আবার পাহাড়ে – এক ভ্রমণ কাহিনী।

0
44

পাহাড় আমার ভালোবাসা। পাহাড় আমাকে ডাকে । তাই জীবনের অনেক গুলো বছর শুধু হিমালয়ের কোলে কোলে ঘুরে বেড়িয়েছি। পাহাড়ের মানুষদের ভালো বেসেছি।যে কটি দিন থাকতাম ওদের সুখ ওদের দুঃখ ভাগ করে নিয়েছি।আমাদের সমতলের মানুষের মতো ওরা জটিল নয়।সাদা মনের মানুষ। খুব সহজেই সবাইকে আপন করে নেয় ।
সেবারে আমরা খাটলিং গ্লেসিয়ার ট্রেকিং করতে গিয়েছিলাম । সংগে আমাদের আট বছরের ছেলে ও সংগী হয়েছিল। আমাদের গাইড পোর্টার তো ছিলই । ওর জন্য একজন আলাদা গাইড নেওয়া হয়েছিল যে ওর ছায়া সঙ্গী র মতো পাশে পাশে থাকবে । দুর্গম হাঁটাপথে আমরা নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলাম। নাম ছিল তার সাম সিং।গাঁট্টাগোট্টা অথচ খুব সুন্দর ।আমার ছেলে’ বব।’খুব ভাব হয়ে গেল দুজনের। জনমানবহীন পাহাড়ি পথে ছোট্ট হলেও আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মনের আনন্দে ট্রেক করেছিল সাম সিং বন্ধু হয়ে গিয়েছিল বলে।সারা রাস্তা ছোট্ট বাবু টিকে কতো যে পাহাড়ের গল্প বলতো সেই গল্প শুনতে শুনতে কতো চড়াই উতরাই অক্লেশে পার হয়ে ছিল ভাবলে আমরাও আশ্চর্য হয়ে যাই।
গাড়োয়াল হিমালয়ের টেহেরি ডিসট্রিক্টে
খাটলিং গ্লেসিয়ার। এর তলায় একদম নীচে ভীলাঙ্গনা নদীর উৎস।বাবল্ এর মতো বুদবুদ করে নদী বেরিয়ে আসছে।অপূর্ব তার সৌন্দর্য ।চারিদিকে বরফে ঢাকা পাহাড় ।যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড় । ঘুত্তু ,রী , গাঙ্গীখরশোলি, বেদিখরাগ ,খাটলিং। এই আমাদের যাত্রা পথ। ঘুত্তু থেকে শুরু হাঁটা।এতো সবুজ গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে হাঁটাপথ আমরা খুব সুন্দর দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে রী তে এসে পৌঁছলাম। এরপর খরস্রোতা নদী পার হয়ে পরদিন সকালে রওনা হলাম খরশোলি হয়ে বেদি খরাগে।খরশোলি পাহাড়ের কোলে সবুজে মোড়া বিশাল এক ময়দান।সে যে কি অপূর্ব। আর সেখানে চরে বেড়াচ্ছে শত শত ঘোড়া। জোড়ায় জোড়ায়।বাচ্চা নিয়ে মা ঘোড়া। সাদা কালো জোড়া সাদা সাদা জোড়া বাদামি খয়েরি সব জোড়ায় জোড়ায়।কি সে দৃশ্য না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না। আমার ছোট্ট ছেলে বিস্ময়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো ঐ দেখো সাম সিং সাদা ঘোড়ার কালো বাচ্চা। তার হাততালি তে সারা পাহাড় মুখর হয়ে উঠলো।আমি সারা জীবনে এরকম স্বর্গীয় সৌন্দর্য কখনও আর দেখিলি। আসলে এটা ঘোড়া দের ব্রিডিং সেন্টার। আমরা ট্রেকিং এর পথে অনেক কিছু দেখেছি কিন্তু এরকম বুনো ঘোড়ার সম্মেলন কখনও কোথাও দেখতে পাইনি। হাঁটাপথের সব ক্লান্তি নিমেষে দূর হয়ে গেল ।দূরে একটি চালা ঘরে এদের বৃদ্ধ মালিক চুল করে বসে হাসছে আমাদের আনন্দ দেখে। এখনও অনেক পথ বাকী ।গাইড তাড়া দিয়ে আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেল।
