দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস,দ্বাদশ পর্ব) : দিলীপ রায়।

0
396

“কি হলো নাতনী । আমার চা দাও !”
গুণধর দাদুর ডাকে কুহেলির হুঁশ ফিরলো । প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তরে কুহেলি বলল, “দাদু“ চা আনছি ।“ তারপর মাটির দুটি চায়ের ভাঁড়ের মধ্যে একটি ভাঁড় গুণধর দাদুর দিকে এগিয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলো, “আজ কী ধরনের বিস্কুট দেবো ?”
না নাতনী, আজ বিস্কুটের পরিবর্তে আমাকে একখানা পাউরুটি দাও । পাউরুটি দিয়ে চা খাবো ।
তারপর কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে গুণধর দাদু জিজ্ঞাসা করলো, “যুবক ছেলেটি কী তোমার পূর্ব-পরিচিত ?”
না দাদু । চা খেতে দোকানে ঢুকেছিলো ।
উহুঁ নাতনী । ছেলেটির সাথে নিশ্চয় তোমার কোনো সম্পর্ক আছে ! নতুবা তার জন্য তুমি অতোটা উতলা কেন ?
কোথায় উতলা হলাম !
নাতনী, আমি ঠিক বুঝতে পারি । ছেলেটির প্রতি তোমার টান দেখে আমি নিশ্চিত, যুবক ছেলেটি তোমার একান্ত আপনজন…… ?
কি যে বলো দাদু । সে নিছক একজন খরিদ্দার ।
খরিদ্দার হলে কী হবে ? ছেলেটিকে আমি চিনি । খুব ভাল ছেলে । সাহাপুর গ্রামের নীলকন্ঠের ছেলে । নীলকন্ঠের সাইকেল, ভ্যান-রিক্সা সারানোর দোকান । আমলাই বাজারে খুব চালু দোকান । নীলকন্ঠের গিন্নি ভ্যানে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে সব্জি বিক্রি করে । নীলকন্ঠের বৌটা একটু-আধটু লেখাপড়া জানে । দুজনের উপায়ে তাদের সুখী সংসার । কিন্তু নীলকন্ঠের একটাই ছেলে । ছেলেটি চাকরি না পাওয়ায় তাদের মন খারাপ । তারা চায় না, তাদের ছেলে সাইকেল সারানোর মতো ব্যবসায়ে নামুক । ছেলেটির পড়াশুনা খুব বেশী না । তবে চাকরির চেষ্টা অনেকদিন থেকে । তবে ছেলেটির পুলিশের চাকরির প্রতি বেশী ঝোঁক ! আজ সম্ভবত পুলিশের চাকরির পরীক্ষা দিতে কান্দি গেলো ।
দাদু, তুমি তো ছেলেটির হাঁড়ির খবর পর্যন্ত জানো । তবে ছেলেটির নাম কী ?
নামটা আমার মনে নেই । তবে ছেলেটি খাসা ! গাজা-মদ-বিড়ি-সিগারেট কিচ্ছু খায় না । গাঁয়ের মানুষ সকলেই তাকে ভালবাসে ।
তারপর কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল, “নাতনী এবার আমি চলি ।“
গুণধর দাদু চলে যাওয়ার পর দোকানে বেশ কয়েকজন খরিদ্দারের ভিড় । তাদের চা-জল খাবার দরকার । ব্যস্ত হয়ে পড়লো কুহেলি । কাজের ব্যতিব্যস্ততায় নিমেষের মধ্যে যুবক ছেলেটির কথা কুহেলির অন্তর থেকে আউট ! সেই মুহূর্তে খরিদ্দারদের চাহিদা মেটাতে কুহেলি হিমসিম । উনুন থেকে এক কড়াই ঘুগনি নামলো । ঘুগনি সুস্বাদু হওয়ার কারণে খরিদ্দাদের ভিড় । ঘুগনি উত্তম স্বাদযুক্ত বানানোর জন্য কুহেলির অনলস খাটুনি । ইদানীং ঘুগনিতে পনিরের ছোট ছোট টুকরো মেশায় । ঘরে তৈরী করা নিজের মশলাটা ব্যবহার করে । যার জন্য স্বাদ খুব ভাল হয় । চারজন টোটোওয়ালা অপেক্ষা করছে পাউরুটি ঘুগনি খাওয়ার জন্য । তাদের খাবার দিয়ে