দাক্ষিনাত্য কৃষক হাঙ্গামার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

0
35

সূচনা —-
মাড়োয়াড়ী সান্থকর মহাজনদের অত্যাচারে ও নিপীড়নে দাক্ষিনাত্যের কৃষকেরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে ।  ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে মহারাষ্ট্রের পুনা ও আহমদ নগরের কৃষক দের, নেতৃত্বে যে প্রবল বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল তা ডেকানরাষ্ট্র বা দাক্ষিনাত্যর কৃষক বিদ্রোহ নামে পরিচিত । দাক্ষিনাত্যের কৃষকেরা বিদ্রোহ সংগঠনের মূলে কতগুলি কারন বিদ্যমান ।
রাজস্ব বৃদ্ধি —
বাংলায় জমিদারদের সঙ্গে ইংরেজদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তোর ফলে রাজস্বের পরিমান নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল এবং এ রাজস্ব আর বাড়ানো সম্ভব হল না । ফলে ইংরেজ সরকার দাক্ষিনাত্যে অন্য ভাবে রাজস্ব ব্যবস্থা প্রচলন করেন । এই রাজস্ব আদায়ের ভার মোড়লদের উপর ন্যস্ত ছিল । মোড়লরা এই সমস্ত টাকা বেশি পরিমানে আত্মসাৎ করার জন্য কৃষক দের উপর নিষ্ঠুর ভাবে নিপীড়ন চালাত । রাজস্ব মেটাবার জন্য কৃষকরা মহাজনদের কাছে চড়াসুদে জমি বন্দক রাখত । এই চড়াসুদ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছুত যে কৃষকদের পক্ষে তা শোধ করা সম্ভব হত না । ফলে বন্দকী জমি মহাজনদের দখলে চলে যেত । ফলে কৃষকরা ক্রমশই নিজেদের জমি থেকে নিজেরা উৎখাত হয়ে যেতে থাকে । এর ফলে কৃষকরা মহাজন বা সালুকার দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে ।
তুলার উৎপাদন ও বিক্রির অসামজস্য
১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে তুলার দাম বাড়লে তুলা চাষ করে রাজস্বের ঘাটতি কিছুটা মেটানো সম্ভব হয় । এই সুযোগে গ্রামাঞ্চলের সম্পন্ন চাষীরা অধিক লাভের আশায় জমিতে তুলোর চাষ বাড়ান । ১৮৬৭ খ্রীঃ রাজস্বের পরিমান আরো বাড়ে । এদিকে ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে বাজারে তুলোর দাম পড়ে যায় । ফলে চাষীদের দুরাবস্থা আরো বেড়ে যায় । এর ফলে সাধারন চাষী থেকে ততাকথিত সম্পন্ন চাষীরাও মহাজনদের কাছ থেকে ঋন নিতে বাধ্য হয় । কৃষকদের এমন দুরবস্থায় সরকার নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে । এই সুযোগে মহাজনরা কৃষক দের জমি দখল করতে থাকে ফলে শোষিত নীপিড়ীত কৃষকরা ক্রমশ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে ।
বিদ্রোহের বিবরন ঃ-
কৃষকরা মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষকরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কট আরম্ভ করে , কিন্তু তাতে কোনো লাভ না হওয়ায় তারা কয়েকটি পথ অবলম্বন করে । তাদের সেই বিদ্রোহের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। প্রথমতঃ , এই বিদ্রোহের বিদ্রোহীদের লক্ষ্য ছিল মাহাজনদের ঋণপত্র , দলিল ও হিসেবের যাতাপত্র ধংস করে ফেলা , কারন তারা বুঝেছিল এই সব জিনিসই তাদের জীবনের চরম দূর্দশা দেকে এনে ছিল। দিতীয়তঃ , বিদ্রোহের ব্যাপকতা থাকলেও মহাজন বা সাহুকারদের প্রানহানি খুব কম ছিল। তৃতীয়তঃ , অনেক স্থানে মহাজনদের ঘর বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করে দেয় বিদ্রোহীরা । পুনা ও আহামদনগরের প্রায় ৩৩ টি অঞ্চলে এরূপ হিংসাত্মক ঘটে । ক্যাংলিয়া নামে এক কৃষক নেতা এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিল । কৃষকরা তাঁকে ‘গরীবের বন্ধু’ মনে করতেন । চতুর্থতঃ , এই বিদ্রোহে দুর্ধর্ষ নিন্মশ্রেনীর কৃষকরা অংশ গ্রহন করলেও , কিছু সম্পন্ন চাষী এই বিদ্রোহে অংশগ্রহন করায় , এই বিদ্রোহ রক্তক্ষরা সংগ্রামে পরিনত হয়নি । পঞ্চমতঃ, এই বিদ্রোহ কোন ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের রাজনৈতিক আদর্শ দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে পরিচালিত হয়নি । মহাজন গোষ্ঠীর শোষনের হাতিয়ার গুলিকে ধবংস করাই ছিল এই বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্য ।
ফলাফল ঃ
প্রত্যক্ষভাবে ব্রিটিশ বিরোধী না হলেও দাক্ষিনাত্যের কৃষক বিদ্রোহ ইংরেজদের মনে ভয়ের উদ্রেক করে । তারা বুঝেছিল এইভাবে মহাজন শ্রেনী ধবংস হয়ে গেলে তাদের অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে, যা ভবিষ্যতে তাদের পক্ষে মারাত্মক হতে পারে । ইংরেজরা ক্যাংলিয়াকে গ্রেপ্তার করলে কৃষক দের এই বিদ্রোহ নেতৃত্ব হয়ে পড়ে । ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে নিযুক্ত ‘দাক্ষিনাত্য বিদ্রোহ কমিশন’  এর সুপারিশে ১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দে ‘দাক্ষিনাত্যে কৃষক আইন’ পাশ হয় । এই আইনের ফলে কৃষকদের জমি হস্তান্তর ব্যাপারে কিছুটা আইন বিধিবদ্ধ হয় । এছাড়া মহাজনদের সুদের হার ও নিদিষ্ট করা হয় । কৃষকরাও মহাজনদের বিরুদ্ধে ও আদালতের সাহায্য লাভের সুযোগ পায় । ফলে ক্রমশ আন্দোলনে ভাটা পড়ে কিন্তু কৃষক দের অবস্থার বিশেষ কোন উন্নতি সাধন হয় নি ।