জমজমাট  জামাই ষষ্ঠী।

0
49

জমজমাট  জামাই ষষ্ঠী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।জমাট  জামাই ষষ্ঠী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণ  আজ জামাই ষষ্ঠী। জামাই ষষ্ঠী কিন্তু বাঙালিদের কাছে বেশ মিষ্টি মধুর একটি পার্বণ। তাই না ? বিশেষতঃ জামাই আর শাশুড়িদের কাছে এটি যেন সারা বছর ধরে এক অপেক্ষার উৎসব—একথা কিন্তু স্বীকার করতেই হবে জামাই আর শাশুড়ি উভয়কেই। এই তিথিতেই শ্বশুড় বাড়িতে জামাই আদর পাওয়া বিষয়টি পুরুষদের কাছে  বাস্তবায়িত হয় ভীষণভাবে। আবার বিপরীতে জামাইরা তাঁদের দ্বিতীয় মা , অর্থাৎ শাশুড়ি মার হাতে তুলে দেন আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী শ্রদ্ধার্ঘ্য। অতএব, উভয় দিক থেকেই বেশ একটা  ‘দিবে আর নিবে,মিলাবে মিলিবে,যাবে না ফিরে’ ব্যাপার ঘটে। ফলস্বরূপ, আদরের জামাইয়ের সাথে শ্বশুর বাড়ির সম্পর্ক আরও মাখো মাখো হয়ে মালপোয়া-মিষ্টিদইয়ের মাত্রা পায়।