উনুনে চা বসালো । কুহেলির একটাই নীতি, সেটা হচ্ছে কখনই চা বানিয়ে চায়ের কেটলিতে রেখে পরের খরিদ্দারদের দেবে না । খরিদ্দারেরা যখন চাইবেন ঠিক সেই মুহূর্তে চা বানিয়ে খরিদ্দারদের পরিবেশন করবে । তাতে দু-কাপ হোক, বা চার কাপ হোক । খরিদ্দারদের প্রয়োজন মতো কুহেলি চা বানাতে অভ্যস্ত । তা ছাড়া চা তৈরীর রসায়ন কুহেলির একেবারে নিজস্ব । ফলে তার দোকানের চায়ের গুণগত মান তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট ভাল । এছাড়া এলাকার সকলেই জানে, খাবারের প্রতি কুহেলি যথেষ্ট যত্নশীল ।


তারপর অনেকদিন কেটে গেলো । খরিদ্দারদের নিয়ে কুহেলির ব্যস্ততা বেড়েছে, তো কমেনি । সেদিন রবিবার । দুপুরে প্রয়োজন ছাড়া কুহেলি কখনই খাওয়ার জন্য বাড়ি ছোটে না । তবে তুলনামূলকভাবে দুপুরে খরিদ্দারের ভিড় কম । সেই সময় টোটোওয়ালা, অটোওয়ালা, রিক্সাওয়ালা, ছোট ছোট দোকানদার দুপুরের খাবার খেতে বাড়িতে ছোটে । তাই দুপুরটাতে বেচাকেনা হাল্কা । দুপুরে মসুরির ডাল সেদ্ধ ও বাটা মাছের ঝাল বানিয়েছে । সাধারণত দুপুরে সেদ্ধ ভাত খেতে অভ্যস্ত কুহেলি । তবে মাছ না থাকলে ডিম সেদ্ধ অথবা অন্তত ডিমের ওমলেট থাকে । আজ নকুল কাকু লোকাল বাটা মাছ কেটে সুন্দরভাবে ড্রেসিং করে কুহেলিকে পৌঁছে দিয়ে বলে গেছেন, “মাছের ঝাল বানিয়ে খেতে ।“ কাঁচা হাতে মাছের ঝাল বানানো । তাই তার একরাশ চিন্তা, বাটা মাছের যে ঝালটা সে বানিয়েছে সেটা খেতে পারবে কিনা ? থালায় গরম ভাত ও মসুরির ডাল সেদ্ধ ও একটা বাটিতে মাছের ঝাল । তারপর খরিদ্দারদের জায়গায় থালা নিয়ে খেতে বসলো কুহেলি । খেতে বসে তাকিয়ে দেখে , খাওয়ার জল নিয়ে বসেনি । ইতিপূর্বে তার বাবা খাওয়ার সময় জলের গ্লাস দেখতে না পেলে, তিনিই ছুটে জল নিয়ে বসতেন । তাঁর একটা কথা আজও কুহেলির কানে বাজে, “খাওয়ার সময় অবশ্যই জল নিয়ে বসা চাই । নতুবা কোনো কারণে খাবার গলায় আটকে গেলে সেক্ষেত্রে জল না খেলে বিপদের আশঙ্কা !” তাই খাওয়ার সময় কুহেলি জলের গ্লাস বা জলের বোতল পাশে রাখবেই । আজও তার ব্যতিক্রম হলো না । খাওয়ার জলের বোতল সঙ্গে নিয়ে খেতে বসলো ।
ডাল সেদ্ধ দিয়ে খাওয়ার পর বাটা মাছের ঝাল কেবলমাত্র মুখে দিয়েছে, ঠিক সেই সময় সাহাপুরের সেই যুবক ছেলেটি কুহেলির চায়ের দোকানে উপস্থিত । তারপর একগাল হাসি দিয়ে কুহেলির উদ্দেশে বলল, “সেইদিনের অর্ডারের চায়ের দাম মেটাতে এলাম ।“ আপনি খেয়ে নিন, তারপর কথা হবে ।
দোকানের চেয়ারের দিকে ইশারা করে কুহেলি বলল, আপনি একটু বসুন প্লীজ । খাওয়ার পরে আপনার সঙ্গে কথা বলছি ।
যুবক ছেলেটি চুপ থাকার পাত্র নয় । কুহেলির সাথে অনর্গল অযথা বকবক করতে শুরু করলো ।
প্রথমেই জিজ্ঞাসা, “বাড়ি থেকে কী রোজ খাবার দিয়ে যায়, নাকি আপনি বাড়ি না যেতে পারলে খাবার আসে ?” প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আবার প্রশ্ন, “কাঞ্চন নগরের মোড় থেকে আপনার বাড়ি কতোদূর ?”
