ভূমিকা:-
তিনি ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম মহিলা গুপ্তচর, আজাদ হিন্দ ফৌজের ঝাঁসি রেজিমেন্টের নেতৃত্বে ছিলেন লক্ষী সেহেগল। দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভুত মহিলা স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে ১৯৪৩ সালে গড়ে উঠেছিল এই রেজিমেন্ট। ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল ব্যাংকক, রেঙ্গুন ও সিঙ্গাপুর।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন বাঁচাতে নিজের স্বামীকে হত্যা —
নীরা আর্য আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টের সৈনিক ছিলেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন বাঁচাতে তিনি নিজের স্বামীকে হত্যা করেন। নেতাজী তাঁকে নীরা নাগিনী বলে অভিহিত করলে তিনি নীরা নাগিনী নামে পরিচিতি লাভ করেন। বৃটিশ সরকার তাঁকে একজন গুপ্তচর হিসাবে গণ্য করেছিল। তার ভাই বসন্ত কুমারও আজাদ হিন্দ ফৌজে ছিলেন।
প্রখর বুদ্ধিমত্তা, সাহসী ও আত্মসম্মান বোধ–
অনেক লোকশিল্পী নীরা নাগিন ও তার ভাই বসন্ত কুমারের জীবন নিয়ে কবিতা ও ভজন রচনা করেছেন। নীরা নাগিনী নামে তার জীবনের একটি মহাকাব্যও রয়েছে। তার জীবন নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তিনি ছিলেন এক দুর্দান্ত দেশপ্রেমিক, সাহসী ও আত্মসম্মান বোধে গর্বিত মহিলা। তার শেষ জীবন কাটে হায়দ্রাবাদে। সেখানকার মহিলারা তাকে গর্বের সাথে ‘পদ্মমা’ বলে সম্বোধন করতেন।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন—-
নীরা আর্য ১৯০২ সালের ৫ মার্চ ভারতের তৎকালীন যুক্তপ্রদেশের অধুনা উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বাগপত জেলার খেকড়া শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা শেঠ ছজুমল ছিলেন সে সময়ের এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তার ব্যবসা-বাণিজ্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার পিতার ব্যবসায়ের মূল কেন্দ্র ছিল কলকাতা। তাই কলকাতাতে তার পড়াশোনা শুরু হয়েছিল। নীরা আর্য হিন্দি, ইংরেজি, বাংলার পাশাপাশি আরও অনেক ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তিনি ব্রিটিশ ভারতের সিআইডি ইন্সপেক্টর শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসকে বিবাহ করেন। শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস ছিলেন ইংরেজপ্রভু ভক্ত অফিসার। মূলতঃ শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসকে গুপ্তচরবৃত্তি করে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে হত্যা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ—–
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন বাঁচাতে তিনি ইংরেজ সেনাবাহিনীর পদস্থ অফিসার শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসকে হত্যা করেছিলেন। একসময় সুযোগ পেয়ে শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস নেতাজিকে হত্যার জন্য গুলি চালিয়েছিলেন, কিন্তু সেই গুলি নেতাজির গাড়ীর চালককে বিদ্ধ করে । কিন্তু এরই মধ্যে নীরা আর্য শ্রীকান্ত জয়রঞ্জনের পেটে বেয়নেট চালিয়ে হত্যা করে। শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস নীরা আর্যের স্বামী ছিলেন, তাই স্বামী হত্যার কারণে নেতাজি তাঁকে নাগিনী বলে অভিহিত করেছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ আত্মসমর্পণের পরে, সমস্ত বন্দী সৈন্যকে দিল্লির লাল কেল্লায় বিচারে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু নীরাকে স্বামী হত্যার কারণে দ্বীপান্তরের সাজা দেওয়া হয়েছিল। জেলে বন্দীদশায় সেখানে তাঁকে কঠোর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল।
আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম গুপ্তচর—–
