দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস, চতুর্দশ পর্ব) : দিলীপ রায়।

0
464
             পাটকাঠির ঢিপির মধ্যে আবদ্ধ অবস্থায় থাকার জন্য জগন্নাথের সাথে যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে না । এমনকি কুহেলি ফোনে কথা বলতে বা মেসেজ পাঠাতে পারছে না । ঐদিকে অদূরে দুষ্কৃতিরা আড়ালে বসে তাদের উপর নজর রাখছে । টের পেলে কুহেলিদের রক্ষে নেই । আবার নারী পাচার চক্রের খপ্পরে পড়তে হবে । কুহেলি কিছুতেই পাচারকারীদের হাতে পুনরায় ধরা পড়তে নারাজ । কুহেলি  নিজেকে বাঁচাতে যেকোনো প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হতে মানসিকভাবে তৈরী !    
         হঠাৎ পুবালীর হাঁচি  ! সারা রাত দৌড়-ঝাঁপ করার জন্য পুবালীর শরীর ঠিক নেই । শরীরে জ্বর জ্বর ভাব । অনেকক্ষণ থেকে নাক টানছে । নাকের ভিতর ভীষণ অস্বস্তি ।  আর হাঁচি ধরে রাখতে পারলো না । হাঁচির শব্দ পাটকাঠির ঢিপি ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে গেলো । হাঁচি দেওয়ার সাথে সাথে পুবালীর শরীর নড়েচড়ে উঠলো । শারীরিক নড়াচড়ার জন্য খাড়া করা পাটকাঠিগুলোও কেঁপে  উঠলো । 
        ওত পেতে বসে থাকা দুষ্কৃতিরা হাঁচির শব্দে উজ্জীবিত হয়ে উঠলো । শারীরিক ভাষা বুঝিয়ে দিচ্ছে, তাদের হারানো ধনের সন্ধান তারা পেয়ে গেছে !  উঠে  দাঁড়িয়ে আশেপাশে ভালভাবে দেখে নিলো । চাষের জমিতে যেমন চাষ করার কোনো লোকজন নেই তেমনি আশেপাশেও কোনো লোকজনের সাড়াশব্দ নেই । শুরু হলো তাদের তল্লাশি । হাঁচির  শব্দকে কেন্দ্র করে  কুহেলিদের খুঁজতে শুরু করলো । তিনজন দুষ্কৃতি একসঙ্গে তাদের দিকে ধেয়ে আসছে । দুষ্কৃতিদের চলাফেরা দেখলে মনে হচ্ছে, তারা হাতে চাঁদ পেয়ে গেছে ।  জলাশয়ের কিনারে পাটকাঠির  প্রায় পনেরটা  ঢিপি । একটা একটা  করে ঢিপি খুঁজতে লাগলো । তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, পাটকাঠির ঢিপির মধ্যে কুহেলিরা লুকিয়ে । তাই তারা প্রতিটা ঢিপি ধরে ধরে  খুঁজছে ।  কুহেলি ঝুঁকি নিতে চাইছে না । তাই দুষ্কৃতিরা পৌঁছানোর আগে তাদের পালানোর উদ্যোগ । কিন্তু কিছুতেই পালাবার পথ পাচ্ছে না । কুহেলি রীতিমতো  টেনশনে ঘামছে । আর মাত্র দুটো পাটকাঠির ঢিপি খোঁজা  অবশিষ্ট ।  অথচ কুহেলি দুষ্কৃতিদের হাতে ধরা দিতে নারাজ । পালাতে যথাযথ সুযোগ না পাওয়ার কারণে  উদ্বিগ্নতায়, টেনশনে কুহেলির ছটফটানি । 
     অবশেষে মনকে শক্ত করলো কুহেলি । পুবালী ও কুহেলি পালিয়ে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত  ! যদিও পুবালী কুহেলির মতো অতোটা মানসিকভাবে শক্তিশালী  নয় । বারংবার কুহেলিকে উত্ত্যক্ত করছে, “ধরা পড়লে কী হবে ?” পুবালী জানে,  কুহেলি যেমন শারীরিকভাবে শক্ত, তেমনি তার মনে ভয়-ডর কম । যেকোনো পরিস্থিতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার  এবং যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখে  ।  অতীতে  বেয়াদপ ছেলেদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে কুহেলিকে অনেক প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং সাহসিকতার সাথে সেই প্রতিকূল অবস্থাকে সে সামলিয়েছে ।  তাই কুহেলি দুষ্কৃতিদের হাত থেকে রেহাই পেতে পালাবার  জন্য মানসিকভাবে চাঙা ! তবুও দুষ্কৃতিদের হাতে ধরা দিতে নারাজ ! 