কুহেলি নীরব ! মনে মনে ভাবছে, কলির কেষ্ট এসেছেন । কুহেলি সম্বন্ধে তার কৌতুহলের শেষ নেই । অথচ এখনও তার নাম অজানা ।
হাত মুখ ধুয়ে আর একটা চেয়ার নিয়ে কুহেলি বসলো ।
“আপনার শুভ নামটাই জানা হলো না ?”
যুবক ছেলেটি তখন হাসিমুখে বলল,”আমি জগন্নাথ, তবে গ্রামে বেশীর ভাগ মানুষ জগা নামে ডাকে ।“
আমি আপনাকে জগাদা বলে ডাকবো ।
আমার জগা নামে ডাকটা ভাল লাগে ।
অপরিচিত মানুষের মুখে জগা নামটা শুনতে কী আপনার ভাল লাগবে ?
আপনি অপরিচিত কেন বলছেন ? সেদিন আপনার দোকান ঘুরে গেলাম । ভাবলাম, দুপুরে দোকানে খরিদ্দার কম থাকবে । তাই এই সময়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসা । আর তা ছাড়া …………
আর তা ছাড়া কী ?
তা ছাড়া সেদিন বলে গিয়েছিলাম, “পরে আপনার দোকানে আসবো ।“
সব ঠিক আছে, কিন্তু জগা নামে ডাকাটা আমার স্মরণে লাগছে !
কী আশ্চর্য ! আমি আপনাকে ডাকার জন্য অনুরোধ করেছি ।
তবুও আমি জানিয়ে রাখছি, আমি আপনাকে জগাদা বলে ডাকবো ।
তারপর একটু হেসে কুহেলি জিজ্ঞাসা করলো, “এবার বলুন, সেদিনের ইন্টারভিউ কেমন হলো ?
সেদিন ছিল আমার শারীরিক মাপজোক । স্বাস্থ্য বিষয়ক কথাবার্তা । রাজ্য সরকারের পুলিশের কন্সটেবলের চাকরি । আগের লিখিত পরীক্ষায় পাশ করার পর মাপজোকে ডেকেছিল । সেদিনের মাপজোকের পরীক্ষা দিয়ে আমি খুশী । সুতরাং পুলিশের চাকরিটা হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল । জানি না, শেষ পর্যন্ত কী হবে ?
আমার বিশ্বাস, পুলিশের চাকরিটা আপনি পাবেন । এবার বলুন, কী খাবেন ?
আপনার হাতে তৈরী চা খাবো । সেদিন চা খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি । আজ চা খাওয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইছি না ।
আপনি বসুন, আমি চা বানিয়ে আনছি ।
এত ব্যস্ত হবেন না । খরিদ্দার এলে তাদের সাথে আমাকেও বানিয়ে দেবেন । বরং ফুরসত পেয়েছেন, একটু জিরিয়ে নিন ।
আপনি যথেষ্ট মানবিক !
মানবিকতা আমার জীবনের বড় গুণ । কিন্তু জীবনের অন্যান্য দিকগুলির দিকে তাকালে এবং নম্বর দিতে চাইলে, সেখানে নির্ঘাত জিরো দেবেন ।
কেন নিজেকে ছোট ভাবছেন ?
কোনো কাজ করি না । বাপের হোটেলে খাই-দাই, ঘুরে বেড়াই । শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাড়াতে পারিনি । এইজন্য বাপের বকুনি অহরহ । সুতরাং আমি একটা অকর্মার ঢেঁকি ।
দুইজন টোটোওয়ালা ঢুকে বলল, “আদা দিয়ে ভাল করে দুটো চা বানাও দিদি ।“
তিন কাপ চা বানালো কুহেলি । মাটির ভাঁড়ে পরিবেশন করলো । আলাদা প্লেটে জগন্নাথকে দু-রকম বিস্কুট দিলো । টোটোওয়ালা চায়ে চুমুক দিয়ে স্বতোস্ফূর্তভাবে বলল, “আজকের চা অন্যান্যদিনের চেয়ে অনেক বেশী সুস্বাদু । বরং বলা ভাল আজকের চা, স্পেশাল চায়ের চেয়েও অনেক উন্নত ।“
টোটোওয়ালার কথা শুনে জগন্নাথ মুচকী মুচকী হাসছে । তারপর কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদা একদম ঠিক বলেছেন । আজকের চা অতি মধুর ।“
“থাক জগাদা ! লোকের কথা শুনে আপনাকে সুমিষ্ট মন্তব্য করতে হবে না ।“ বলেই আড়চোখে জগন্নাথের দিকে তাকালো কুহেলি ।
এমন সময় জগন্নাথের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো ।
“হ্যালো বাবা । হঠাৎ ফোন !”
