আমাদের মূল্যবান সুন্দর মনুষ্য জীবনে হিন্দু সনাতন ধর্মে সন্ন্যাসী অর্থ যিনি সন্ন্যাস ব্রত, তথা সংসার ত্যাগ করেছেন, গৃহত্যাগী বা বিরাগী। মূলতঃ সংসারত্যাগ করে যারা ঈশ্বরের চিন্তায় মগ্ন থাকে বা ভিক্ষুধর্ম অবলম্বন করে তাদের সন্ন্যাসী বলে। আর স্ত্রীলিঙ্গ বলে সন্ন্যাসিনী।
প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের সমাজে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্ব পেত। সংস্কৃতে ‘গু’ শব্দের অর্থ অন্ধকার। ‘রু’ শব্দের অর্থ অন্ধকার দূরীকরণ। গুরু শব্দের অর্থ, যিনি শিষ্যদের অন্ধকার বা অজ্ঞতা থেকে আলোর দিশা দেখান সেই ব্যক্তি গুরু। যিনি অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যান তিনিই গুরু। গুরু আমাদের মনের সব সংশয়, সন্দেহ, অন্ধকার দূর করেন এবং নতুন পথের দিশা দেখান।
তবে গুরুদেব যদি আপনাকে *সন্ন্যাস দীক্ষা* দিয়ে থাকেন তো সংসার, গার্হস্থ্য জীবন করা যাবে না, কিন্তু সেটা হুট্ করে হয় না। আগে গুরুদেব যারা সন্ন্যাসি হতে চায় কেবল তাদেরকেই দেন ওই দীক্ষা। প্রায় বারো বছর বা আরও অনেক বছর সেবক, ব্রহ্মচারী, নৈষ্টিক ব্রহ্মচারী ইত্যাদি অনেক ধাপ অতিক্রম করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। প্রকৃত সন্ন্যাস, মানে যার আর কোনো বস্তুগত আকাঙ্ক্ষা নেই। সন্ন্যাস = সম + ন্যাস, সম্যক রূপে ত্যাগ, এটি আধ্যাত্মিক জীবনের শুরু।
সন্যাসীদের জীবন অত্যন্ত পবিত্র ও ধর্ম নির্দেশিত পথে চলে। কঠোর অনুশাসন, সাধনা, শাস্ত্রপাঠ বা স্ব্যাধ্যায় ও মোক্ষলাভ ই একজন সন্যাসীর জীবনের লক্ষ্য। এছাড়া তাঁর জীবনে উদ্দেশ্য “আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ” যেহেতু নিজের মুক্তি ও মানব কল্যাণ তাই তিনি মানুষ কে ধর্ম শিক্ষা দেবেন ও জনহিতকর কাজে যুক্ত থাকবেন। সাধারণত বিভিন্ন কারণে মানুষ সন্যাস গ্রহণ করেন। যেমন সংসারের প্রতি অনাসক্তি বা তীব্র বৈরাগ্য থেকে। কেউ কেউ সংসারে দুঃখ পেয়ে বা স্বজন হারানোর বেদনা থেকেও সন্যাস গ্রহণ করেন, আরও নানা কারণে।
একজন সন্ন্যাসীকে অবশ্যই শিকড় থেকে সমস্ত অপবিত্র গুণাবলি দূর করতে হবে এবং নিজেকে চিরকালের জন্য আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্তি দিতে হবে। ক্রমাগত সত্যের আলোয় পূর্ণ হতে হবে। একজন সন্ন্যাসীর সর্বোচ্চ কর্তব্য হল কোন কিছুর সাথে সংযুক্ত থাকুন এবং বেঁচে থাকুন এবং সমগ্র মহাবিশ্বের মঙ্গলের জন্য কাজ করুন। একজন সন্ন্যাসীই জগতের প্রকৃত সেবক। প্রকৃতপক্ষে, তিনিই একমাত্র যিনি বিনিময়ে কিছু আশা না করে বিশ্বের সেবা করেন এবং ভালোবাসেন। একজন প্রকৃত সন্ন্যাসীর জন্য, সমগ্র পৃথিবী একটি ফুলের বাগান এবং প্রতিটি ব্যক্তি তার মধ্যে এক একটি ফুল। এই ধরনের ব্যক্তি সমগ্র বিশ্বের অন্তর্গত এবং তার কোন নির্দিষ্ট জাতি, ধর্ম, বা সম্প্রদায় নেই। সন্ন্যাসীর চোখে সকলের সমান অধিকার। তার চোখে সবাই সমান। সত্যের আলোয় পূর্ণ তিনি।