ঠিক হল বেদিখরাগে একটু নাস্তা করে খাটলিং এর পথে এগিয়ে যাবো।মাঝে মাঝেই রাস্তা জুড়ে বরফের জমে যাওয়া স্রোত পথ বন্ধ করে নেমেছে নীচে।আইস এক্স দিয়ে গাইডেরা পা রাখার মতো গর্ত খুঁড়ে দিয়ে আমাদের পথচলা র পথ তৈরি করে দিচ্ছে । আমরা অতি সাবধানে সেই পথ এক পা এক পা করে পার হয়ে যাচ্ছি। একবার পা ফসকে গেলেই কোথায় যে তলিয়ে যাব কেউ জানে না। এরকম তিন চারটি গ্লেসিয়ার পার হয়ে আমরা
বেদি খারগে পৌঁছালাম।সবাই বেশ ক্লান্ত। একমাত্র আমার খুদে সদস্য আর তার বন্ধু বহালতবিয়তে গল্প করে চলেছে। আমি ও আমার দলের সবাই তাই দেখে খুব নিশ্চিন্ত বোধ করলাম। সামান্য খাওয়া দাওয়া করে আমরা খাটলিং এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
এই পথটি ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া। অজস্র নাম না জানা বৃহৎ গাছের ডালপালা সরিয়ে সরু পাহাড়ীপথে আমরা চুপচাপ চলেছি। যেমন সুন্দর তেমন বিভীষিকা। থমথমে সবাই নিস্তব্ধতায় হেঁটে চলেছি। গাইড রাও কেমন চুল করে গেছে। চার পাঁচ মাইল আসার পর সামনে উন্মুক্ত তুষারশৃঙ্গ বলে দিল যেন আমরা এসে গেছি।কতো রূপে যে চোখের সামনে খাটলিংগ্লেসিয়ার আবির্ভূত হয়ে এলো।আজও চোখ বুজলে তিরিশ বছর আগের দেখা স্বপ্ন মাখা দৃশ্য ভেসে ওঠে। অনেক নীচে নদী। সেই গভীর ময়দানে নদীর উৎসে আর যাওয়া হলো না।গাইবার প্রচন্ড তাড়া দিয়ে নামিয়ে নিয়ে এলো আমাদের। আবার সেই বুনো পথ। আমার ছেলের ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। সাম সিংওকে পিঠে তুলে নিয়ে দুদ্দাড় করে এগিয়ে গেল। অনেক পথ পেরিয়ে আমরা আবার বেদিখরাগে এসে পৌঁছালাম। ওখানে একটু রান্নার আয়োজন করা হয়েছে। খিচুড়ি আর আলুভাজি।পোর্টাররা খুব ব্যস্ত হয়ে চটপট রান্না করে খাইয়ে দাইয়ে আমাদের বিশ্রাম করতেও দিল না। শুধু তাড়া দিয়ে রী এর পথে নামতে বললো। আমরা এতো খানি ট্রেকিং করে রিল্যাক্সড মুডে আড্ডা দিতে চাইলে গাইড গম্ভীর মুখে বললো আভি রী মে চলো।বাদ মে ক্যাম্প ফায়ার হো গা। এতো রাগ হলো গোমড়ামুখো গাইডের ওপর। আমরা কোন কথা না বলে রী এর পথে পা বাড়ালাম।
