পুজো সামনে । বিশ্বকর্মা পুজো সদ্য শেষ । গণেশ পুজো চলছে । যদিও মহারাষ্ট্রে গণেশ পুজোর ধুমধাম অবর্ণনীয় ! তবুও দেশের সর্বত্র গণেশ পুজোর জনপ্রিয়তা ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী ! অন্যদিকে মায়ের আগমনী সুর । চারিদিকে কাশবন । সাদা কাশ ফুল ইঙ্গিত দিচ্ছে মায়ের আগমন । বাঙালির বড় পুজো, দুর্গা পুজো । সেই দুর্গা পুজো আগত । সমানে লাইন দিয়ে রয়েছে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো, ভাই-ফোঁটা, ছট পুজো, কার্তিক পুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো, রাস উৎসব । এখানে উল্লেখ থাকে যে, কাটোয়ার কার্তিক পুজো বা কার্তিক লড়াই, নবদ্বীপের রাস উৎসব, কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো বেশী জনপ্রিয় । প্রত্যেকটি পুজোর ক্ষেত্রে মাটির প্রদীপ, পুজোর একটি অঙ্গ ! এটা অনস্বীকার্য যে, মাটির প্রদীপ হিন্দুধর্মালম্বী মানুষের কাছে খুবই পরিচিত । যে কোনো পুজোর ক্ষেত্রে মাটির প্রদীপের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখযোগ্য, বরং গুরুত্বপূর্ণ । গৃহদেবতাসহ যে কোনো পুজোর সময় মাটির প্রদীপের প্রজ্জ্বলন মান্ধাতা আমল থেকে আজও পরম্পরা । তবুও বিশ্লেষণ করতে তর্ক অবশ্যাম্ভাবী । আগের পুজোপার্বন বা বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে তুলনা করলে বর্তমান সময়ে মাটির প্রদীপ ব্যবহারের দৈনদশা প্রকট । তবুও মাটির প্রদীপ ঠাকুর পুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । বলা চলে প্রবহমান ঐতিহ্য ।
দিন বদলাচ্ছে । সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনের ঘনঘটা বর্ধমান । মানুষের রুচিবোধও দিন দিন পাল্টাচ্ছে । ফলে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে রুচি পাল্টানোর প্রভাব পড়ছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনেও । মাটির তৈরি প্রদীপ তার ব্যতিক্রম নয় । যেমন মাটির প্রদীপের পরিবর্তে পিতলের তৈরি প্রদীপ, স্টিলের তৈরি প্রদীপ, মোমবাতি, ইলেক্ট্রিক লাইট, ইত্যাদির ব্যাপক ব্যবহার নিত্যনৈমিত্তিক ।
প্রথমেই মনে পড়ে মা, কাকিমা, জেঠিমা, দিদিমা, ঠাকুমাদের কথা । সূর্যাস্তের পরে সন্ধেবেলায় বাড়িতে তুলসীতলায় তাঁদের প্রদীপ জ্বালানোর রেওয়াজ ছিল বংশ পরম্পরা । গৃহবধুদের নিত্যকালীন রুটিনের মধ্যে সন্ধেবেলা তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালানো ছিল অন্যতম । গৃহবধু শাড়ি পরে একহাতে মাটির প্রদীপ এবং অন্যহাতে কখনও ধুনুচি নিয়ে গলায় শাড়ির আঁচল জড়িয়ে তুলসীতলায় গড় হয়ে প্রণাম করতেন । এটা ছিল তাঁদের ভক্তিভাবের অন্যতম নিদর্শন । তাই ঠিক সেই সময় বাড়ির অন্যান্যরাও জোড় হাতে ঠাকুরের উদ্দেশে প্রণাম জানাতেন । কেউ কেউ মাটির প্রদীপ ও ধুনুচি হাতে নিয়ে সমস্ত বাড়িটায় ধূপধুনা দেওয়ার পর তুলসীতলায় শঙ্খ বাজিয়ে প্রণাম জানাতেন । গেরস্ত বাড়ির কল্যাণ কামনায় মাটির প্রদীপ দিয়ে সন্ধ্যা-বাতি জ্বালানো ছিল সাংসারিক জীবনের অন্যতম অঙ্গ । ঈশ্বর আরাধনার অন্যতম নিদর্শন ।
কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে সন্ধেবেলায় মাটির প্রদীপ জ্বালানোর রেওয়াজ অবলুপ্তির পথে । আগেকার একান্নবর্তী পরিবার বর্তমানে দূরবীন দিয়ে দেখার মতো । গেরস্ত বাড়ির সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া কঠিন । পাঁচ-কাঠা, দশ-কাঠা, এক বিঘা জমির উপর বাড়ির হদিস পাওয়া ভীষণ কষ্টসাধ্য ! পরিবর্তে ফ্লাটের রমরমা । আয়তনের পরিমাণ অপরিসর । ঠেসাঠেসি জীবনযাপন এখন গা-সহা । সেখানে তুলসীতলা বেমানান । তুলসী-মন্দিরের চিন্তাও, বলা চলে দুশ্চিন্তার ন্যায় ! ফলে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে সন্ধ্যা-বাতি দুঃস্বপ্ন । বর্তমান প্রজন্মের কাছে মাটির প্রদীপের কদর তলানীতে ! এখানেই আশঙ্কা !