আমাদের দুর থেকে সন্যাসীদের একক বা বিচ্ছিন্ন মনে হলেও তাঁরা দশনামী সম্প্রদায়ের কোনো না কোনো শাখার অন্তর্গত। এবার দশনামী সম্প্রদায়ের সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। আমাদের ভারতবর্ষে ভগবান শংকরাচার্য প্রতিষ্ঠিত দশনামী সম্প্রদায় সন্ন্যাসীরা প্রধানত ভারতবর্ষের চার কোণে চারটি মূল মঠের সাথে যুক্ত, যা স্বয়ং আদি শঙ্করাচার্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। সাধারণত অদ্বৈত বেদান্ত ঐতিহ্যের চারটি মূল মঠের সাথে যুক্ত এবং ঐতিহ্য অনুসারে, বৈদিক পণ্ডিত এবং শিক্ষক আদি শঙ্করাচার্যের দ্বারা বর্তমান আকারে সংগঠিত। ভগবান শংকরাচার্য প্রতিষ্ঠিত দশনামী সম্প্রদায় এর জন্য পুণ্যক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত স্থান এর চয়ণ করে ভারতবর্ষের চার প্রান্তে চারটি মঠ নির্মাণ করেন। দ্বারকায় শারদা মঠ, পুরীতে গোবর্ধন মঠ, বদরিনারায়ণ ধামে জ্যোতির্মঠ, রামেশ্বরে শৃঙ্গেরী মঠ। এই চার মঠে চারজন প্রধান দেবতা নিযুক্ত করলেন। যদিও শংকরাচার্য এর অদ্বৈত বেদান্ত মতের অধিকাংশ শিষ্যই শৈব, তবে শংকরাচার্য সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কে দশনামী শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে তার প্রতিষ্ঠিত চারটি মঠের অধীনে নিয়ে এলেন। মঠবাসী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কে যে দশটি নামে পরিচিতি দেওয়া হয়েছিল তার ভিত্তিতেই দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের নামকরণ হয়েছে। দশটি উপবিভাগ নাম ও প্রকাশ করা হয়। যেমন-: গিরি (পর্বত) , পুরী (ভূমি) , ভারতী (ভূমি) , বন (বন) , অরণ্য (অরণ্য) , সাগর (সমুদ্র), আশ্রম ( আধ্যাত্মিক পরিশ্রম) , সরস্বতী (প্রকৃতির জ্ঞান), তীর্থ (তীর্থস্থান), এবং পার্বত (পর্বত)।
সন্ন্যাস দীক্ষা নেওয়ার পরে, যা কেবলমাত্র অন্য একজন বিদ্যমান স্বামী (সন্ন্যাসী) দ্বারা করা ত্যাগকারী একটি নতুন নাম যার নামটি সাধারণত আনন্দে শেষ হয়। যার অর্থ “সর্বোচ্চ আনন্দ” এবং একটি শিরোনাম গ্রহণ করে দশটি উপবিভাগের একটির সাথে সংযোগকে আনুষ্ঠানিক করে তোলে। একজন স্বামীকে যেমন সন্ন্যাসী বলা হয়, একজন ত্যাগী যিনি (স্ব) এর সাথে আধ্যাত্মিক মিলন অর্জন করতে চান। আনুষ্ঠানিকভাবে জগৎ ত্যাগ করার সময়, তিনি সাধারণত জাগতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি অনুরক্তির প্রতীক হিসাবে গেরুয়া রঙের পোশাক পরেন।
