদুরের রূপার বর্শাধারী দেহরক্ষী মাথার উপর রাজছত্র ধরে । পালকি থেকে নামার আগেই ডঙ্কা বাজিয়ে ঘোষণা করা হয় রাজা মশাইয়ের আগমন বার্তা। তিনিই রীতি-নীতি মেনে পালন করেন সূচনার মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। এবং প্রথা মেনে রথের রশিতে হাত ছোঁয়াবেন। তোপধ্বনি দিয়ে শুরু হয় রথের যাত্রা। তারপরেই উপস্থিত পুন্যার্থীরা রথ টানা শুরু করেন । গড় গড় করে এগিয়ে চলে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই রথ । মহিষাদল শহীদ বেদী থেকে দেড় কিলোমিটার রাস্তা পের হয়ে গুন্ডিচাবাটি পৌঁছায় রথ। রথযাত্রার উপলক্ষে বসে বিশাল মেলা । এই মেলায় সব থেকে বেশি বিক্রি হয় কাঁঠাল। সার দিয়ে বসে কাঁঠাল ,বেতের সামগ্রী, জিলিপি , পাঁপড় , তেলেভাজার দোকান । আর বসে প্রচুর সুগন্ধির দোকান । পাশাপাশি মেলায় যেমন মাছ ধরার জাল ও বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি হয়। তেমনি বিক্রি হয় কৃষি কাজের সহযোগী বিভিন্ন জিনিসপত্র। মেচেদা-হলদিয়া সড়ক পথে মহিষাদল । হলদিয়া যাওয়ার নতুন বাসস্ট্যান্ড বা মেচেদা যাওয়ার পুরানো বাজার বাসস্ট্যান্ডে নেমে ১০ মিনিট হাঁটলেই রথের মাঠ বা সড়ক। রথ যাত্রার আগের দিন “লেদ উৎসব “বা ” নেত্র উৎসব” নামে বিশেষ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এই উৎসব হল রথের রশির বাঁধন প্রক্রিয়া। রথযাত্রার আগে রাজ পরিবারের সদস্য রথের রশি বেঁধে রথযাত্রার উদ্বোধন করেন । রথ টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য চারটি রশি থাকে ।এর মধ্যে একটি রশি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। সারা বছর এই রথ দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন এখানকার রাজ পরিবার। তবে বর্তমানে রথ উৎসবের দিনগুলিতে মেলা ও তার আনুসঙ্গিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সমস্ত খরচ ও পরিচালনার দায়িত্ব বহন করে স্থানীয় মহিষাদল পঞ্চায়েত সমিতি। মহিষাদলের প্রাচীন রথয়াত্রায় ভিড় এড়াতে মহিষাদল থানার উদ্যোগে ” গাইড ম্যাপ” তৈরি করা হয়েছে। সেই ম্যাপে পথ নির্দেশিকা থেকে কোথায় কোথায় রাস্তা বন্ধ, কোন পথ দিয়ে হাটবেন সেই সমস্ত যেমন রয়েছে তেমন স্থানীয় পুলিশ, প্রশাসন,স্বাস্থ্য দপ্তরের আধিকারিকদের ফোন নম্বর দেওয়া রয়েছে। মহিষাদল থানার ওসি প্রলয় চন্দ্র জানান, মহিষাদলের প্রাচীন রথের মেলায় বহু মানুষের সমাগম ঘটে। তাদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে আমরা ” গাইড ম্যাপ” তৈরি করেছি। ব্লক এলাকার বিভিন্ন জায়গায় ” গাইড ম্যাপ” ডিসপ্লে করা হবে। “গাইড ম্যাপ” এর পাশাপাশি এলাকা জুড়ে সিসিটিভি লাগানো থাকছে, ড্রোন এর সাহায্যে নজদারি, পুলিশ হেল্প ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ্রামীণ মেলার কথা উঠলেই আজ বাঙালির চোখে যে ছবি ভেসে ওঠে তা হল রথের মেলা। যদিও গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে বহু দিন আগেই তা স্থান করে নিয়েছে শহরে –বাজারে। তাই রথ আর মেলা যেন সমার্থক বাঙালি জীবনে। আষাঢ়ের শুক্লা-দ্বিতীয়া তিথিতে বাংলার নানা প্রান্তের মানুষ এ মেলাকে কেন্দ্র করে মেতে ওঠে । রথযাত্রার ইতিহাস বেশ প্রাচীন হলেও পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদলের রথের মেলা ২৪৭ বছরের পুরনো।
মহিষাদলের জমিদার বংশের রাজা আনন্দলালের স্ত্রী রানি জানকীর উৎসাহে ১৭৭৬ সালে রথযাত্রার শুরু হয়। সেই থেকে অনুষ্ঠিত রথের মেলা পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বড় এবং পূর্ব মেদিনীপুরের সব থেকে বড় মেলা হিসেবে পরিচিত। আগে ১৫ দিনের মেলা হত বর্তমানে একমাসের মেলা।মেলায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে।
এক সময় মেলাকে কেন্দ্র করে আসর বসত পালাগান, কীর্তনের। মৃৎশিল্পের প্রদর্শনীও হত। কলকাতা থেকে আসত যাত্রা। সময়ের সঙ্গে জৌলুষ হারিয়েছে মেলার সংস্কৃতির আসর। মাসির বাড়িতে এখন ছোট করে আসর বসে স্থানীয় শিল্পীদের নিয়েই। আছে সার্কাস, ম্যাজিকের জায়গায় মোটর সাইকেলের মরণ ঝাঁপ। এ মেলার এখনও প্রধান আকর্ষণ সবং-এর মাদুর। ৫০ থেকে ৫০০ টাকার মাদুর পাওয়া যায় এই মেলায়। থাকে মাটির পুতুল, খেলনা, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের তৈরি ফুলদানি, নাইটল্যাম্প। এ ছাড়া গ্রামীণ জীবনের প্রয়োজন মেটানোর নানা উপকরণ। থাকে ফুল-ফল গাছের চারা। বিক্রি হয় প্রচুর ফল। মেলার অন্যতম আকর্ষণ নানাজাতের পাখির বাজার, বিশেষত পায়রা। দেশি পাখি কেনাবেচা সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা ঝুলিয়ে বিক্রি হয় রকমারি লাভ বার্ড ও বিদেশি পাখি।
এবছর রথ উৎসবের মধ্যে পঞ্চায়েত পঞ্চায়েত নির্বাচন পড়েছে। এদিকে পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে মাতোয়ারা রাজনৈতিক মহল অন্যদিকে রথ উৎসব নিয়ে মাতোয়ারা সাধারণ মানুষ।
মহিষাদলের বিধায়ক তিলককুমার চক্রবর্তী জানান, পূর্বের রীতি মেনেই মহিষাদলের প্রাচীন রথ উৎসব পালন করা হবে।পঞ্চায়েত ভোটের কারনে রথের জৌলুশ যাতে কোন ভাবে কম না হয় সেদিকে আমাদের নজর থাকবে। মহিষাদল রাজ পরিবারের বর্তমান সদস্য হরপ্রসাদ গর্গ জানান, প্রাচীন রীতিনীতি মেনে আজ থেকে “লেদ উৎসব “বা ” নেত্র উৎসব” এর মধ্যদিয়ে রথের শুভ সূচনা হয়।