এইমাত্র পোস্টম্যান এসেছিলেন । পুলিশের চাকরির এ্যাপোন্টমেন্ট লেটার দিয়ে গেলেন । তোকে সত্বর পুলিশের চাকরিতে জয়েন করতে হবে ।
বাবা, পোস্টিং কোথায় দিলো ?
এই মুহূর্তে ভরতপুর থানায় রিপোর্ট করতে বলেছে ।
“ঠিক আছে বাবা । আমি একটু পরে বাড়ি ফিরছি ।“ বলেই লাইন কেটে দিলো জগন্নাথ । কুহেলি লক্ষ করলো, চাকরির খবর পেয়ে জগন্নাথের শারীরিক ভাষা পুরোপুরি পাল্টে গেলো । খুশীতে টগবগ । তবুও নিজেকে সংযত করে স্বাভাবিক ছন্দে কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল, “পুলিশের চাকরিটা আমার হয়ে গেছে ।“
হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে কুহেলি উত্তরে বলল, “অভিনন্দন !”
“অসংখ্য ধন্যবাদ ।“ খুশীর মেজাজে জগন্নাথ তখন উৎফুল্ল ।
জগাদা, একটা কথা বলবো ।
“কী ?” জানতে চাইলো জগন্নাথ ।
এবার আপনি কী আমাদের ভুলে যাবেন ? যদিও আমার সঙ্গে আপনার আলাপ স্বল্পদিনের ।
স্বল্পদিনের হলেও ……… । যাকগে সেকথা ।
থামলেন কেন জগাদা । কীযেন বলতে চেয়েছিলেন । “স্বল্পদিনের হলেও” বলতে গিয়ে থেমে গেলেন ।
আজ আমি উঠবো কুহেলি ম্যাডাম !
উহুঁ ! কুহেলি ম্যাডাম নয় । এখন থেকে শুধু কুহেলি ।
তবে আপনাকেও জগা নামে ডাকতে হবে, এমনকি “তুমি” সম্বোধনও ।
“ধীরে বৎস ! ধীরে ।“ ঠিক সেই সময় লোহাদহ ঘাট যাওয়ার প্যাসেঞ্জার ভর্তি বাস এসে থামলো । ঠাসা ভিড় । বাস থেকে অনেক প্যাসেঞ্জার নামলেন । এক ঝাক প্যাসেঞ্জার কুহেলির দোকানে হাজির । তাদের বক্তব্য, “বাসটি দেরী করার জন্য তাদের প্রচণ্ড খিদে । ঘুগনী সহযোগে পাউরুটি ও ডিম-টোস্ট চাই ।“
কুহেলি পড়লো মহা সমস্যায় । তাই মুখ ফুটে বলে ফেলল, এতগুলি লোকের পাউরুটি টোস্ট বানাতে একটু সময় লাগবে । একার হাতে আমাকে সব তৈরী করতে হবে । আপনারা ধৈর্য ধরে বসুন প্লিজ !
আপনি ধীরেসুস্থে করুন । আমাদের তাড়া নেই । প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে থেকে অল্প বয়সী মহিলা জগন্নাথের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, “আপনার স্বামীকে হাত লাগাতে বলুন । তাহলে আরও তাড়াতাড়ি হবে ।“
একটু হেসে কুহেলি উত্তর দিলো, “উনি আমার স্বামী নন । বরং বন্ধু বলতে পারেন ।“
মহিলা আবার কীযেনো বলতে যাচ্ছিলেন । তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জগন্নাথ কুহেলিকে বলল, “উনি যথার্থ বলেছেন ।“
কোনটা যথার্থ বলেছেন — স্বামী, না অন্য কিছু ?
আহম্মকের পাল্লায় পড়া গেলো ! আমি বলতে চাইছি, আমি আপনার কাজে হাত লাগাতে চাই ।
“সরকারি পুলিশকে দিয়ে আমি কোনো কাজ করাতে পারবো না । তাতে খরিদ্দার বিরাগভাজন হলেও আমার তাতে দুঃখ নেই । দেখা যাবে, আপনি একদিন অজানা অজুহাতে আমাকে হাতকড়া পরিয়ে ছাড়বেন !