*একজন ত্যাগী সন্ন্যাসী যিনি স্বাধীনভাবে ঘোরাঘুরি করতে বা আশ্রম বা অন্যান্য আধ্যাত্মিক সংস্থায় যোগদান করতে পারেন। আশ্রম বা আধ্যাত্মিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। সাধারণত একটি আদর্শে বিশ্ব কল্যাণ, মানব কল্যাণ, নিঃস্বার্থ সেবা করতে পারেন। একজন স্বামীর নামের একটি দ্বৈত তাৎপর্য রয়েছে, যা কিছু ঐশ্বরিক গুণ বা অবস্থা যেমন:- প্রেম, প্রজ্ঞা, সেবা, যোগ এর মাধ্যমে এবং প্রকৃতির অসীম বিশালতার সাথে সামঞ্জস্যের মাধ্যমে সর্বোচ্চ আনন্দ প্রাপ্তির প্রতিনিধিত্ব করে।*
সন্ন্যাসী হিন্দুধর্মে একজন ধর্মীয় তপস্বী যিনি নিজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিজে সম্পাদন করেন এবং সামাজিক বা পারিবারিক অবস্থানের সমস্ত দাবি পরিত্যাগ করে সংসার ত্যাগ করেছেন। তাই, সন্ন্যাসীদের অন্যান্য সাধু বা পবিত্র পুরুষদের মতো, দাহ করা হয় না তবে সাধারণত ধ্যানের উপবিষ্ট ভঙ্গিতে সমাহিত করা হয়।তবে সন্ন্যাসী অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অন্ত’ শব্দের অর্থ শেষ, ‘ইষ্টি’ শব্দের অর্থ সংস্কার। মৃত্যুর পরে হিন্দুদের শবদাহ ক্রিয়াকেই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বলে। দাহের আগে ঘি মাখিয়ে শবদেহ স্নান করানো হয়। তারপর সাধু-সন্ন্যাসী ব্যক্তির ক্ষেত্রে জলসমাধি বা জলে ভাসিয়ে দেওয়া, কিংবা মৃৎসমাধি দেওয়ার রীতি আছে। তবে কোনো কোনো সন্ন্যাসী সম্প্রদায় শবদাহ করেন, দাহ করার কাজে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির ক্ষেত্রে চন্দনকাঠ বা চন্দনগুঁড়া ব্যবহার করা হয়, কিন্তু সাধারণ লোকের ক্ষেত্রে ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম নেই।
সন্ন্যাসীদের জন্য, সন্ন্যাস দীক্ষা গ্রহণের আগে শেষকৃত্য (নিজের শ্রাদ্ধ নিজে করেন) করা হয়। অতএব, নিয়মিত প্রক্রিয়া ব্যবহার করে তাদের দাহ করার দরকার নেই। আদর্শভাবে, সন্ন্যাসীর শরীরে কোনো চেতনা থাকা উচিত নয় এবং তাই, যখন তাদের সময় শেষ হয়, তখন তারা সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায় না। সব জায়গায় ব্যতিক্রম হতে পারে। একজন ঋষি বা সন্ন্যাসীর তথাকথিত বস্তুগত দেহ মাটিতে পুঁতে রাখা হয় এবং তাকে সমাধি বলা হয়। সমাধি হলো জ্ঞানার্জন, এটি মনের বাইরে বা মনের সীমা অতিক্রম যেখানে শব্দ এবং ভাষা নেই। সমাধি হল অজ্ঞাত, অদৃশ্যের দরজা। সমাধি হল প্রথম তিন ধাপের ফল। সেই তত্ত্বমসি, সেই তুমি; অহম ব্রহ্মাস্মি।
ওঁ অজ্ঞানতিমিরান্ধ্যস্য জ্ঞানাঞ্জন-শলাকয়া ।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ ।।
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্ ….!