     গুটি গুটি পায়ে কুহেলিরা দুষ্কৃতিদের পেছন দিয়ে কিছুটা এগিয়ে  গিয়ে, তারপর  দৌড়  । শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সজোরে দৌড় ।  যেটা দুষ্কৃতিরা প্রথমে বুঝতে পারেনি  । কিন্তু দৌড়াবার আওয়াজ পেয়ে দুষ্কৃতিরা কুহেলিদের পেছন পেছন ধাওয়া । দুজনের ষণ্ডামার্কা চেহারা ।  তিনজনের মধ্যে দুজন প্রাণপন ছুটছে । যেভাবে হোক, কুহেলিদের ধরতে  মরিয়া !  
     অল্পতেই হাঁপিয়ে যাচ্ছে পুবালী । কুহেলির সাথে পেরে উঠছে না । দৌড়াতে গিয়ে পুবালীর পড়ে যাওয়ার  উপক্রম । পুবালীকে পড়ে যেতে দেখে  কুহেলির ধমক, “আরও  জোরে, আরও জোরে  পুবালী ।“ কুহেলি জানে, সে যেভাবে হোক পালিয়ে বাঁচবে । দৌড়িয়ে অন্তত দুষ্কৃতিরা তাকে ধরতে পারবে না !  কিন্তু পুবালী দৌড়াতে না পারলে আখেরে কুহেলির বিড়ম্বনা  । পুবালীকে নিয়ে ভুগতে হবে । কেননা পুবালীকে সঙ্গে নিয়েই তাকে ফিরতে হবে । তাই পুবালীকে দৌড়ানোর গতি বাড়াবার জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছে ।  কিন্তু পুবালী কুহেলির সাথে দৌড়াতে পারছে না ।  হাঁপিয়ে যাচ্ছে । তারপর হঠাৎ  ………?
      হঠাৎ পুবালী হোঁচট খেয়ে জমিতে কাদার মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো । খুব দ্রুত  দুষ্কৃতিরা পুবালীকে ধরে ফেললো । পুবালীর পড়ে যাওয়াটা টের পায়নি কুহেলি । তাই সে এলোপাথারি ছুটছে । তার টার্গেট,  আগে দুষ্কৃতিদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচানো । তারপর খোঁজ নিয়ে জানবে, “তারা এখন কোথায় ?” 
       কিন্তু পরক্ষণেই …………? 
