সারা ভারতে ‘ডিজি’ নামে সুপরিচিত ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, জীবৎকালেই কিংবদন্তির নায়কে প্রতিষ্ঠিত হন।।।

0
52

ভূমিকা—- ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন একজন বাংলা চলচ্চিত্র প্রযোজক, নির্দেশক, অভিনেতা। ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী, ধীরেন গাঙ্গুলী বা ডি জি নামেও পরিচিত, ছিলেন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার এবং পদ্মভূষণ সম্মানপ্রাপ্ত বাংলা চলচ্চিত্র জগতের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।  তিনি একাধিক চলচ্চিত্র নির্মাণকারী সংস্থা স্থাপন করেছিলেন, যথা ‘ইন্দো ব্রিটিশ ফিল্ম কোম্পানী’, ‘ব্রিটিশ ডমিনিয়ন ফিল্মস’, ‘লোটাস ফিল্ম কোম্পানী’ ইত্যাদি। পরবর্তীকালে তিনি নিউ থিয়েটার্সে যোগদান করেছিলেন। তিনি হাস্যরসাত্মক অনেক ছবির প্রযোজনা করেছিলেন। সারা ভারতে ‘ডিজি’ নামে সুপরিচিত ছিলেন তিনি। চিত্রশিল্পী, মূকাভিনেতা, বহুরূপী সজ্জায় বিশেষজ্ঞ, কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, অভিনেতা, কৌতুকশিল্পী এবং সংস্থা-সংগঠক ধীরেন্দ্রনাথ জীবৎকালেই কিংবদন্তির নায়কে প্রতিষ্ঠিত হন।

প্রাথমিক জীবন—–

১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব ও কৈশোর সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় না। যতদূর জানা যায় তিনি শান্তিনকেতনে লেখাপড়া করেছিলেন। পরে তিনি হায়দ্রাবাদ স্টেটের স্টেট আর্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কিছুদিন সেখানে কাটান। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়াকে বিবাহ করেন।  পিতা বামনচন্দ্র ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করে পিতৃভূমি বরিশালের আলতা গ্রাম থেকে কলকাতায় চলে আসেন। মেজদা নগেন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের জামাতা। কৈশোর কাটে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের স্নেহচ্ছায়ায়। ছবি আঁকায় ও অভিনয়ে সমান দক্ষ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সাথে অনেক নাটকে অভিনয়ও করেছেন। ১৯১০খ্রি. শান্তিনিকেতনের পাঠ শেষ করে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। বাড়ির গুরুজনদের তা পছন্দ না হওয়ায় বাড়ি ছেড়ে আলাদা থেকে পেইন্টিং ও মেক-আপ করে অর্থ উপার্জন করেন। মেক-আপ-এর কাজে তার দক্ষতা ছিল প্রসিদ্ধ, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তার লেখা বই ভাবকী অভিব্যক্তি-তেও (১৯১৫)।  পরে তিনি ব্রিটিশ ভারতের গোয়েন্দা সংস্থায় চাকরি করেছেন। এ বিষয়ে ব্রিটিশ ভারতে এবং পরে স্বাধীন ভারতে গোয়েন্দা সংস্থা সি আই ডি’র অফিসারদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। তিনি ডিটেকটিভদের নানা সাজে সজ্জিত করে দিতেন। পরে বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি ওই কাজ ছেড়ে দেন। তখন ছবি এঁকে তা বিক্রি করতেন। তাঁর চিত্রপুস্তক ‘ভাবের অভিব্যক্তি’, ‘বিয়ে’, ‘ভালবাসা’, ‘ফুলসজ্জা’, ‘রং-বেরং’ প্রভৃতি। বইগুলির রচনাও তাঁর নিজস্ব। ‘রং-বেরং’ বইটির অনেকগুলি চুটকি তাঁর হাস্যকৌতুক-সৃজনক্ষমতার সাক্ষ্য বহন করে।

কর্মজীবন—-

ডি জি’র ফোটোগ্রাফির বই তাঁকে জামশেদজি ফ্রেমজি ম্যাডানের সান্নিধ্যে নিয়ে আসে; ম্যাডান এরপর ডি জ়ি’র তৈরি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করতে রাজি হন। ডি জি আর ম্যাডান থিয়েটারের ম্যানেজার নীতীশ লাহিড়ী একসাথে ১৯১৮ সালে ইন্দো ব্রিটিশ ফিল্ম কোম্পানী শুরু করেন, যেটা ছিল বাঙ্গালী মালিকানার প্রথম ফিল্ম প্রোডাক্‌শন কোম্পানী। ১৯২১ সালে এই কোম্পানীর তৈরি প্রথম ছবি বিলাতফেরত (The England Returned) মুক্তি পায়। নীতীশ লাহিড়ীর পরিচালনায় নির্মিত এই হাস্যরসাত্মক নির্বাক ছবি বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করে। ১৯২২ সালে এঁদের আরও দুটি ছবি মুক্তি পায়—যশোদানন্দন আর সাধু অউর শয়তান।

