ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্তের  প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি : দিলীপ রায়। 

0
35

ব্রত শব্দের অর্থ তপস্যা ও সংযমের সংকল্প ।  বিশেষ ব্রত নিয়ে যারা চলে , তারাই  ব্রতচারী । তাই ব্রতচারীদের ব্রত পালন করার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে  —  সত্যনিষ্ঠা, সংযম, অধ্যবসায় ও আত্মনির্ভরতা । মূল লক্ষ্য হচ্ছে ব্রতচারীদেরকে  – জ্ঞান , শ্রম , সত্য , ঐক্য  ও  আনন্দের সাথে জীবনযাপন ।  বাঙালির দৈহিক-মানসিক গঠন এবং নৈতিক বোধ উন্নয়নের ভাবনা থেকে গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত প্রাসঙ্গিক নৃত্য-গীত অবলম্বন করে গুরুসদয় দত্ত ১৯৩২ সালে  ব্রতচারী আন্দোলনের সূত্রপাত করেন । ব্রতচারী আন্দোলন হচ্ছে একটি আধ্যাত্মিক ও সামাজিক উন্নয়নের আন্দোলন । আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ ভারতের নাগরিকদের মধ্যে দেশপ্রেম, জাতীয়চেতনা ও নাগরিকত্ববোধ ।  গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারণের শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হবার শিক্ষা ।১০ই মে,  ব্রতচারী দিবস পালিত হয় ৷ ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্তের  জন্মদিনকে স্মরণে-সম্মানে দিনটি ব্রতচারী দিবস হিসাবে পালিত হয় ।
এবার আমরা গুরুসদয় দত্ত সম্বন্ধে কিছু জানার চেষ্টা করি । ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্ত  ১৮৮২ সালের ১০ মে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার  বীরশ্রী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । গুরুসদয় দত্ত সাত বছরে পিতৃহারা, চোদ্দ বছরে মাতৃহারা হয়ে জেঠুর কাছে মানুষ হন । বালক বয়স থেকে গুরুসদয় দত্ত  ছিলেন দুরন্ত , নির্ভীক আর একই  সঙ্গে  হৃদয়বান ।  ছোট বেলা থেকেই তিনি সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । প্রয়োজনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বন্যাত্রাণে, অগ্নি নির্বাপনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তেন । গ্রামের মাইনর স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু । তারপর সিলেট শহরের  ইংরাজি মাধ্যম স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন এবং মেধানুসারে তিনি অসম প্রদেশে প্রথম স্থান অধিকার করেন ।   কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ পাশ করে তিনি  বিলেত যান । ১৯০৪ সালে তিনি আই.সি.এস. পাশ করেন এবং মেধা তালিকার সপ্তম স্থান অধিকার করেন ।  তিনি ছিলেন সরকারি কর্মচারি । জেলাশাসক, কালেক্টর, কৃষি ও শিল্প বিভাগের সচিব হিসাবে কাজ করেছেন । সরোজ নলিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় । ১৯৪০ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন ।
১৯৩২ সালে তিনি ব্রতচারী প্রতিষ্ঠা করেন । ১৯৩৪ সালে ব্রতচারী সমিতি এবং ১৯৪১ সালে কলকাতার জোকায় ব্রতচারী গ্রাম স্থাপন করেন । ব্রতচারী আন্দোলনে কেউ সামিল হতে চাইলে তিনটি উক্তি স্বীকার করে নিতে হতঃ-
১। আমি বাংলাকে ভালবাসি
২। আমি বাংলার সেবা করব
৩। আমি বাংলার ব্রতচারী
গুরুসদয়  দত্ত  সারাজীবন লোকশিল্প  আর  সংস্কৃতির সন্ধানে প্রবৃত্ত ছিলেন । তিনি  রায়বেঁশে (রায়বেঁশে হচ্ছে পুরুষদের দ্বারা লোকযুদ্ধ  নৃত্যের একটি ঘরানা), কাঠি, ধামাল, ঝুমুর, ব্রত, ঢালিনৃত্য  পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন । ব্রতচারীদের মধ্যে তিনি “প্রবর্তক জী”  নামে খ্যাত ছিলেন । ব্রতচারীদের অভিবাদন-ভঙ্গি, মাতৃভাষা প্রীতি, স্বাস্থ্যজ্ঞান, সত্যনিষ্ঠা,  সংযম, প্রফুল্লভাব, অধ্যবসায়, আত্মনির্ভরতা খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে । রবীন্দ্রনাথ সহ তৎকালীন সময়ের বহু বিখ্যাত ব্যক্তি গুরুসদয় দত্ত প্রতিষ্ঠিত ব্রতচারী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন । তিনি অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যেগুলো বর্তমানে দুর্লভ । গ্রাম পুনর্গঠন , সমবায় প্রথায় চাষ, লোকশিল্প সংগ্রহ, ম্যাগাজিন প্রকাশ সহ তিনি নানান কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন । লোকসাহিত্য গবেষক, লেখক, স্বদেশপ্রেমী গুরুসদয় দত্ত ক্যান্সারে  আক্রান্ত হয়ে ১৯৪১ সালের ২৫ জুন পরলোক গমন করেন । এখনও তাঁর লোক ঐতিহ্যের সন্ধান  বাঙালি জাতিকে আত্ম-আবিষ্কারের পথে চালিত করে । তাঁর জন্মদিনে শতকোটি প্রণাম । (তথ্যসূত্র: সংগৃহীত)
——০——–