      দুষ্কৃতিরা চিৎকার করে কুহেলির উদ্দেশে বললো, “আর একপাও এগোবি না ।  পালাবি কোথায় ? তোদের নিয়ে আমরা সোজা ভিন রাজ্যে । সেখানে তোদের বিয়ে  । আর তোদের বাঁচার আশা নেই ।“ 
   ঘুরে তাকিয়ে কুহেলি দেখলো, পুবালী দুষ্কৃতিদের হেফাজতে  ! ভয় পেয়ে আতকে উঠলো কুহেলি । বিষম বিপদ । পুনরায় দুষ্কৃতিদের জালে জড়িয়ে পড়লে ভবিষ্যতে সেই জাল থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব  ! এদের অনেক দূর পর্যন্ত জাল বিস্তার । সুতরাং ধরা পড়লে সর্বনাশ ! তাই সেই মুহূর্তে কীভাবে নিজেদের বাঁচাবে সেই চিন্তায় অস্থির ।  পরক্ষণেই  নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো কুহেলি । যেভাবে হোক পুবালীকে দুষ্কৃতিদের হাত থেকে উদ্ধার করে অন্যত্র পালাতে হবে । ষণ্ডামার্কা দুজন কুহেলিকে  ধরার জন্য প্রস্তুত ।  বয়স্ক দুষ্কৃতিটার জিম্মায়  পুবালিকে রেখে অপর দুজন খুব দ্রুত এগোচ্ছে  । কিন্তু এই মুহূর্তে কুহেলির কাছে সবচেয়ে মুস্কিল ব্যাপার সেটা হচ্ছে, ঝৌড়-ঝাঁপ টানা-হ্যাচড়ার জন্য ঐ ষণ্ডামার্কা দুজনের সাথে সামনাসামনি লড়াই করার শারীরিক ক্ষমতা তার এখন কম । তবুও কুহেলি নাছোড়বান্দা । তার ঘাবড়ালে চলবে না । যেভাবে হোক পুবালীকে উদ্ধার করা চাই । তা ছাড়া কুহেলির হাতে সময় খুব কম । ভাববার সময় নেই । তাই ভাল করে দুজন দুষ্কৃতির আক্রমণ করার ধরনটা বুঝে নিলো । কুহেলি নিশ্চিত, ওদের হাতে এই মুহুর্তে পিস্তল-জাতীয় কোনো বিপজ্জনক আগ্নেয়াস্ত্র নেই । শুধুমাত্র শারীরিক হম্বিতম্বি ! 
    প্রায় কাছাকাছি । কুহেলি পায়ের কাছের ইটটিকে দু-টুকরো করে একজনের মাথা টার্গেট করে ছুড়লো । দুষ্কৃতির মাথা ফেটে রক্ত । নিমেষেই মাটিতে গড়াগড়ি ।  আর একজন দুষ্কৃতি সমস্ত বলপ্রয়োগ করে কুহেলিকে ডান হাত দিয়ে ঘুষি ! ঘুষি মারবার আগেই কুহেলি পা দিয়ে কোমরের নীচে তাকে লাথি । লাথি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলো বেশী হম্বিতম্বি করা দুষ্কৃতিটা । তারপর কোনো কিছু ভাববার আগেই কুহেলির  বয়স্ক দুষ্কৃতির কাছ থেকে নেওয়া পিস্তল থেকে শূন্যে এক রাউণ্ড গুলি  ! সঙ্গে সঙ্গে বয়স্ক দুষ্কৃতিকে পিস্তল উঁচিয়ে  চিৎকার করে বললো, “এক্ষুণি পুবালীকে ছেড়ে দে, নতুবা পিস্তলের  একটা গুলিতে তোর প্রাণ শেষ !” ভয় পেয়ে বয়স্ক দুষ্কৃতি দিশেহারা । বাধ্য হলো  পুবালীকে ছেড়ে দিতে । পুবালীকে কাছে পেয়ে কুহেলির চিৎকার, যে যেখানে যেভাবে আছিস, চুপচাপ থাক । নড়াচড়া করেছিস তো পিস্তলের গুলিতে সব কটাকে শেষ !”