বিভিন্ন পুজা-পার্বণে মাটির প্রদীপের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । দুর্গা পুজোর সময় সন্ধি পুজোতে একশো আটটা মাটির প্রদীপ জ্বালানো, পুজোর একটি বিশেষ অঙ্গ । কালী পুজোয় মাটির প্রদীপের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো । শ্রাদ্ধ বাড়িতে পুরোহিতদের প্রথম পছন্দ মাটির প্রদীপ । কোনো সংকীর্তন অনুষ্ঠানে মাটির প্রদীপের প্রজ্জ্বলন হামেশাই দেখা যায় । যেখানে মাটিতে আলপনা দিয়ে কলাগাছ লাগিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান, সেখানে মাটির প্রদীপের উপস্থিতি অনিবার্য । যদিও বর্তমান জমানায় বেশীর ভাগ মানুষ বড় ‘হল’ ঘর ভাড়া করে বিয়ের অনুষ্ঠান সারছেন । আবার যারা হোটেলে বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করছেন, তাদের আগেই সাবধান করে দেওয়া হয় মাটির প্রদীপের প্রজ্জ্বলন স্বল্প সময়ের জন্য এবং খুব সাবধানে ! কেননা দুর্ঘটনার ভয় ।
এছাড়া বাঙালি-অবাঙালিদের মধ্যে মাটির প্রদীপ জ্বালীয়ে দেওয়ালি অনুষ্ঠান পালন করা চিরাচরিত প্রথা । বাড়ির উঠোনে আলপনা দিয়ে অনেকেই একশত একটি মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে দীপাবলি অনুষ্ঠান করেন । যদিও এই প্রথা ক্রমশ কমতে শুরু করেছে । সেই মাটির প্রদীপের জায়গায় মোমবাতি দখল করে নিচ্ছে । ফলে মাটির প্রদীপের দৈনদশা ক্রমবর্ধমান ।
মাটির প্রদীপের ব্যবহারের পরিবর্তনও সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে । মাটির প্রদীপ বিভিন্ন ধরনের । কুমোরেরা তাঁদের শিল্পকলার প্রেক্ষাপটে নতুন নতুন সৃষ্টির নিরিখে প্রদীপ তৈরি করেন । অনেক মানুষ বড় প্রদীপ ব্যবহারে অভ্যস্ত । পেছনে যুক্তি একটাই, প্রদীপটির প্রজ্জ্বলন ঘটবে অনেকক্ষণ । কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর রাত্রিতে অনেক গৃহস্তের বাড়িতে সারা রাত্রি মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা নাকি শুদ্ধ ভক্তির নিদর্শন ! কারণ তাঁদের বিশ্বাস, রাত্রির কোনো এক সময়ে মা-লক্ষ্মী পদব্রজে বাড়ি বাড়ি প্রদক্ষিণ করবেন । সেই সময় প্রদীপ না জ্বালোনো থাকলে মা-লক্ষ্মীর রুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা । তাতে গৃহের অমঙ্গল ! সংসারে ক্ষতির সম্ভাবনা ! সংসারে অলক্ষ্মীর ছায়ার পূর্বাভাস !
ছোট ছোট প্রদীপে অধুনা সরষের তেলের পরিবর্তে মোমের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে । মোমের ব্যবহার ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী । যেমন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে মোম লাগানো প্রদীপের ব্যবহার সর্বজনবিদীত । গুয়াহাটিতে কামাক্ষ্যা মায়ের মন্দিরে মোম লাগানো প্রদীপ ও ধূপবাতির প্রজ্জ্বলন মায়ের আরাধনার অঙ্গ । সেইরকম হরিদ্দ্বারে সন্ধেবেলায় গঙ্গার ঘাটে বহু মানুষের ঢল । কেননা গঙ্গার পারের মানুষ গঙ্গার জলে ফুল-বেল-তুলসীপাতা সহ মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে ভাসিয়ে দিয়ে মা গঙ্গার পুজো করেন । সেখানে মাটির প্রদীপের প্রজ্জ্বলন বিশ্বব্যাপী পরিচিতি । উদাহরণ আরও অনেক । এতেই বোঝা যায় মাটির প্রদীপের কদর এখনও সর্বত্র । বংশগত পরম্পরা । এই পরম্পরা সহজে খণ্ডাবার নয় !
