মূল্যবান মনুষ্য জীবন ও শুভ অক্ষয় তৃতীয়া : স্বামী আত্মভোলানন্দ (পরিব্রাজক)।।।

0
35

আগামী ২৭শে বৈশাখ শুক্রবার ১৪৩১ (10.05.2024) শুভ অক্ষয় তৃতীয়া। অক্ষয় তৃতীয়া হল চান্দ্র বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথি। আমাদের মূল্যবান সুন্দর মনুষ্য জীবনে হিন্দু সনাতন ধর্মে অক্ষয় তৃতীয়া বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ তিথি। অক্ষয় শব্দের অর্থ হল যা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। বৈদিক বিশ্বাস অনুসারে এই পবিত্র তিথিতে কোন শুভকার্য সম্পন্ন হলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয়ে থাকে। যে তিথি অক্ষয় তা-ই ‘অক্ষয় তৃতীয়া’ নামে পরিচিত।

বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথি ‘অক্ষয়’ বা চিরন্তনরূপে চিহ্নিত। এই বিশেষ তিথিটির অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হল এই দিনে সূর্য ও চন্দ্র সর্বাধিক উজ্জ্বলভাবে তাদের প্রভাব বিস্তার করে। বৈশাখের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথির সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তই মঙ্গলময় ও শুভরূপে চিহ্নিত। তাই অক্ষয় তৃতীয়াতে কৃতকর্মের ফল যে অক্ষয় হয় সে ব্যাপারে সকলেই সচেতন। ঘরে ঘরে বৈভবলক্ষ্মীর পূজা, নতুন গৃহের দ্বার উদ্ঘাটনের শুভ মুহূর্তও এই দিন। আগেকার দিনে রাজা ও জমিদারগণ  এই তিথিতে জলদান করতেন, পুষ্করিণী খনন করে উদ্বোধন করতেন এই পুণ্য তিথিতে।

অক্ষয় তৃতীয়া শাস্ত্র অনুসারে একটি শুভ দিন যা “আখা তীজ” নামেও পরিচিত । উৎসবের দিনে ভগবান বিষ্ণু, ভগবান গণেশ ও দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। অক্ষয় তৃতীয়া পরশুরাম জয়ন্তী নামেও পরিচিত। সংস্কৃতে ‘অক্ষয়’ শব্দটি অসীম বা চিরন্তনকে বোঝায়, এই দিনটির  অসীম সৌভাগ্য এবং সমৃদ্ধির প্রতীক। ব্যবসা শুরু করা, একটি নতুন চাকরি শুরু করা বা একটি নতুন বাসস্থানে স্থানান্তরিত করার মতো নতুন উদ্যোগ শুরু করার জন্য এটি একটি উপযুক্ত সময় বলে মনে করা হয়।

অক্ষয় তৃতীয়ার গুরূত্ব বিশাল। এদিন অনেকগুলি  শুভকার্য সম্পন্ন হয়েছিল ও ঘটনা ঘটেছিল। যেমন:-
১) এদিনই রাজা ভগীরথ গঙ্গা দেবীকে মর্ত্যে নিয়ে এসেছিলেন।
২) এদিনই গণপতি বেদব্যাসের মুখনিঃসৃত বাণী শুনে মহাভারত রচনা শুরু করেন।
৩) এদিনই দেবী অন্নপূর্ণার আবির্ভাব ঘটে।
৪) বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষে তৃতীয়া তিথিতে রবিবারে সত্যযুগের উৎপত্তি। সত্যযুগ (সংস্কৃত: सत्ययुग) বা কৃতযুগ হলো হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী চতুর্যুগের প্রথম যুগ। অন্য যুগগুলো হলো ত্রেতাযুগ, দ্বাপরযুগ ও কলিযুগ।
৫) এদিনই কুবেরের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে অতুল ঐশ্বর্য প্রদান করেন। এদিনই কুবেরের লক্ষ্মী লাভ হয়েছিল বলে এদিন বৈভব-লক্ষ্মীর পূজা করা হয়।
৬) এদিনই বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম জন্ম নেন পৃথিবীতে।
৭)এদিনই ভক্তরাজ সুদামা শ্রী কৃষ্ণের সাথে দ্বারকায় গিয়ে দেখা করেন এবং তাঁর থেকে সামান্য চালভাজা উপহার নিয়ে শ্রী কৃষ্ণ তাঁর সকল দুঃখ মোচন করেন।
৮)এদিনই দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে যান এবং সখী কৃষ্ণাকে রক্ষা করেন শ্রীকৃষ্ণ। শরনাগতের পরিত্রাতা রূপে এদিন শ্রীকৃষ্ণ দ্রৌপদীকে রক্ষা করেন।
৯) এদিন থেকেই পুরীধামে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উপলক্ষ্যে রথ নির্মাণ শুরু হয়।
১০) কেদার বদরী গঙ্গোত্রী যমুনোত্রীর যে মন্দির ছয়মাস বন্ধ থাকে এইদিনেই তার দ্বার উদঘাটন হয়। দ্বার খুললেই দেখা যায় সেই অক্ষয়দীপ যা ছয়মাস আগে জ্বালিয়ে আসা হয়েছিল।