      ছুটে পাটের জমির আড়াল দিয়ে কুহেলিরা দৌড়াচ্ছে । পেছনে পেছনে দুষ্কৃতিরা তিনজন । শূন্যে আবার এক রাউণ্ড গুলি !  কিন্তু দুষ্কৃতিরা পিছু হটছে না । কুহেলি  আতঙ্কে কাহিল হয়ে পড়লো । পুনরায় দুষ্কৃতিদের হাতে ধরা পড়লে ভয়ংকর বিপদ ! অগ্রিম বিপদের কথা ভেবে কুহেলির হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে । কোনো লোকজনের দেখা নেই । শুধু ধু ধু  মাঠ ! দূরে তাল গাছের সারি দেখে কুহেলির অনুমান, নিশ্চয় পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেছে । কুহেলি ভাবছে, জমিতে বড় বড় পাট গাছ  থাকায় তাদের পালাতে সুবিধা ।  কিছুটা যাওয়ার পর পরেই বড় বড় পাটের জমি । সুতরাং পাট গাছের আড়াল-আবডালের জন্য  লুকিয়ে পালাতে  তাদের অনেকটাই সুবিধা  ।  পুবালী ও কুহেলি, দুজনে পাটের জমিতে  দুষ্কৃতিদের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে দুষ্কৃতিরাই কীভাবে যেনো তাদের টপকে ভিন্ন পথ দিয়ে আগে চলে গেলো । সুযোগ পেয়ে কুহেলি পেছন দিকের অন্য রাস্তা ধরে ঘুরপথে সোজা নদীর কিনারে । নদী কেমন বা নদী কোথায় গেছে ভাববার আগেই দুজনে নদীতে ঝাঁপ । সাঁতার কাটতে গিয়ে হাতের মোবাইল, পিস্তল সমস্ত কিছু জলে ডুবে উধাও  ! নদী পার হতে অনেক সময় লেগে গেলো । তবুও  রক্ষে, দুষ্কৃতিরা একটুও টের পায়নি । অবশেষে কুহেলিরা সাঁতার কেটে নদী পার হলো ।  নদীর পারে উঠেই দূরে যাত্রী বোঝাই বাস যেতে দেখে কুহেলি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে পুবালীর দিকে তাকিয়ে বললো, “এবার আমরা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাবো !”  কিন্তু পুবালির দিকে তাকিয়ে কুহেলি অবাক ! মেয়েটা কাঁদছে । তারপর ক্রন্দনরত অবস্থায় কুহেলির কাঁধে মাথা রেখে পুবালী বললো, “আমি আর পারছি না ।“ কুহেলি সান্ত্বনা দিয়ে পুবালীকে মানসিকভাবে শক্ত হতে বললো । পুবালীকে আরও বললো, “তাদের বিপদ এখনও কাটেনি । নিরাপদ আশ্রয়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত তাদের বিপদের ঝুঁকি ষোলোআনা ।“ 
     রাস্তায় হাত দেখানো মাত্র একটি খালি লরি দাঁড়িয়ে পড়লো  । 
    “কোথায় যাবেন দিদি ?” লরির ড্রাইভার জানতে চাইলো ।
     পরের শহরটায় ।
    পরের শহরটা কোচবিহার । এখান থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার । আমরা তার আগে অন্য রাস্তা ধরে অন্যত্র চলে যাবো । আপনারা বরং লরি থেকে নেমে অন্য বাসে কোচবিহার পৌঁছাতে পারবেন ।
    মাথা নেড়ে সায় দিলো কুহেলি । আগে তাদের এখান থেকে পালানো দরকার !  নতুবা ঐ দুষ্কৃতিরা আবার ধাওয়া করলে আর রক্ষে নেই ।  ওদের নেটওয়ার্ক দেশের সর্বত্র । কুহেলিদের  খবর তাদের কানে গেলে যেভাবে হোক তারা কুহেলিদের খুঁজে বের করবেই ।  সুতরাং অযথা সময় নষ্ট না করে পুবালী ও কুহেলি লরিতে উঠে বসলো । লরি ছুটলো কোচবিহারের দিকে ।
    এদিকে পুবালী সোজা হয়ে  বসে থাকতে পারছে না । তার খুব ক্ষিদে ।  তার ক্ষিদের কথা অন্তত তিনবার কুহেলিকে বলা হয়ে গেছে । ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় জেরবার পুবালী । ঠিক মতো বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে ।  কুহেলি সান্ত্বনা দিয়ে বললো, “কোচবিহারে পৌঁছালে তবেই  খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা  ।“ 