কুহেলির হাত থেকে একরকম ছিনিয়ে নিয়ে জগন্নাথ পাউরুটি সেঁকতে শুরু করলো । অন্যদিকে কুহেলি ডিম ফাটিয়ে ঐ টোস্ট বানাতে লাগলো । নিমেষের মধ্যে খাবার রেডি করে খরিদ্দারদের খাবার পরিবেশন করলো কুহেলি । কাজের ফাঁকে ফাঁকে জগন্নাথের কর্মকাণ্ড লক্ষ করে কুহেলি বুঝতে পারলো, জগন্নাথ সত্যিই আন্তরিক ও মানবিক । কাজের প্রতি এতটাই নিষ্ঠা, যার জন্য কুহেলির দিকে ঘুরে তাকাবার ফুরসত নেই । জগন্নাথকে নিয়ে গুণধর দাদুর বর্ণনা একদম সঠিক । জগন্নাথের এইসব কর্মকাণ্ড দেখে একটু হলেও কুহেলির মন জগন্নাথের প্রতি দুর্বল হয়ে উঠলো ।
দিদি, আমাকে একটু ঘুগনি দেবেন !
খরিদ্দারের ডাক শোনামাত্র কুহেলির মন থেকে জগন্নাথের চিন্তা উধাও । পুনরায় দোকানের খরিদ্দারকে পরিষেবা দিতে তৎপর হয়ে উঠলো ।
তারপর ভরতপুর থানায় যোগ দেওয়ার দিন খুব সকালে কুহেলির সঙ্গে দেখা করে গেলো জগন্নাথ । সেদিন জগন্নাথের সাথে কুহেলি কোনো কথা বলতে পারেনি । তার চোখ ছিল ছলছল । শুধু অস্ফূট স্বরে বলেছিল, “ভাল থেকো ।“ জগন্নাথও তদ্রূপ । চুপচাপ বসেছিল । দোকান ভর্তি লোকের মধ্যে উঠে যাওয়ার সময় কুহেলির খুব কাছে গিয়ে জগন্নাথ বলল, “তোমাকে আমার সর্বক্ষণ মনে থাকবে ।“


কুহেলি টাকা জমানোর দিকে জোর দিলো । তার ইচ্ছা, আধুনিক স্টাইলে রেস্টুরেন্ট খোলা । তার জন্য পর্যাপ্ত পুঁজি দরকার । দোকান ঘর সাজাতে হবে । দরকার হলে উপরে ঘর বানাতে হবে । খরিদ্দারদের বসার জন্য চেয়ার-টেবিল যথেষ্ট সংখ্যায় দরকার ! তার উপর লাইট-ফ্যান । সোজা কথা আধুনিক স্টাইলে দোকানের সৌন্দর্য বাড়াতে হবে । রেস্টুরেন্টে কলেজের ছেলে-মেয়ে সহ সব ধরনের খরিদ্দারদের আগমন ঘটবে । তা ছাড়া দোকানে তখন কর্মচারী রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে । সুতরাং অনেক চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন । সর্বোপরি পুঁজির দরকার ।
মাঝখানে কানাই কাকাকে তার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলো কুহেলি । কানাই কাকা পরিষ্কার বলে দিয়েছে, “দোকান উন্নয়নের ব্যাপারে তোমার পুরো স্বাধীনতা রয়েছে । সুতরাং তুমি তোমার ইচ্ছামতো দোকান ঘর সাজিয়ে যাও, আমি তোমার পাশে আছি । আমি চাই, তোমার ব্যবসা বাড়ুক ।“
কুহেলি এখন বড় ব্যবসায়ী । গাঁয়ে-গঞ্জে কুহেলিকে নিয়ে মানুষের মধ্যে আলোচনা, “অভিভাবকহীন একটা বয়স্তা মেয়ে গায়ে-গতরে খেটে যেভাবে দোকানটাকে দাঁড় করালো, সেটা অবর্ণনীয় । তার সমবয়সী অনেক ছেলেরা এইভাবে দোকান দাঁড় করাতে পারবে না । অন্যান্য মেয়েদের কথা ছেড়েই দিলাম । তার উপর মেয়েটা দুর্ধর্ষ সাহসী । এমন সাহসী মেয়ে দ্বিটীয়টি খুঁজে পাওয়া কঠিন !” কাঞ্চন নগর গাঁয়ের বুড়ো মানুষেরা রোজ বিকেলে কুহেলির দোকানে ভিড় করছেন । তাঁদের অনুরোধে কুহেলি বিকেলে অল্প সংখ্যায় সিঙ্গারা ভাজে । সিঙ্গারা