কিন্তু , শুধুই কী দেওয়া-নেওয়া ,  তার বেশি কিছু নয় ? না,না,তা কেন। এদিন যে নিজের জামাইয়ের দীর্ঘায়ু আর মঙ্গল কামনায় বাঙালি মায়েরা পালন করেন নানান আচার । বটপাতা,দূর্বা আর আম নতুন হাতপাখার ওপর রেখে, সেই পাখা আড়াআড়ি ভাবে ধরে জামাইকে বাতাস করেন শাশুড়ি। সেই সঙ্গে মুখে বলতে থাকেন  ”ষাট,ষাট,ষাট” । অর্থাৎ,ভালো হোক ,ভালো হোক জামাইবাবার ।এই স্নিগ্ধ,শীতল হাওয়া  জামাইকে রোগমুক্ত রাখতে সাহায্য করে এই বিশ্বাস ।এ প্রথা তাঁর যাবতীয় অমঙ্গল বিনাশকারী  মনে করা হয়। জামাইয়ের মাথায় আশীর্বাদ দেন ধান-দূর্বা দিয়ে। ধান হল সম্পদের বা সমৃদ্ধির প্রতীক । আর ,দূর্বার গুণ হল তা সহজে মরে না। পায়ে মারিয়ে চলে গেলেও বেঁচে ওঠে।  অতএব, দীর্ঘায়ুর দ্যোতক দূর্বাঘাস।
পাঁচ রকম ফল,মিষ্টি,দই ,দুধ,চিড়ে এসব  থালায় সাজিয়ে  জামাইয়ের সামনে ধরে দেন শাশুড়িরা। জামাই ফলাহার করবে তাই এসবের আয়োজন। আবার জৈষ্ঠ্য মাস তো আম, জাম,কাঁঠাল,লিচু,তালশাসের মাস । তাই এই গ্রীষ্মকালীন ফলের স্বাদ জামাইকে পাওয়াতেই  বুঝিবা ,  এমন একটি মধুর পার্বণের সূচনা হয়েছিল।বাংলাদেশের অনেক জায়গায় এও প্রথা আছে বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেলে পাত্র ও কন্যাপক্ষের পরিবার একে অপরকে আম-দুধ ভেট দেয় এসময়।
এবার আসি ষষ্টী পূজা সম্পর্কে।সন্তানের মঙ্গল করেন মা ষষ্টী । বাঙালিদের প্রতি ঘরে ঘরে নবজাত শিশুর জন্য ষষ্টী পূজো করা হয় অবধারিত ভাবে। তারপরই কিন্তু  আঁতুর ওঠে মা ও শিশুর। জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথি বা জামাইষষ্ঠী  এদেশী বা ঘটী রমণীদের কাছে অরণ্য ষষ্ঠী বা স্কন্দ ষষ্ঠীর ব্রত হিসেবে পালিত হয়।
এদিন সকালে স্থানীয় বট গাছের তলায় এসে  পূজারী ব্রাক্ষ্মণের দ্বারা মা ষষ্টীর পূজা সারেন তাঁরা। খেজুরের ছড়া,ডোয়ো ফল,জাম ,বটপাতা ইত্যাদি একসাথে করে ‘ভাগা’ অর্পণ  করেন । গুটিছোপায়  (মাটির দোয়াতের মত দেখতে)  দই দেন ,আর নানারকম ফল নিবেদন করেন দেবীর উদ্দেশ্যে। যেসব রমণীর সন্তান হয় না , তাঁরা এখানে এসে এদিন আঁচল পেতে ব্রাহ্মণের থেকে গ্রহণ করেন মা ষষ্টীর প্রসাদী গোটা ফল। বিশ্বাস সে ফল খেলে অচীরেই সন্তানসম্ভবা হবেন । এদেশী মায়েরা সন্তানের মঙ্গল কামনায় উপবাস করে থাকেন। রাতে ফলাহার সারেন চিড়ে ,মুড়ি দিয়ে। যা কিছু চর্ব্য-চোষ্য সব রেঁধে দেন  জামাই ও পরিবারের অন্য সকলের জন্য । তবে বাঙালদের মধ্যে আবার এসব উপবাস টুপবাসের  ব্যাপার নেই। মহানন্দে জামাইকে ব্যাপক ভাবে খাওয়া দাওয়া করিয়ে নিজেও শাশুড়ি ভরপেটে থাকেন। তাবলে জামাই ষষ্ঠীর আচার  পালনে কোন ত্রুটি বা খামতি থাকে না । নিষ্ঠাসহ জামাইয়ের প্রতি কর্তব্য  সারেন তাঁরা।
আবার কোন কোন পরিবারে শ্যালিকাদের জন্যও একটি অদ্ভুত নিয়ম থাকে তাঁদের ভগ্নিপতিদের প্রতি। এদিন বাঁশের কঞ্চি বেঁকিয়ে লাভ সাইন বা হার্ট শেপের করে তাতে লাল সুতোয় ধান বেঁধে উপহার হিসেবে তুলে দেন তাঁরা ভগ্নিপতির হাতে।
মুর্শিদাবাদ জেলার সামসেরগঞ্জ থানার অন্তর্গত দোগাছি গ্রামে এইদিনে গ্রামের এয়োস্ত্রীগণ সাড়ম্বরে গ্রাম্যদেবতার পূজা করেন এবং ডোমকল থানার অন্তর্গত ভগীরথপুর গ্রামের স্ত্রীলোকগণ দইমেলা উৎসব পালন করেন।
এবার একটি প্রশ্ন কিন্তু প্রায় সকলের মনেই একটু উঁকি দিচ্ছে জানি।তা হল
‘যম-জামাই-ভাগ্না/তিন হয়না আপনা ‘ কথায় আছে যখন ,তবে ঘটা করে জামাই ষষ্ঠী কেন করা ! কন্যা ষষ্ঠীও তো হতে পারতো! আসলে জামাইবাবাজীবনকে  তুষ্ট রাখার এ এক পন্থা বলা যায়। নিজের মেয়েটির সংসার বন্ধন যাতে অটুট থাকে , জামাইয়ের আদরে ,ভালোবাসায় মেয়ে যাতে রসেবশে, সুখে-শান্তিতে ঘর করে , সধবা থাকে চিরটাকাল সেই আশাতেই এত সব পরিপাটী প্রচেষ্টা ।

অতএব,সব মিলিয়ে জামাই ষষ্ঠীর পার্বণ জমে ক্ষীর হয়ে যায় আনন্দে,আবেগে আর জামাইয়ের প্রতি নির্ভেজাল ভালোবাসায়।

 

।। কলমে : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।।