      কোচবিহারে পৌঁছে কুহেলিদের চোখে শর্ষে ফুল । কিচ্ছু চেনে না । তার উপর অঝোর ধারায় বৃষ্টি । ভারী বর্ষণের দরুন রাস্তা দিয়ে চলাচলে অশান্তি । পান্তা মাসির কাছে একবার শুনেছিল, কোচবিহার শহরের প্রাণকেন্দ্রস্থলে মদনমোহনের মন্দির । ১৮৮৯ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন । রাজবংশের পারিবারিক দেবতা “মদনমোহন” কোচবিহার মানুষের প্রাণের ঠাকুর ।  সেখানে সর্বক্ষণ ভক্তদের ভিড় । মন্দিরের দরজা  সকাল ৯টায় খুলে রাত্রি ৮টায় বন্ধ ।   প্রয়োজনে ভক্তদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে । তবে সে শুনেছিল প্রসাদ পেতে গেলে নাকি ১০টাকার কুপন কাটতে হয় । কুহেলি প্রমাদ গুণলো, এই মুহুর্তে মদনমোহনের মন্দিরে আশ্রয় নেওয়াটা তদের ক্ষেত্রে নিরাপদ ও যুক্তিযুক্ত । 
    এদিকে পুবালী কুহেলিকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে থানায় সমস্ত ঘটনা জানিয়ে দেওয়ার জন্য ।  এই মুহূর্তে পুলিশকে রিপোর্ট করার ঘোর বিরোধী কুহেলি । কেননা থানায় জানালে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা । পুলিশ মহল নারী পাচার চক্রের উদ্ধারের তাগিদে কুহেলি ও পুবালীকে  তুলে নিয়ে পুলিশি হেপাজতে রেখে  জেরা শুরু করতে পারে । পুলিশি জেরার মুখে পড়লে আরেক হ্যাপা ! অশান্তির শেষ নেই । নানান ধরনের প্রীতিকর ও অপ্রীতিকর প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে হেনস্তা করতে পারে । যদিও পুবালীর চাইছে, পুলিশ আমাদের জেরা করুক এবং নারী পাচার চক্র ধরুক । কিন্তু কুহেলি ধারণা, নারী পাচার চক্র উদ্ধারে  ইতিমধ্যে পুলিশ চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছে । তাঁরা চিরুনি তল্লাশি যেভাবে করছে, করুক । সুতরাং পুলিশের কাজ পুলিশ করুক । তারা আগে সুস্থ ও স্বাভাবিক হোক এবং নিরাপদে বাড়ি ফিরে যাক, তারপর থানায় গিয়ে রিপোর্ট করবে । যার জন্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কুহেলি জগন্নাথের সাথে যোগাযোগ করছে না । জগন্নাথের সাথে যোগাযোগ করলে তাদের ফিরে যাওয়া নিশ্চিত হতো জেনেও কুহেলি নীরব ! একটাই কারণ, এখন তাদের শরীরে অতিরিক্ত ধকল নেওয়া খুব কঠিন । তাই পুবালীকে বুঝিয়ে পুলিশি ঝঞ্ঝাট এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিলো । অবস্থা স্বাভাবিক হলে অবশ্যই তারা পুলিশকে জানাবে । 
      পুলিশকে না জানানোর ক্ষেত্রে কুহেলির মাথায় অন্য একটি চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে । নারী পাচার চক্রের নেটওয়ার্ক বিশাল বড় । তাদের চেলা-চামুণ্ডা নিশ্চয় কোচবিহার জেলার আনাচে-কানাচে ঘুরপাক খাচ্ছে  ।  উত্তরবঙ্গের মেয়েদের তুলে নেওয়ার খবর বেশী শোনা যায় । কুচক্রীদের নাকি উত্তরবঙ্গের মেয়েদের কব্জা করা  সহজ এবং ঝুঁকিও  কম ।  