রী এর বাংলোতে দেখি সাম সিং আমার ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে।মুখ টা খুব বিষন্ন। আমরা ভাবলাম বেচারি র খুব কষ্ট হয়েছে। রাত্রে আমরা টেন্টে নিজেরাই হৈ হুল্লোড়।করলাম। ছেলে আমার ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। সাম সিং অনেক রাতে খবর নিয়ে গেল ছোটা সাব ঠিক হ্যায় কিনা। আমরা তখন মজা মস্তি গল্পে মশগুল। আর ছেলে তো আরামসে ঘুমোচ্ছে। আজ ট্রেকিং এর শেষ রাত।মনে স্ফূর্তি একটু নাচা গানা না হলে মন ভরে না। কিন্তু এবারের গাইড আর পোর্টারগুলো যেন কেমন। কাল তো ঘুত্তু। থেকে সোজা ঋষিকেশ। টায়ার্ড ছিলাম সবাই কখন ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে দেখি সাম সিং দুজন গাইড দুজন পোর্টার দুজন ঘোড়াওলা একসঙ্গে আমাদের টেন্টের বাইরে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে আছে চোখমুখ রাত জাগা য় ক্লান্ত বিষন্ন। আমরা বেরোতেই একসাথে সবাই জিজ্ঞেস করে উঠলো ছোটা সাবধানে ঠিক হ্যায়? আমার ছেলে রিনরিন করে বলে উঠলো হাম ঠিক হ্যায়।আচ্ছা হ্যায়।গুড মর্নিং সবকো।ওরা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। দেবতার ফুল ওর গায়ে মাথায় ঠেকিয়ে বললো ভগবান মালা করে গা জরুর। হামলোক সারারাত পূজা কিয়া আপ কো লিয়ে সাব।
পরে জানলাম ওখানে গাছের এক রকমের গন্ধ আছে।সেই গন্ধে মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে। আর সেই ঘুম ভাঙে না কোনও দিন। ছোটাসাবের সেই গন্ধ লেগেছিল সাব। হাউহাউ করে কাঁদছে তো কাঁদছে। আমি শুনেই ওদের সঙ্গে কাঁদতে শুরু করে দিলাম। আমাদের এক দাদা হিমালয়ে তার জীবন কেটেছে।আমাদের অভিভাবক এবং সহ যাত্রী। তিনি সবাইকে ধমক দিয়ে চুপ করালেন। আভি তো সব ঠিক হ্যায়।রোনা দোনা বন্ধ্ করো। খুশি বানাও।মিঠাই খিলাও। কলকাতা থেকে আনা ভীমনাগের কড়াপাকের একবড়বাক্স সন্দেশ ওদের হাতে দিয়ে বললেন আভি মু মিঠা করো। আমার ছেলেকে ডেকে বললেন বব যাও নিজের হাতে ওদের মিষ্টি খাইয়ে দাও। আমার ছেলে ওদের কোলে উঠে সবাইকে যত্ন করে মিষ্টি খাইয়ে দিল। ওদের চোখে তখনও জল মুখে সলাজ হাসি। তখনই উপলব্ধি করলাম পাহাড়ের মানুষের ভালোবাসা কতো গভীর। দুদিনের চলা পথের সাথী কে কতো আপন করে নিয়েছে তাদের হৃদয়ের মাঝে। এবার আমার কান্না হলো শুরু।আমার কতো বড়ো বিপদের দিন ওরা নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল। আমার কান্না র আওয়াজ ওদের কানে যেতে ই ওরা সবাই দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে মাতাজী মাত্ রো। মাত্ রো বিটিয়া। ওরা আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলতে থাকবো মাত রো বিটিয়া।সেই স্নেহের পরশ এখনও আমার শরীরে মাখানো আছে।সএতোদিন পরে লিখছি চোখে জলে ভেসে যাচ্ছে ।
এবার আমরা ঘুত্তু তে ফিরে এলাম। তারপর ঋষিকেশ হয়ে দিল্লি ।তারপরে কোলকাতা ।আমার এই লেখা ভ্রমণের। কিন্তু তার সাথে নিয়ে এলাম এক সুন্দর অভিজ্ঞতা। উপলব্ধি করে এলাম পাহাড়ের মানুষের কোমল হৃদয় আর তাদের প্রাণের ভালোবাসা।

।। কলমে : শীলা পাল।।