পথচলতি মানুষ সন্ধ্যাবেলায় রাস্তার পাশের মন্দিরে বা শনি মন্দিরে মাটির প্রদীপ জ্বালানো দেখলে হাত কপালে ঠেকিয়ে মন্দিরের সেই ঠাকুরের উদ্দেশে প্রণাম করেন । যদিও ইদানীং ওইসব ঠাকুরের মন্দিরে বা শনি মন্দিরে মোমবাতি, নানান রংয়ের বিজলি বাতির সমারোহ ঘটেছে, তবুও মাটির প্রদীপ জ্বালানোর গতানুগতিক অভ্যাস মানুষের মধ্যে এখনও উজ্জ্বীবিত । বিভিন্ন দোকানের ঠাকুরের স্থানে বিজলি বাতির প্রাধান্য বেশী । কারণ জানতে চাইলে তাঁরা বলে থাকেন আগুন লাগার বিপদের কথা ভেবে বিজলি বাতির ব্যবস্থা । এসত্বেও হালখাতার দিন দোকানে দোকানে গণেশ পুজোর (অনেক দোকানের ক্ষেত্রে লক্ষ্মী পুজো) স্থানে মাটির প্রদীপের ব্যবহার এখনও বর্তমান ।
শিবরাত্রি, ষষ্ঠীপুজা, ইত্যাদির পুজোর উদ্দেশে যখন গৃহবধূরা বা মেয়েরা পুজোর নৈবেদ্য সাজিয়ে পুজো দিতে যান, সেই সময় তাঁদের ঐ পুজোর নৈবেদ্যের থালায় মাটির প্রদীপ বিশেষভাবে শোভাবর্ধন করে এবং অন্তরে ভক্তিভাবের উদ্রেক ঘটাতে উদ্বুদ্ধ করে ।
মাটির প্রদীপ মাটি দিয়ে কুমোরেরা তাঁদের শিল্পকলার প্রদর্শন ঘটিয়ে তৈরি করেন । কুমোর সম্প্রদায়ের এটা একটা জাতিগত ব্যবসা । তাঁরা মাটি দিয়ে বিভিন্ন গৃহের সরঞ্জাম তৈরির পাশাপাশি মাটির প্রদীপ তৈরিতে অভ্যস্ত । যদিও অন্যন্য সরঞ্জাম যেমন মাটির হাঁড়ি, কলসি, থালা, বাটি, গ্লাস, ইত্যাদির ব্যবহারও বর্তমানে অবলুপ্তির পথে । তথাপি তাঁরা হাল ছাড়ার পাত্র নন । এখনও মাটির চায়ের কাপ, পুজোর ঘট, প্রদীপ, সরা, প্রতিমা, পুতুল, ইত্যাদির কদর আমাদের দেশের সর্বত্র ।
এত কিছুর মধ্যে মাটির প্রদীপের বাণিজ্যে কুমোর সম্প্রদায়ের মানুষ কতটা সফল, সেটা এখন প্রশ্ন চিহ্নের মধ্যে ? সামগ্রিকভাবে মাটির সরঞ্জাম বেচা-কেনার নিরিখে, কুমোর সম্প্রদায়ের মানুষের দৈন্যদশা সতত প্রকট । এই প্রকট থেকে বেরিয়ে আসা খুবই জরুরি । তাঁদের উন্নয়নে জনমত তৈরি করা সময়োচিত ।
একটা বিষয় পরিষ্কার, আবহমানকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত মাটির প্রদীপের কদর নিরবিচ্ছিন্নভাবে অটুট । যতই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগুক না কেন মাটির প্রদীপ তার নিজের জায়গা ধরে রেখেছে ভক্তির মাধ্যম হিসাবে । সুতরাং প্রতি ঘরে ঘরে মাটির প্রদীপের ব্যবহার বেঁচে থাক এবং মাটির প্রদীপের ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে আরও শুদ্ধ ভক্তির সঞ্চার ঘটুক ।
কলমে দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।