কলকাতার বাইরে তিনি হায়দ্রাবাদ শহরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ডিজি লোটাস ফিল্ম কোম্পানি। পরে হায়দ্রাবাদের নিজামের সহযোগিতায় তৈরি করেছিলেন একটি ফিল্ম স্টুডিও ও দুটি সিনেমা হল। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে বোম্বেতে তৈরি ‘রাজিয়া বেগম’ ছায়াছবির প্রযোজক ছিলেন তিনি। এই ছবিতে মুসলিম রাজকুমারীর সাথে হিন্দু যুবকের প্রণয় কাহিনি ছিল। এই কারণে নিজাম তাঁকে হায়দ্রাবাদ থেকে বহিষ্কার করেন।

কলকাতায় ফিরে এসে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘ডিজি ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্মস’ নামক একটি নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণের কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় তাঁর সহযোগী ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। এরপর প্রমথেশ বড়ুয়া  চলচ্চিত্র নির্মাণে আধুনিক প্রযুক্তি প্রত্যক্ষ করার জন্য লন্ডনে যান এবং সেখান থেকে চলচিত্র নির্মাণের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর প্যারিসে কিছুদিন লাইট বয় হিসেবে কাজ করেন। প্যারিস থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের সামগ্রী ক্রয় করে তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে বড়ুয়া পিক্চার্স নামক ষ্টুডিও স্থাপন করেছিলেন। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে চলচ্চিত্রের শব্দ সংযোজনের কৌশল যুক্ত হওয়া শুরু হলে, ‘ডিজি ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্মস’ কোম্পানির বিলুপ্ত হয়। এবং ধীরেন্দ্রনাথ ‘বড়ুয়া পিক্চার্স কোম্পানি’তে যোগদান করেন।

চলচ্চিত্রের তালিকা—-

পরিচালক হিসেবে—–

কার্টুন (১৯৪৯), শেষ নিবেদন (১৯৪৮), শৃঙ্খল (১৯৪৭), দাবী (১৯৪৩), আহুতি (১৯৪১), কর্মখালি (১৯৪০), পথভুলে (১৯৪০), অভিসারিকা (১৯৩৮), অচিন প্রিয়া (১৯৩৮), হালবাংলা (১৯৩৮), Country Girl (১৯৩৬) (হিন্দীঃ দেহাতী লেড়কি), দ্বীপান্তর (১৯৩৬), বিদ্রোহী (১৯৩৫), Excuse Me, Sir (১৯৩৪), হালকথা (১৯৩৪), মাসতুতো ভাই (১৯৩৪), Night Bird (১৯৩৪), চরিত্রহীন (১৯৩১), টাকায় কি না হয় (১৯৩১) (ইংরেজিঃ Money Makes What Not), অলীকবাবু (১৯৩০) (ইংরেজিঃ Master Liar), Flames of Flesh (১৯৩০) (বাংলাঃ কামনার আগুন), বিমাতা (১৯২৩) (হিন্দীঃ বিজয়বসন্ত্‌, ইংরেজিঃ Stepmother), চিন্তামণি (১৯২৩), The Marriage Tonic (১৯২৩), সতী সীমন্তিনী (১৯২৩), বিজয়বসন্ত্‌ (১৯২৩), যযাতি (১৯২৩), যশোদানন্দন (১৯২২) (হিন্দীঃ শ্রীরাধাকৃষ্ণ), হরগৌরী (১৯২২), ইন্দ্রজিৎ (১৯২২), Lady Teacher (১৯২২)।

অভিনেতা হিসেবে—–

শেষ নিবেদন (১৯৪৮), বন্দিতা (১৯৪৫), হালবাংলা (১৯৩৮), Excuse Me, Sir (১৯৩৪), মাসতুতো ভাই (১৯৩৪), মরণের পরে (১৯৩১) (ইংরেজিঃ After the Death), টাকায় কি না হয় (১৯৩১) (ইংরেজিঃ Money Makes What Not), পঞ্চশর (১৯৩০) (ইংরেজিঃ Blind God / Five Arrows), অলীকবাবু (১৯৩০) (ইংরেজিঃ Master Liar), শঙ্করাচার্য (১৯২৭) (ইংরেজিঃ Renaissance of Hinduism), যশোদানন্দন (১৯২২) (হিন্দীঃ শ্রীরাধাকৃষ্ণ), Lady Teacher (১৯২২), সাধু অউর শয়তান (১৯২২), বিলাতফেরত (১৯২১) (ইংরেজিঃ The England Returned)।

লেখক/চিত্রনাট্যকার হিসেবে—

শেষ নিবেদন (১৯৪৮) (চিত্রনাট্যকার), বিলাতফেরত (১৯২১) (ইংরেজিঃ The England Returned) (লেখক)।

প্রযোজক হিসেবে—-

Flames of Flesh (১৯৩০) (বাংলাঃ কামনার আগুন), বিলাতফেরত (১৯২১) (ইংরেজিঃ The England Returned)।

প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননা—-

ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ  ডি জি ১৯৭৪ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মভূষণে সম্মানিত হন। ভারতে চলচ্চিত্র বিষয়ে দেওয়া সর্বোচ্চ সম্মান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার তাকে ১৯৭৫ সালে দেওয়া হয়।

মৃত্যু—-

তিনি জন্মগ্রহণ করেন কলকাতা শহরে, আর শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন এই শহরেই ১৮ নভেম্বর ১৯৭৮ সালে।

।।তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট ও উইকিপিডিয়া।।