বানানোর পদ্ধতি কুহেলি আগেই শিখেছিলো । কেননা প্রথমদিকে সে চেয়েছিলো, সিঙ্গারার দোকান দিতে । তাই কুহেলির সিঙ্গারা বানানোর প্রণালী শেখা । যার জন্য কুহেলি জানে মশলার পরিমান, কতোটা আলু, কতোটা ময়দা, কাঁচা লঙ্কা, সাদা তেল, খাবার সোডা, হলুদ, মৌরি, বাদাম ভাজা, পেয়াজ কুচানো, শুকনো লঙ্কা, আদা-রসুন, গরম মসলা, ধনে পাতা, ইত্যাদি উপকরণ সিঙ্গারা তৈরীতে লাগে । বিকেলের সিঙ্গারা ভাজা ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে । আশেপাশের গ্রামের ছেলেমেয়েরা সাইকেলে এসে কুহেলির দোকান থেকে সিঙ্গারা কিনে নিয়ে যাচ্ছে । দোকানের বিক্রিবাট্টা দেখে প্রতিবেশী দোকানদারদের কুহেলির প্রতি বাঁকা চাহনী । অথচ অন্যদিকে কুহেলির জনপ্রিয়তা দেখে কাঞ্চন নগর গ্রামের স্মৃতির বাবা বললেন, “তুমি এলাকার ছেলেমেয়ের কাছে উৎকৃষ্ট উদাহরণ । তোমাকে দেখে তাদের শেখা উচিত ‘কঠোর পরিশ্রম কাকে বলে এবং কঠোর পরিশ্রম করলে আর্থিক উপার্জন অনায়াসেই সম্ভব ।“
তারপর দীর্ঘদিন কেটে গেলো ।
জগন্নাথ এখন ভরতপুর থানার পুলিশ । বাড়ি থেকেই মোটর বাইকে যাতায়াত । কুহেলির দোকানে বসে চা খাওয়ার সময় নেই । মাঝে মধ্যে যাওয়া-আসার পথে কাঞ্চন নগরের মোড়ে এসে দূর থেকে হাত তুলে ‘টা-টা’ দিয়ে গন্তব্যস্থলে চলে যায় । জগন্নাথের ব্যস্ততা দেখে কুহেলি হাসে ও ভাবে, “বাবু এখন থানার বড় পুলিশ । দায়িত্ব অনেক । তাই তার অফিসে যাওয়ার ভীষণ তাড়া !”
কুহেলি এখনও রেস্টুরেন্ট খোলার প্রয়োজনীয় পুঁজি সংগ্রহ করতে পারলো না । তবে দোকান ঘরটায় হাত দিয়েছে । ছাদ ঢালাই হয়ে গেছে । প্লাস্টারের কাজ চলছে । সামনে বর্ষাকাল । আষাঢ় মাসের শেষ দিক । ভারী বর্ষণ শুরু হয়নি । জমিতে এখন পাট চাষ । পাট কেটে সেই জমিতে ধান রোয়ার চাষ শুরু হবে । চারিদিকে পাট ক্ষেত । বড় বড় পাট । কিছুদিনের মধ্যেই পাট কেটে পচানোর কাজ চলবে ।
অন্যদিকে পাট বড় হলেই কুহেলির চিন্তা বাড়ে । এই সময় গ্রামের মেয়েদের জীবনে অনেক অবাঞ্ছনীয় ঘটনা ঘটে । কিছু সুযোগ সন্ধানী পুরুষ লোলুপ দৃষ্টিতে বয়স্থা মেয়েদের দিকে বিশ্রিভাবে তাকায় । তারা ছোট-বড় মানে না, মেয়ে দেখলেই তাকে তুলে নিয়ে পাটের জমিতে ঢুকিয়ে অশালীন ব্যবহার করার নোংরা প্রয়াস ! দুরভিসন্ধি নোংরা মানুষের হাত থেকে গৃহস্থ বাড়ির বৌ-ঝি’রাও ছাড়া পান না । তার উপর রয়েছে পাচারকারীর চক্র ! নারী পাচারকারী চক্র এই সময় সক্রিয় হয়ে ওঠে । তারা বিভিন্ন জায়গায় ওত পেতে থাকে । স্থানীয় প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে রাতের অন্ধকারে মেয়েদের তুলে নিয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে ভিন রাজ্যে পাচার করে দেয় । সেইজন্য আষাঢ়ের শেষে বা শ্রাবণের গোড়ায় জমিতে পাট না-কাটা পর্যন্ত কুহেলির দুশ্চিন্তা ! ভয়ে ভয়ে বাড়িতে যাতায়াত । রাতের বেলায় কাঞ্চন নগরের মানুষের সাথে বাড়ি ফেরে । কাউকে না পেলে, কানাই কাকাকে ডেকে আনে এবং তারপর কাকার সাথে বাড়ি ফেরে । বাড়ি ফেরার সময় লোক নির্বাচন ঠিক না হলে, সেই লোকের হাতে হেনস্থা হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল । অতীতে অনেক অঘটন ঘটেছে । যদিও কুহেলি এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন কোনোদিন হয়নি । তবে মেয়েদের নিয়ে এই ধরনের আপত্তিজনক ঘটনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ।
সারাদিন টিপটিপ বৃষ্টি ! আকাশ মেঘাচ্ছন্ন । বিকেলে খরিদ্দার কম । আকাশের অবস্থা ভাল না থাকায় কুহেলি বিকেলে সিঙ্গারা ভাজেনি । যদিও সিঙ্গারার দুজন খরিদ্দার ঘুরে গেলেন । সন্ধ্যা নেমে এলো । বৃষ্টি কিছুটা থেমেছে । তবে রাস্তা-ঘাটে বৃষ্টির জমা জল । রাস্তা কাদায় ভর্তি । বাসে প্যাসেঞ্জার কুব কম । দোকানে কয়েকজন বসে চা খাচ্ছেন । সন্ধ্যা শেষ হতে না হতেই, চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার । রাত্রি বাড়ছে । দোকান তাড়াতাড়ি বন্ধ করতে চায় কুহেলি । খরিদ্দার নেই । দোকানে শুধুমাত্র ভ্যান রিক্সাওয়ালা মন্টু বসে চা খাচ্ছে । তখন লোডশেডিং । দোকানে বড় বড় দুটি মোমবাতি জ্বালানো । মন্টু কুহেলিকে বলল, “আজ চারিদিকে খুব অন্ধকার । সম্ভবত অমাবস্যা কাছে ! রাস্তায় লোকজন কম । পরের বাসটা দেখে আমি বাড়ি চলে যাবো । শেষ বাসের অপেক্ষায় থাকবো না ।“
“আমিও দোকান বন্ধ করবো মন্টুদা । খরিদ্দারের আনাগোনা খুব কম ।“
ঠিক সেই মুহূর্তে হন্তদন্ত হয়ে কাঞ্চন নগরের পুবালী দোকানে ঢুকেই কুহেলকে বলল, “আমি তোমার সঙ্গে বাড়ি ফিরবো । আমার খুব বিপদ ! অজানা কিছু দুষ্কৃতী আমার পিছু নিয়েছে । সংখ্যায় তারা তিনজন । আবছা আলোয় একজনের মুখে কালো দাড়ি দেখলাম । তাদের উদ্দেশ্য খারাপ । বিশ্রি ভাষায় আমাকে শাসাচ্ছিলো । অন্ধকারে দুষ্কৃতীদের চেহারা বোঝা গেলো না । দুষ্কৃতকারীরা বাইরে থেকে আমাদের এলাকায় ঢুকেছে । মেয়েদের সর্বনাশ করা তাদের টার্গেট ! পেছনে তাড়া করার জন্য খুব জোরে সাইকেল চালিয়ে তোমার দোকানে । অল্পের জন্য আজ রক্ষা পেলাম । এবার তোমার সঙ্গে বাড়ি ফিরবো ।“
পুবালীর কথা শেষ হতে না হতেই সেই মুহূর্তে ঐ তিনজন দুষ্কৃতি কুহেলির দোকানে হাজির । কুহেলির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে । মুখে বিশ্রি গন্ধ । দুষ্কৃতি তিনজন দোকানে ঢোকামাত্র, কুহেলি মোবাইলে জগন্নাথকে দুষ্কৃতদাকারীর অসৎ উদ্দেশের কথা মেসেজ করে দিলো ।
“এই বেটি, দোকানের মালিক কে ? আমরা চা খাবো ।“ আধা আধা হিন্দি ও বাংলা মিশিয়ে চায়ের অর্ডার । অন্যদিকে ঐতিনজন দুষ্কৃতিকে দেখতে পেয়ে পুবালী পেছন দিয়ে পাশের মিষ্টির দোকানে পালালো । মন্টু তখনও চা খাচ্ছে । দোকানে মন্টু থাকায় কুহেলির একটু ভরসা !