সেইজন্য উত্তরবঙ্গে নারী পাচারকারীদের বিচরণ যত্রতত্র । তারা যদি টের পায় কুহেলিরা থানায় যোগাযোগ করছে,  তাহলে অবধারিতভাবে  পুনরায় কুহেলিদের পাচার চক্রের কবলে পড়তে হবে । সেই সময় দুষ্কৃতিরা  কীভাবে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কুহেলিদের তুলে তাদের ডেরায় তুলবে কাক-পক্ষীও টের পাবে না  । এই ব্যাপারে কুহেলির  অভিজ্ঞতা যথেষ্ট । যদিও পুরোটাই মেয়ে-মহল থেকে শোনা । তবুও কুহেলি খুব সতর্কভাবে নিজেদের চালনা করতে চায় ! কিছুতেই পুনরায় নারী পাচার চক্রের খপ্পরে পড়তে চায় না । কুহেলি এখন মানসিকভাবে শক্ত । এই মুহূর্তে সে বুঝতে পারছে, তারা এখন নারী পাচার চক্রের হাত থেকে মুক্ত । বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত তাদের খুব সাবধানে গা-ঢাকা দিয়ে চলতে হবে । তারপর বাড়ি ফিরে শক্তভাবে নিরাপদে বাঁচতে চায়  কুহেলি ।  
         কুহেলি অবাক ! এত বড় নারী পাচার চক্র দেশের আনাচে-কানাচে সক্রিয়, সেটা নিয়ে দেশের সুশীল নাগরিক সমাজ নীরব ! তাঁদের মুখে কুলুপ আঁটা । কোনো টু শব্দ নেই । অথচ বর্তমান নাগরিক সমাজ ভালভাবেই জানেন, যেসব মেয়েরা পাচার হচ্ছে তারা তাদের হয় প্রতিবেশী নতুবা পাশের গ্রামের মেয়ে । পরোক্ষভাবে  তাঁদের হয় বোন, না হয় মেয়ে সমতুল্য ।  অবাধে পাচার হচ্ছে । পুলিশকে দোষ দিয়ে তাঁরা নীরব থাকছেন ! এখানেই কুহেলির খটকা ! তাহলে কী সুশীল নাগরিক সমাজ এটাকে প্রছন্ন মদত দিচ্ছেন ? হৈচৈ হচ্ছে না কেন ? শুধুমাত্র যবতী মেয়েরাই পাচার হচ্ছে না, পাচারের তালিকায় মেয়ে শিশু থেকে বুড়ি সকলেই আছে । সুতরাং  মেয়েদের পাচারের মতো জঘন্য ও ঘৃণ্য কাজ সমাজ থেকে খুব শীঘ্র উপড়ে ফেলা উচিত । নতুবা পাচারকারীদের শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে । কুহেলি এইসব নিয়ে যতো ভাবে, ততই হতাশায় ভোগে । 
      কুহেলির চোখে জল । এই বিশাল পৃথিবীতে সে বেঁচে থাকতে চায় । বেঁচে থাকার জন্য কারও উপর নির্ভরশীল নয় । একান্ত আপন মানুষ তাকে ছেড়ে চলে গেছে । গোটা পৃথিবীতে কুহেলি এখন একা । বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে লড়াইটা তার একার । পাশে কেউ নেই । তবুও এক শ্রেণীর কুচক্রী মানুষ তার বেঁচে থাকার পথে বাধা । চেষ্টা করলেও তার একার দ্বারা এই কুচক্রী মানুষদের ধ্বংস করা অসম্ভব । এইজন্য জনমত দরকার । সবচেয়ে কুহেলির আশ্চর্য লাগে, মিডিয়াও সেভাবে নারী পাচার নিয়ে সোচ্চার না । যার জন্য মেয়েদের অবাধে পাচার করার ক্ষেত্রে এক শ্রেণীর অসাধু চক্র ভীষণভাবে সক্রিয় ।  মাথা চাড়া দিচ্ছে । সবাই জেনেবুঝে চুপচাপ । এখানেই কুহেলির দুশ্চিন্তা ! তার দুশ্চিন্তা আরও বাড়ছে ভবিষ্যতের কথা ভেবে । কেননা কুহেলি সারা জীবনের মতো নারী পাচার চক্রের  কাছে টার্গেট হয়ে গেলো । তারা ঝোঁপ বুঝে যেকোনো মুহূর্তে কোপ মারতে পারে । সুতরাং তার বেঁচে থাকাটাই এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জ । মানুষ চ্যালেঞ্জ দেয়, বিভিন্ন কারণে – যেমন পড়াশুনায় রেজাল্ট ভাল করার ক্ষেত্রে, চাকরিতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে, দুইজন বন্ধুর মধ্যে রেষারেষি করে ভালবাসার মানুষটাকে ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে, অথচ অন্ন বাসস্থানের কথা ছেড়ে দিয়ে  কুহেলির জীবনে  নারী সত্বা বাঁচিয়ে বেঁচে থাকাটাই এখন চ্যালেঞ্জ ! 
                                                                      ( চলবে )