আমরা পৌরাণিক সাহিত্যের মধ্যে পাই যে, মৃত্যুরাজ যম এই তিথির মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে যে কাহিনি বলেছিলেন সেটি এইরকম, কোনও এক দেশে এক ব্রাহ্মণের বাস ছিল। সেই ব্রাহ্মণ উচ্চবংশে জন্মগ্রহণ করলেও অত্যন্ত কৃপণ ও উগ্র স্বভাবের ছিলেন। একদিন এক রাজা মৃগয়ায় গিয়ে তৃষ্ণার্ত হলেন এবং একটু জললাভের আশায় উপস্থিত হলেন সেই ব্রাহ্মণের দুয়ারে। তৃষ্ণায় কাতর রাজা ব্রাহ্মণকে সম্ভাষণ করে বললেন হে পূজ্য ব্রাহ্মণ আমি তৃষ্ণার্ত! আমায় দয়া করে একটু জলদান করুন! রাজাকে তৃষ্ণায় কাতর দেখেও ব্রাহ্মণের হৃদয়ে করুণার সঞ্চার হল না! তিনি মুখবিকৃতি করে বলে উঠলেন, দেখো, এখানে গ্রহণের জন্য কোনও অন্ন বা পানীয় নেই! তুমি জলের জন্য অন্য কোথাও যেতে পারো! ব্রাহ্মণের মুখে এই কটূ কথা শুনে তৃষ্ণার্ত রাজা অন্যত্র যাওয়ার জন্য যখন উদ্যত হয়েছেন তখন গৃহের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন ব্রাহ্মণী। তিনি ব্রাহ্মণকে তিরস্কার করে বললেন, স্বামী! আপনার জীবনে নিজের সুখ ছাড়া আর কিছুরই কি প্রয়োজন নেই? নিজের জন্য অন্ন প্রস্তুত করা ও তা ভোগ করা— এ তো পশুর তুল্য জীবনযাপন। আপনি একজন তৃষ্ণার্ত ব্যক্তিকে কিছুতেই গৃহ থেকে ফিরিয়ে দিতে পারেন না। এই বলে ব্রাহ্মণী রাজাকে জলদান করলেন! যে তিথিতে ব্রাহ্মণী জলদান করলেন সেই তিথিটি ছিল বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথি। ব্রাহ্মণী তিথি সম্বন্ধে একেবারেই অবহিত ছিলেন না। তিনি নিজের স্বভাববশত ব্রাহ্মণকে জলদান করেছিলেন। এই ঘটনার পর বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হল। সেই কৃপণ ব্রাহ্মণ মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। মৃত্যুর পর যমরাজের অনুচরগণ তাঁর ঘাড় ধরে নরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল, কিন্তু বিষ্ণুর দূতেরা আবার তাঁকে সসম্মানে বৈকুণ্ঠে নিয়ে যাওয়ার জন্য উপস্থিত। যমরাজা স্বয়ং এই ব্যাপার দেখে অবাক। এ কী করে হয়? এত দুষ্ট স্বভাব ব্রাহ্মণের নরক গমনই নির্দিষ্ট। তাঁর জন্য বিষ্ণুর দূতেরা উপস্থিত কেন? যমরাজের মুখের দিকে তাকিয়ে বিষ্ণু বললেন, হে যমরাজ। এই ব্রাহ্মণ কৃপণ স্বভাব বটে। কিন্তু বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের পবিত্র তৃতীয়া তিথিতে এই ব্যক্তির গৃহে তৃষ্ণার্ত রাজা জল পেয়েছিলেন। এই ব্রাহ্মণের পত্নী তাঁকে জলদান করেছিলেন। *অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্য তিথিতে যে দান করা হয় তার ফলও অক্ষয় হয়ে থাক।* এই পবিত্র তিথিটির পুণ্যফল এই ব্রাহ্মণ অর্জন করেছেন এবং বিষ্ণুলোকে গমনের অধিকারলাভ করেছেন।

আর এইদিন *পূজা, জপ, ধ্যান, দান, অপরের মনে আনন্দ দেওয়ার মত কাজ করা উচিত।* যেহেতু এই তৃতীয়ার সব কাজ অক্ষয় থাকে তাই প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হয় সতর্কভাবে। এই দিনটা ভালোভাবে কাটানোর অর্থ সাধনজগতের অনেকটা পথ একদিনে চলে ফেলা। পুরাণ অনুসারে এই বিশেষ দিনে যে ব্যক্তি *দান-ধ্যান, পুষ্করিণী খনন, বাসগৃহ বা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে লক্ষ্মী-বাসুদেবের বা নারায়ণের পূজা সম্পন্ন করেন তিনি অক্ষয় পুণ্য লাভ করেন।* গুরু মহারাজের শুভ ও মঙ্গলময় আশির্বাদ আপনাদের সকলের শিরে বর্ষিত হোক… এই প্রার্থনা করি…!
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্ …!