করম পুজা নিয়ে দুটি কথা : দিলীপ রায়।

0
218
      করম প্রধানত সৃষ্টির উৎসব, সৃজনের উৎসব । শরতের আগমনে শস্য ও সমৃদ্ধি কামনায় করম পরব বা করম উৎসব । ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশী বা পার্শ্ব একাদশীতে করম উৎসব পালিত হয় । এই বছর অনুষ্ঠিত হলো ২৫শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ । এই পরবের মূল আকর্ষণ হলো জাওয়া গান । বলা চলে, গানগুলো লোকসাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গ ।  
         এবার আসছি করম পরব প্রসঙ্গে । 
          করম পরব ভারতের ঝাড়খণ্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়,  আসাম, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এবং বাংলাদেশ ও নেপালে একটা ফসল কাটার উৎসব । এই উৎসবে করম দেবতার উপাসনা করা হয় । যিনি শক্তি, যুব ও যৌবনের দেবতা । করম পরব পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলা , ঝাড়্গ্রাম জেলা, বাঁকুড়া জেলা, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কুড়মি, ভূমিজ, রাজপুত, সরাক, লোহার বাউরি, বীরহড়, বীরনিয়া, খেরওয়ার, হো, খেড়িয়া, শবর, কোড়া মাহালি, পাহাড়িয়া, হাড়ি, বাগদি, বেদে, ঘাসি, লোধা ও বৃহৎ জনগোষ্ঠী সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, প্রভূতি সম্প্রদায়ের জঙ্গলভিত্তিক ও কৃষিভিত্তিক লোক উৎসব । 
        প্রকৃতির পুজা ও উর্বতার উৎসব । এই করম পরব প্রায় সাতদিন ধরে উদযাপন  হয় । কুমারী কন্যারা নিষ্ঠার সঙ্গে সাতদিন ধরে ব্রত পালন করেন, করম গাছের ডাল পুজা করেন এবং বপন করা হয় ভুট্টার বীজ । অঙ্কুরিত ভুট্টার চারা বা ‘জাওয়া’কে  উর্বতার প্রতীক হিসাবে দেখা হয় । মূলত এই করম উৎসবটি আদিবাসী ও সাঁওতাল জনজাতিদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয় ।
          মূলত গ্রামের অবিবাহিত কুমারী মেয়েরাই এই ‘করম’ ঠাকুরের উপাসক । শুক্লা একাদশীর সাতদিন আগে কুমারী মেয়েরা একত্রে বাঁশের বোনা ‘টুপা’ (ডালা) এবং বিভিন্ন ধরনের শস্যবীজ নিয়ে জড়ো হয় পার্শ্ববর্তী কোনো নদী, পুকুর বা জলাশয়ে  । সেখানে প্রত্যেকে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে সদ্যস্নাত ভিজে কাপড়ে নিজের নিজের টুপায় নদী  খাতের বালি ভর্তি করে বাড়ি থেকে আনা সেই শস্যবীজগুলো বোনে । তারপর পরস্পরের হাত ধরে টুপা’কে কেন্দ্র করে গোল হয়ে বিভিন্ন ধরনের আদিবাসী গান গাইতে থাকে ।
      এরপর শুরু হয় এই জাওয়া টুপাগুলোর পরিচর্যা । দিন দুয়েক পরেই বীজগুলির অঙ্কুরোদম হয় । জাওয়া পাতানো কুমারী মেয়েরা, জাওয়ার শুদ্ধতা বজায় রাখার নিরিখে সারা সপ্তাহ ধরে পালন করে কিছু রীতি নীতি । যেমন – একদিন তারা শাক খায় না, খাটিয়ায় ঘুমোয়  না, মাথায় তেল দেয়  না, চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ায় না, । এছাড়াও প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় মেয়েরা নিজ নিজ ডালাসহ গ্রামের এক জায়গায় জড়ো হয় । জাওয়াকে কেন্দ্র করে সারা সন্ধ্যা চলে করম গান ও নাচ ।
          সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের লায়া (পুরোহিত) এক জায়গায় করম ডাল পুঁতে করম ঠাকুরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন  । তৈরি হয় পুজোর বেদী । গ্রামের ব্রতকারী কুমারী মেয়েরা “করম ডালায়” পুজোর অর্ঘ্যরূপে ঘি, গুঁড়, আতপ চাল, মধু, ধূপ, একগাছি ধান আর ‘কাঁকুড়’, ইত্যাদি নিয়ে সমবেত হয়ে পুজো করে পরম ঠাকুরের । কামনা করে সোহাগী স্বামী পাওয়ার ও সন্তানবতী হওয়ার ।
   এবার আসছি করম পুজার প্রচলনের ইতিহাস প্রসঙ্গে । এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, করম পুজা প্রচলনের ইতিহাস নিয়ে মতভেদ রয়েছে । এখানে দুইটি মতের উল্লেখ করা হলোঃ-    
      এক সময় সাত ভাই ছিল যারা কৃষিকাজে কঠোর পরিশ্রমী । এমনকি তাঁদের  দুপুরের খাওয়ারও সময় থাকতো  না । তাই, স্ত্রীরা প্রতিদিন তাঁদের  দুপুরের খাবার  মাঠে নিয়ে যেতেন ।  একবার এমন হয়েছিল,  তাঁদের স্ত্রীরা দুপুরের খাবার নিয়ে মাঠে যাননি  । সাংঘাতিক ক্ষুধার্ত ছিলেন তাঁরা । সন্ধ্যায়  বাড়ি ফিরে দেখেন তাঁদের স্ত্রীরা বাড়ির  উঠোনে করম গাছের ডালের পাশে নাচ-গান করছেন  । এটা দেখে তাঁরা ক্রোধে অগ্নিশর্মা  । এক ভাই তাঁর মেজাজ হারিয়ে ফেলে করমের ডাল ছিনিয়ে নিয়ে নদীতে ফেলে দিলেন । করম দেবতাকে অপমান করা হয়েছিল  ।  ফলে তাঁদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে এবং  অনাহারে তাঁদের দুর্দশা অবস্থা  । একদিন একজন ব্রাহ্মণ (পুরোহিত) তাদের কাছে এলেন এবং সাত ভাই  পুরো ঘটনাটা তাঁকে  খুলে বললেন । এরপর সাত ভাই করম রানীর খোঁজে গ্রাম ছেড়ে চলে যান। তাঁরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে থাকেন  এবং এইভাবে খোঁজার পর  একদিন তাঁরা করম গাছের সন্ধান পান । পরবর্তীকালে, করম ঠাকুরের পুজো করেন ।  তারপর তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থার ক্রমশ উন্নতি ঘটতে থাকে । সুখ ও শান্তি ফিরে আসে ।  
  আর একটি মত হচ্ছে নিম্নরূপঃ 
   কথিত আছে, কর্ম ও ধর্ম দুই ভাই । দু’জনেই খুব পরিশ্রমী ও দয়ালু । কিছু দিন পর কর্মের বিয়ে হয়ে গেলো । তাঁর স্ত্রী ছিল অধার্মিক এবং অন্যদের বিরক্ত  করার মানসিকতা ।  আর এতে রাগান্বিত হয়ে কর্ম বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন । 
     তিনি চলে যেতেই সকলের কর্মফল ও ভাগ্যও  চলে গেলো এবং  মানুষের দুঃখ দুর্দশা বাড়তে লাগলো ।  মানুষের সমস্যা সহ্য করতে না পেরে ধর্ম  ভাইয়ের খোঁজে বেরিয়ে গেলেন  । কিছু দূর হাঁটার পর তাঁর জল তেষ্টা পেলো  এবং দেখলেন  আশেপাশে কোথাও জল নেই । দূরে  একটা নদী দেখতে পেলেন এবং  সেখানে গিয়ে দেখলেন, তাতেও জল নেই ।
