ভারতে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাকামী আন্দোলনের একজন অগ্রগণ্য বিপ্লবী নেতা এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির অন্যতম সংগঠক ছিলেন রাসবিহারী বসু। রাসবিহারী বসু ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ শে মে অধুনা পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলায় অবস্থিত তার পৈতৃক গ্রাম সুবলদহে জন্মগ্রহণ করেন৷ পিতা বিনোদবিহারী বসু এবং তার মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। তিনকড়ি দাসী ছিলেন তার ধাত্রী মাতা৷ তার পিতামহ নাম ছিলেন কালীচরণ বসু৷
এই বসু পরিবারের আদিবাস ছিল অধুনা পূর্ব বর্ধমান জেলার সুবলদহেতে৷ তাঁদের পূর্বপুরুষ নিধিরাম বসুই সর্বপ্রথম সুবলদহে বসবাস শুরু করেন৷
রাসবিহারী বসুকে তার নামটি দিয়েছিলেন পিতামহ কালীচরণ বসু। গর্ভাবতী অবস্থায় তার মা ভুবনেশ্বরী দেবী কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
তাই সুবলদহ গ্রামের পশ্চিম পাড়াতে অবস্থিত বিষ্ণুমন্দির বা কৃষ্ণ মন্দিরে তার নামে প্রার্থনা(মানত) করা হয়েছিল যাতে তিনি(ভুবনেশ্বরীদেবী) সুস্থভাবে সন্তানের জন্ম দেন, তাই পরবর্তীকালে তার নাতির নাম রাখেন, কৃষ্ণের অপর নামে। রাসবিহারী হল কৃষ্ণের অপর নাম। রাসবিহারী বসু এবং তার ভগিনী সুশীলা সরকারের শৈশবের বেশির ভাগ সময় কেটেছিল সুবলদহ গ্রামে। তারা সুবলদহ গ্রামে বিধুমুখী দিদিমণির ঘরে বসবাস করতেন। বিধুমুখী ছিলেন একজন বাল্যবিধবা, তিনি ছিলেন কালিচরণ বসুর ভ্রাতৃবধূ। রাসবিহারী বসুর শৈশবের পড়াশোনা সুবলদহের গ্রাম্য পাঠশালায় (বর্তমানে সুবলদহ রাসবিহারী বসু প্রাথমিক বিদ্যালয়) ঠাকুরদার সহচর্যে সম্পন্ন হয়েছিল। রাসবিহারী বসু শৈশবে লাঠিখেলা শিখেছিলেন সুবলদহ গ্রামের শুরিপুকুর ডাঙায়। তিনি সুবলদহ গ্রামে তার ঠাকুরদা কালিচরণ বসু এবং তার শিক্ষকদের কাছ থেকে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী গল্প শুনে তার বিপ্লবী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন গ্রামবাসীদের নয়নের মণি। শোনা যায় যে, তিনি ইংরেজদের মূর্তি তৈরি করতেন এবং লাঠি খেলার কৌশলে সেই মূর্তিগুলোকে ভেঙে ফেলতেন। তিনি ডাংগুলি খেলতে খুব ভালোবাসতেন। তিনি শৈশবে সুবলদহ গ্রামে ১২ থেকে ১৪ বছর ছিলেন, এছাড়াও তিনি পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিয়ে প্রয়োজনে সুবলদহ গ্রামে এসে আত্মগোপন করতেন। পিতা বিনোদবিহারী বসুর কর্মক্ষেত্র ছিল হিমাচল প্রদেশের সিমলায়। তিনি সুবলদহ পাঠশালা, মর্টন স্কুল ও ডুপ্লে কলেজের ছাত্র ছিলেন। জীবনের প্রথম দিকে তিনি নানা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং আলিপুর বোমা বিস্ফোরণ মামলায় ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে অভিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি দেরাদুনে যান এবং সেখানে বন্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে হেড ক্লার্ক হিসেবে কাজে যোগদান করেন। দেরাদুনে তিনি গোপনে বাংলা, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন।বিপ্লবী হিসেবে তার অন্যতম কৃতিত্ব বড়লাট হার্ডিঞ্জের ওপর প্রাণঘাতী হামলা। বিপ্লবী কিশোর বসন্ত বিশ্বাস তার নির্দেশে ও পরিকল্পনায় দিল্লিতে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে বোমা ছোড়েন হার্ডিঞ্জকে লক্ষ্য করে। এই ঘটনায় পুলিশ তাকে কখনোই গ্রেপ্তার করতে পারেনি। সমগ্র ভারতব্যাপী সশস্ত্র সেনা ও গণ অভ্যুত্থান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন রাসবিহারী বসু। জনৈক বিশ্বাসঘাতকের জন্যে সেই কর্মকাণ্ড ফাঁস হয়ে যায়। বহু বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় তিনি ব্রিটিশ সরকারের সন্দেহভাজন হয়ে ওঠেন এবং শেষ পর্যন্ত দেশত্যাগে বাধ্য হন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বন্যা বিধ্বস্ত সুবলদহ গ্রামে ফিরে আসেন এবং ত্রাণ বিলির উদ্যোগ নেন।[৯] ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ মে কলকাতার খিদিরপুর বন্দর থেকে জাপানি জাহাজ ‘সানুকি-মারু’ সহযোগে তিনি ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন। তার আগে নিজেই পাসপোর্ট অফিস থেকে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়, রাজা প্রিয়নাথ ঠাকুর ছদ্মনামে পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন।
তারই তৎপরতায় জাপানি কর্তৃপক্ষ ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের পাশে দাঁড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় সমর্থন যোগায়। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৮-২৯ মার্চ টোকিওতে তার ডাকে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ বা ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি সেই সম্মেলনে একটি সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুন ব্যাংককে তিনি লীগের দ্বিতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন। সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র বসু কে লীগে যোগদান ও এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। যেসব ভারতীয় যুদ্ধবন্দি মালয় ও বার্মা ফ্রন্টে জাপানিদের হাতে আটক হয়েছিল তাদেরকে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগে ও লীগের সশস্ত্র শাখা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে যোগদানে উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে জাপানি সেনাকর্তৃপক্ষের একটি পদক্ষেপে তার প্রকৃত ক্ষমতায় উত্তরণ ও সাফল্য ব্যাহত হয়। তার সেনাপতি মোহন সিংকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির নেতৃত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু তার সাংগঠনিক কাঠামোটি থেকে যায়। রাসবিহারী বসু ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (আজাদ হিন্দ ফৌজ নামেও পরিচিত) গঠন করেন। জাপানে সোমা নামে এক পরিবার তাকে আশ্রয় দেয়। ওই পরিবারেরই তোশিকা সোমাকে তিনি বিবাহ করেন। রাসবিহারী বসুকে জাপান সরকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘সেকেন্ড অর্ডার অব দি মেরিট অব দি রাইজিং সান’ খেতাবে ভূষিত করে। জানুয়ারি ২১, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানে রাসবিহারী বসুর মৃত্যু হয়।
তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট ও উইকিপিডিয়া।