নীরা আর্য আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম গুপ্তচর হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। পবিত্র মোহন রায় আজাদ ভারতীয় সেনাবাহিনীর মহিলা এবং পুরুষ উভয় গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু নিজেই নীরাকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তার সঙ্গী মনবতী আর্য, সরস্বতী রাজামণি এবং দুর্গা মল্লা গোর্খা এবং যুবক ড্যানিয়েল কালে তার সামরিক গোয়েন্দা শাখার সাথে যুক্ত ছিল। তারা নেতাজির জন্য গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করত। তারা বিভিন্ন কাজের অছিলায় ব্রিটিশ অফিসারদের বাড়ি ও সেনাশিবিরে প্রবেশ করতেন তথ্য সংগ্রহের জন্য, তারপর তা নেতাজীর কাছে পাঠাতেন। এই কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়লে প্রথমে নথিগুলি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া ও পরে পিস্তল চালিয়ে আত্মহত্যা করতে হবে, এই নিয়ম তারা কঠোর ভাবে মেনে চলতেন।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে নীরাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড–
দক্ষিণ এশিয়ার অক্ষশক্তির পরাজয়ের পর ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ। ধরা পড়েছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের হাজার হাজার সেনানী। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে লালকেল্লায় তাদের বিচার শুরু হয়, বেশির ভাগ সেনানী ছাড়া পেলেও নীরাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়, জাহাজে করে পাঠানো হয় আন্দামানের সেলুলার জেলে। সেখানে তার ওপর যে অমানুষিক অত্যাচার হয়েছিল তা সত্যিই ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
আন্দামানে নীরাকে রাখা হয়েছিল একটি ছোট কুঠরিতে, সেখানে বাকি বন্দিরা ছিল মুক্ত, কিন্তু নীরাকে বন্য জন্তুর মত প্রথমদিন বেঁধে রাখা হয়েছিল। গলায় বাঁধা ছিল চেন ও হাতে-পায়ে ছিল শেকল লাগানো বেড়ি। নীরাকে কিছু খেতে দেওয়া হয়নি প্রথম দিন। শোয়ার জন্য মাদুর কিংবা কম্বল কিছুই দেওয়া হয়নি প্রথমে। কুঠরির কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলেন পরিশ্রান্ত নীরা। মাঝরাতে এক প্রহরী কুঠরিতে ঢুকে গায়ের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছিল দুটো কম্বল। সকাল বেলায় প্রথম জুটেছিল খাবার, খেতে দেওয়া হয়েছিল ফুটন্ত খিচুড়ি।
এরপরেও আরও অনেক পাশবিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে নীরাকে। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। তবুও মনে মনে স্বপ্ন দেখতেন স্বাধীন ভারতে সূর্যোদয় দেখবেন। এই মহান ত্যাগের সম্মান দেয়নি দেশ। নীরা আন্দামানে আসার একবছর পর স্বাধীন হয়েছিল দেশ। মুক্তি পেয়েছিলেন নীরা। এই আত্মত্যাগের সম্মান দেয়নি দেশ। অভিমানে সাধারণের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন অসাধারণ নীরা।
স্বাধীনতা পরবর্তী জীবন–
স্বাধীনতার পরে, তিনি ফুল বিক্রি করে জীবনযাপন করেছিলেন, তবে কোনও সরকারী সহায়তা বা পেনশন গ্রহণ করেননি। তার ভাই বসন্ত কুমারও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পর সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। নীরা স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ভূমিকা নিয়ে আত্মজীবনীও লিখেছেন। উর্দু লেখক ফারহানা তাজ’কে তিনি তার জীবনের অনেক ঘটনা শুনিয়েছিলেন। তিনি তার জীবন নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে একটি উপন্যাসও রচনা করেন।
সম্মাননা—
নীরা আর্য নামে একটি জাতীয় পুরষ্কারও চালু করা হয়েছে। ছত্তিশগড়ের অভিনেতা অখিলেশ পান্ডে প্রথম নীরা আর্য পুরষ্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবং তাঁকে নীরা আর্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
জীবনাবসান—
শেষ জীবনে তিনি তিনি দরিদ্র, অসহায়, নিঃস্ব হয়ে পরেছিলেন। হায়দরাবাদের ফালকনুমার একটি কুঁড়ে ঘরে বাস করতেন। নীরা আর্য জীবনের শেষ দিনগুলিতে ফুল বিক্রি করে কাটিয়েছেন এবং সরকারি জমিতে থাকার কারণে তার কুঁড়েঘরটিও শেষ মুহুর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সকলের অলক্ষ্যে ১৯৯৮ সালের ২৬শে জুলাই উসমানিয়া হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছিলেন ৯৬ বছরের বীরাঙ্গনা এক অগ্নিকন্যা নীরা আর্য্য।
।।তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট ও উইকিপিডিয়া।।