তিনটি চা বানিয়ে তাদের সামনে ধরে কুহেলি বলল, “আপনারা কোথা থেকে এসেছেন ?”
দাড়িওয়ালা পরিষ্কার বাংলায় বলল, “তারা সালার থেকে এসেছে । একজন আত্মীয়কে তারা খুঁজছে ।“ তারপর নিজেদের মধ্যে মৃদু স্বরে বলাবলি, চায়ের দোকানের মেয়েটি খুব খাসা ! তারপর অন্য একজন দুষ্কৃতি মন্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, দোকানে কী কেউ একটু আগে ঢুকেছিলো ?”
চোখের ইশারায় কুহেলি মন্টুদাকে কিছু বলতে “না” করে দিলো । তাই রিক্সা ভ্যানওয়ালা মন্টুদা বোবা মানুষের অভিনয় করে হাতের ইশারায় দুষ্কৃতিদের কথার উত্তর দিলো, “সে দোকানে কাউকে দেখেনি ।“ মোবাইলের এস-এম-এসের আওয়াজে মোবাইলে তাকিয়ে দেখে জগন্নাথ বাইক নিয়ে তার দোকানে কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছাচ্ছে । নিশ্চিন্ত হলো কুহেলি । তাই হাল্কা কথাবার্তার মধ্যে দুষ্কৃতিদের আটকে রাখলো কুহেলি ।
এই মুহূর্তে জগন্নাথ একমাত্র কুহেলির কাছের মানুষ । শীতল অনেকদিন আগেই সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে । শীতল অজুহাত দেখিয়েছিল, তাদের বাড়িতে কুহেলিকে মেনে নিচ্ছে না । কেননা তারা নীচু বংশের । তবুও কুহেলি উপযাজক হয়ে শীতলকে চেপে ধরে বলেছিলো, “ভালবাসা জাতপাত দেখে হয় না । তুমি আমাকে ভালবাসো, এটাই সত্যি । সুতরাং আমাকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে মেনে নেওয়ার ব্যাপারে তোমার কী মত ?” নির্লজ্জের মতো উত্তরে শীতল বলেছিল, “যেখানে বাবা-মায়ের মত নেই, সেখানে আমাদের সম্পর্ক স্থায়ী করতে অপারগ ।“ পরে কুহেলি খোঁজখবর নিয়ে জেনেছিল, “শীতল কলকাতার অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে অনেক আগেই জড়িয়ে পড়েছে । তাকেই জীবনসঙ্গিনী হিসাবে বেছে নিয়েছে শীতল ।“ তারপর থেকে শীতলের সঙ্গে কুহেলির সম্পর্ক শেষ । এমনকি শীতলের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ !
হঠাৎ দোকানের সামনে বোলারো চার চাকার গাড়ি !
কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাদা রুমালে কেমিক্যাল মিশিয়ে কুহেলিকে বেহুঁশ করে গাড়িতে তুললো । সেই অপহরণের দৃশ্য দেখার জন্য বাইরে উঁকি দিতেই দুষ্কৃতিদের চোখে পড়লো পুবালী । তাকেও গাড়িতে তুললো । নিমেষের মধ্যে বোলারো গাড়ি সোজা লোহাদহ ঘাট । সেখানে ডিজেল ইঞ্জিনে চলা খেয়া নৌকা রেডি । আরও একজন ষণ্ডামার্কা দুষ্কৃতি খেয়া ঘাটে অপেক্ষারতো । পরিকল্পনামাফিক তাদের ছক । বোলারো গাড়ি সমেত খেয়া নৌকায় পার হয়ে বাজারসৌ এলাকাকে পেছনে রেখে গাড়ি ছুটলো বহরমপুরের দিকে । কলকাতার দিকে ঝুঁকি নিলো না । বহরমপুর শহরে না ঢুকে তারা ছুটলো শিলিগুড়ির বাগডোগরা বিমান বন্দরের দিকে । সেখানে জলপাইগুড়ির জঙ্গল থেকে অপহরণ করা চারজন মেয়েকে নিয়ে অপেক্ষা করছে তাদের আর একটি দল । ভোরের ফ্লাইটে দিল্লি যাওয়ার কথা ! কুহেলি ও পুবালীকে নিয়ে আগন্তুকদের গাড়ি দ্রুতগতিতে ছুটছে ।
(চলবে)