রাণী রাসমণির দুর্গা পুজো।

0
637

১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে রাণী রাসমণির শ্বশুরমশাই প্রীতরাম দাস তাঁর জানবাজার জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন। পরে উত্তরাধিকার সূত্রে রাণী রাসমণির সময় তা উৎসবের আকার নেয়। লোকশিক্ষার জন্য রাণী রাসমণি তাঁর পারিবারিক দুর্গাপুজোয় যাত্রাপালা অভিনয়ের সূচনা করেন।

দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন যেই রাসমণি, তাঁর বাড়ির পুজো স্বাভাবিকভাবেই একটু অভিজাতগন্ধী। জানবাজারের সাত মহলা বাড়িটিতে তিনশো মতো ঘর আর দুর্গাদালান নিয়ে ব্রিটিশ-শাসিত পরাধীন ভারতেই উনিশ শতকের সূচনায় দেবীর অকালবোধন অনুষ্ঠিত হতো। জানবাজারের বাড়ির প্রথম পুজোটি শুরু হয় রানি রাসমণির শ্বশুরমশাই বিখ্যাত জমিদার এবং ব্যবসায়ী প্রীতরাম মাড় (দাস)-এর হাত ধরে। আমতার ঘোষালপুরের আদি বাড়ি থেকে খুব অল্প বয়সে অনাথ হয়ে দুই ভাইয়ের সঙ্গে কলকাতার জানবাজারের এই বাড়িতে আসেন প্রীতরাম আর এখান থেকে ডানকিন সাহেবের নুনের কারবারিতে মুহুরীর চাকরিতে যোগ দেন তিনি। বেলেঘাটার সেই সেরেস্তায় কাজ করতে করতেই ডানকিন সাহেবের মৃত্যুতে বাধ্য হয়েই অন্য জায়গায় কাজ খুঁজতে হল প্রীতরামকে। তারপর বিভিন্ন রকম ব্যবসা, নাটোরের দেওয়ানের কাজ করে যা পয়সা জমিয়েছিলেন তিনি তা দিয়ে ১৮০০ সালে তৎকালীন সময়ে উনিশ হাজার টাকায় মকিমপুর এলাকাটি নাটোরের রাজার থেকে কিনে নেন প্রীতরাম। সেই সময়কালেই তৈরি হয় জানবাজারের বিরাট প্রাসাদোপম বাড়িটি। প্রীতরাম মাড় তখন কলকাতার বিখ্যাত ডাকসাইটে ব্যবসায়ী। ১৮০৫ সালে নির্মাণকার্য শুরু হয়ে পনেরো বছর ধরে লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে ১৮২০ সালে স্থায়ীভাবে নির্মিত এই বাড়ির ঠাকুরদালানের সৌন্দর্য দেখতে লোক ভিড় করতো তখন। বাড়ির ভিতরেই সেসময় ছিল একটি পুকুর, ঠাকুরঘর, নাটমন্দির, দেওয়ানখানা, গোশালা, আস্তাবল, কাছারিঘর, বাগান আর তিনশো থাকার ঘর। প্রীতরামের উদ্যোগেই ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে জানবাজারের বাড়িতে শুরু হয় দেবী দুর্গার পূজা। তাঁর মৃত্যুর পরে পুত্রবধূ রানি রাসমণি এই পূজার দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নেন। ভক্তিভরে রাসমণি ঠাকুরদালানে শাস্ত্রপাঠের আসর, পুরাণ-চণ্ডীপাঠ, এমনকি রামায়ণ-মহাভারত পাঠও করাতেন। দুর্গাপুজোয় যাত্রাপালার আয়োজনও করা হতো বলে জানা যায়। পালাগান, কথকতা, কবিগানের লড়াই সব মিলিয়ে উনিশ শতকের সন্ধিলগ্নের বৈশিষ্ট্যগুলি সবই জানবাজারের রানি রাসমণির পুজোয় দেখা যেতো। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, রামরাম বসু, ভোলা ময়রা প্রমুখ বিখ্যাত কবিয়ালরা এই বাড়িতে এসে কবির লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন বলে জানা যায়। রথের দিন এই বাড়িতে দেবী মূর্তির কাঠামো পূজা করা হয়। ডাকের সাজের একচালার প্রতিমার মুখ তৈরি হয় হাতে এঁকে। রানির পুজোর এই দেবী মূর্তির রঙ হয় তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ, শ্বেতশুভ্র মুখের দেবী সরস্বতী আর সবুজ বর্ণের অসুরের সমাহারের মাঝে দেবী মূর্তিটি প্রায় বাইশ ফুট দীর্ঘ হয়ে থাকে। পূজার বহুদিন আগে থেকেই এখানে আহমেদপুরের মৃৎশিল্পীরা এসে থাকেন মূর্তি তৈরির জন্য। মহালয়ার পর প্রতিপদ থেকেই পূজার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় এখানে। ষষ্ঠীর দিন দেবীর গায়ে গয়না-অলঙ্কার পরিয়ে দেবীর বরণ হয়। আর ঠিক এইদিনেই কলাবৌ স্নানকে ঘিরে ব্রিটিশ সাহেবের সঙ্গে কলহ বেধেছিল। রানি রাসমণির প্রধান পুরোহিত সেই ষষ্ঠীর ভোরে এসে রানিকে জানান যে কলাবৌ স্নানের সময় ঢাক-ঢোলের শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মামলা ঠুকেছেন এক ব্রিটিশ সাহেব। পরেরদিন আরো লোকলস্কর আর বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে রানি গঙ্গাস্নানে পাঠান মহিলাদের। তাতে আরো ক্ষুব্ধ হন সাহেব। এমনকি পঞ্চাশ টাকা জরিমানাও হয় রানির। এর প্রতিশোধ নিতে বাবুরোডের দুপাশে বাঁশের খুঁটি পুঁতে গাড়ি-ঘোড়া যাওয়ার পথ আটকে দেন রানি রাসমণি। অবশেষে রানির সঙ্গে মীমাংসা করে নেন সেই সাহেব আর এই ঘটনা থেকেই লোকমুখে প্রচলিত হয়ে যায় শুরুর ছড়াটি। রাসমণির পুজোয় সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিন দিনই চলে কুমারীপুজো। আর দশমীর বিসর্জনের দিন বিশেষ আকর্ষণ ছিল এই বাড়ির কুস্তি প্রদর্শনীর। দেশ-বিদেশ থেকে কুস্তিগীররা এসে কুস্তি লড়তেন এইদিন। বিজয়ীদের বকশিশ বা পুরস্কারও দেওয়া হতো জানবাজারের বাড়িতে। দেবীকে পুজোর কয়দিন নুন ছাড়া লুচি ও পাঁচরকম ভাজা ভোগ দেওয়া হয়, দেওয়া হয় বিশেষ মাতৃভোগ মিষ্টি, খাজা, গজা বা নাড়ুও। আগে বলি প্রথা চালু থাকলেও এখন চালকুমড়ো ও আখ বলি হয় শুধু। 
।। সংগৃহীত ইন্টারনেট।।