    নদী ধর্মকে বলল, তোমার ভাই এখান থেকে চলে যাওয়ার পর আমাদের কর্মফল নষ্ট হয়ে গিয়েছে । গাছের সব ফল নষ্ট ! খুঁজে পেলে বলো, তাঁর কাছে আমাদের এই সমস্যার সমাধান চাই ।   তারপর  আরও একজন মহিলার সঙ্গে তাঁর দেখা  এবং তিনি বললেন, কর্ম চলে যাওয়ার পর থেকে রান্নার পরে পাত্রগুলি হাতে লেগে যেতে শুরু করে, এর সমাধান কী ?  আপনি কর্মকে জিজ্ঞাসা করুন এবং  তাঁকে বলতে বলুন ।
     ধর্ম আরও এগিয়ে গেলেন  । একটি মরুভূমিতে পৌঁছালেন । সেখানে তিনি দেখলেন,   কর্ম গরমে অস্থির । তাঁর শরীরে ফোসকা পড়েছে এবং তিনি যন্ত্রণায় কাতর । তাঁর অবস্থা অসহনীয় । ধর্ম কর্মকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন । কর্ম বললেন, “যে বাড়িতে আমার স্ত্রী মাটিতে কাদা ছুঁড়েছে  সেখানে আমি কীভাবে যাবো ?”  তখন ধর্ম প্রতিশ্রুতি দেন, আজকের পরে সে আর কখনও মাটিতে কাদা ফেলবে না । তখন উভয় ভাই বাড়ি ফিরে যেতে লাগলেন  ।
      ফেরার সময়   সেই মহিলার সঙ্গে দেখা  । কর্ম তাঁকে বললেন, ঐ মহিলা কখনও কোনও ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়াননি, তাই তার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটেছে । সুতরাং এটি তাঁর কর্মফল।
   একইভাবে সকলকে নিজের কর্মফলের কথা জানানোর পর কর্ম বাড়িতে এসে পুকুরে কর্মফলের ডাল লাগিয়ে পূজা করেন । তারপর সমগ্র এলাকার লোকেরা আবার সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলেন  এবং সমৃদ্ধি ফিরে আসল ।  সেই স্মরণে করম পরব  পালিত হয় । বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে করম পার্বণ একটি অন্যতম । এটি গ্রাম বাংলার এক অজানা অথচ বিশেষ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠী,  কুড়মিদের চা-বাগানের মানুষদের  সু-প্রচলিত করম পরব বা করম পুজা । এই বছর করম পুজাকে গুরুত্ব দিয়ে রাজ্য সরকার ছুটি ঘোষণা করেছেন ।   
     পরিশেষে বলা যায়, করম পরব আদিম জনগোষ্ঠীর ধারক ও বাহক । এর মধ্যে অন্যতম কুড়মি, সাঁওতাল, ভূমিজ, মুন্ডা, ওঁরাও, রাজোয়াড়, ডোম, ঘাসি প্রভৃতি  জনগোষ্ঠী । তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় কুড়মি সমাজের মধ্যে এর স্বীকৃতি, মান্যতা ও ব্যপকতা অবর্ণনীয় । আদিম জনগোষ্ঠী প্রায়  সকলেই প্রকৃতির পুজারী ।  ভাল করে এই উৎসবের  পুজানুষ্ঠান  ও পালনবিধি  লক্ষ্য করলে দেখা যাবে,  এটা একটা  বৃক্ষ পুজার অনুষ্ঠান । বৃক্ষকে জীবন্ত আত্মার অধিকারী হিসাবে স্বীকার করে  এবং তাকে কেন্দ্র করে বিশ্বাস-সংস্কার,  আচার-অনুষ্ঠানের  এক বিস্ময়কর সমাবেশ এবং শুদ্ধ ভক্তির পরম্পরা  ! 

কলমে : দিলীপ রায়।
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী (পিন-৭৪১২৩৫) / ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪
 (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত)