শ্রীকৃষ্ণের বাল্য রূপের দর্শন দেখা যাবে, আরংঘাটার যুগল কিশোর মন্দিরে ।

0
54

নদীয়া, নিজস্ব সংবাদদাতা:-  শ্রীকৃষ্ণের কিশোর রূপের পুজো করা হয় নদীয়ার যুগল কিশোর মন্দিরে। ১৭২৮ সালে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নির্মাণ করেছিলেন এই মন্দির। কথায় আছে, এক সময় গঙ্গারাম দাস নামের এক ব্যক্তি বৃন্দাবন থেকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এক কিশোর মূর্তি নবদ্বীপের সমুদ্রগড়ে স্থাপন করে পুজো করা শুরু করেছিলেন। সেই সময় ছিল বর্গীদের উপদ্রব। তাই তিনি শ্রীকৃষ্ণের মূর্তিটি নিয়ে আড়ংঘাটায় চলে এসেছিলেন। সেখানেই গোপীনাথ জিউর মন্দির ছিল। সেই মন্দিরের পাশেই আরও একটি মন্দির নির্মাণ করে শ্রীকৃষ্ণের মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গঙ্গারাম দাস। প্রথমে সেই মন্দিরে শুধু মাত্র শ্রীকৃষ্ণের পুজা করা হতো। কিন্তু কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এই স্থানে মাটি খুঁড়ে একটি রাধিকার মূর্তি পেয়েছিলেন। সেই মূতিটিকে শ্রীকৃষ্ণের কিশোর মূর্তির পাশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। আর তখন থেকেই ঐ দুই মূর্তি ‘যুগলকিশোর’ নামে পরিচিত।

শ্রী রাধিকা আর কৃষ্ণকে ছেড়ে প্রেমের কথা ভাবেন এমন মানুষ কমই আছে। আর এমনই এক রাধা কৃষ্ণের মিলনের সাক্ষী আড়ংঘাটার যুগল মন্দির। গঙ্গারাম নামে এক মহন্ত শ্রী কৃষ্ণের কিশোর বেলার এক মূর্তি নিয়ে আসেন বৃন্দাবন থেকে। নবদ্বীপের কাছে সমুদ্রগড়ে চলতো এ মূর্তির নিত্য পুজো। কিন্তু বর্গী হানার কারণে এই মূর্তি নিয়ে গঙ্গারাম চলে আসেন নদিয়ার রাণাঘাট মহকুমার আড়ংঘাটায়। এখানে তাঁরই স্বদেশী বন্ধু রামপ্রসাদের দ্বারস্থ হন তিনি। রামপ্রসাদ ছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কর্মচারী।

ভগবানের প্রতিষ্ঠা তার ইচ্ছে ছাড়া তো হবার নয়। আর তিনি স্বপ্ন ছেড়ে কবেই বা স্বয়ং এলেন! গঙ্গারাম স্বপ্নাদেশ পান স্বয়ং শ্রী কৃষ্ণের। কৃষ্ণ বলছেন, ‘আমার শ্রী রাধিকা আছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে।’ এ স্বপ্নাদেশের বার্তা মহারাজের কাছে বয়ে যায় রামপ্রসাদেরই মাধ্যমে। এর কিছুদিন পর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নাদেশ পান, ‘বাড়ির ভূ-গর্ভস্থ স্থানে কিশোরী শ্রী রাধিকার ধাতব মূর্তি রয়েছে।’ মহারাজের তত্ত্বাবধানে শ্রী রাধিকার মূর্তি উদ্ধার করা হয়। মহারাজ স্বয়ং রাধিকাকে সঙ্গে নিয়ে বজরা করে চলে আসেন আড়ংঘাটায়।

বর্তমান মন্দির প্রাঙ্গণে বকুল গাছের নীচে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রী রাধিকার যুগল। মহারাজ নিজে হাজির থেকে পুরোহিত দিয়ে মহা আড়ম্বরে পুজো করান। এই যুগল মূর্তি প্রতিষ্ঠা থেকেই মন্দিরের নাম হয় ‘যুগল মন্দির’। তবে এ মন্দির রাতারাতি গড়ে ওঠেনি। নিত্য পুজোর জন্য মহারাজ দেবোত্তর সম্পত্তির একশো পঁচিশ বিঘা দান করেন। সময় বয়ে এসে ১৭২৮ সালে আড়ংঘাটায় প্রতিষ্ঠিত হয় মন্দিরের পঙ্খ। অলংকৃত ও পাঁচটি ফুল কাটা খিলানের দুই সারি যুক্ত প্রশস্ত দালান মন্দির। যুগল কিশোরের স্থান সিংহাসনে, যা পুরো পরিবেশকে আলোকিত করে রাখে।
মন্দির প্রাঙ্গণে গেলে মন যেমনি শান্ত হয়, তেমনি এখানে ধরা পড়ে পুরাণের ছোঁয়া। দু’পাশের দেওয়াল জুড়ে দশাবতারের চিত্র। যে ছবি বারবার স্মরণ করায় বাংলার লোকসংস্কৃতির কথা। প্রাঙ্গণের চার কোণে চারটি তুলসী মঞ্চ রয়েছে বৈষ্ণব সংস্কৃতির অংশ স্বরূপ। আর মন্দির চত্বরে ৩০০ বছরের পুরনো বকুল গাছ, যা কিনা পরিচিত ‘সিদ্ধ বকুল’ নামে। কথিত আছে এই বকুল গাছ তলায় বিপদে পড়ে যদি কেউ মানত করে বকুল গাছে ইঁট ,নুড়ি বা শিলা বাঁধেন তিনি ফল পেয়ে যান হাতেনাতে । নিয়ম অনুযায়ী ফল পাবার পর ইঁট , নুড়ি বা পাথর বকুল গাছ থেকে খুলে এই স্থানে পুজো দেন মানতকারী । বিশ্বাস আর ভক্তিতে এই মন্দির আজ জাগত। প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে মন্দিরকে কেন্দ্র করে মেলা বসে । মেলায় সাধু সমাগম যে লেগেই থাকে বলাই বাহুল্য। পূর্ণদাস বাউল আর তার সম্প্রদায় আসতেন বাউল গান পরিবেশন করতে। শোনা যায়, যুগল কিশোর দর্শনে মহিলারা অনাথিনী হন না। এ প্রার্থনা মনে নিয়েই ভিড় জমান মহিলারা।

এখন এই মন্দিরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকার মূর্তি ছাড়া আরও মূর্তি পূজিত হয়। যার মধ্যে রয়েছে কালাচাঁদ, গোপীনাথ, শ্যামচাঁদ, রাধাবল্লভ, গোপীবল্লভ, শালগ্ৰামশিলা, বলরাম, রেবতী, সাক্ষীগোপাল, বালগোপালের মূর্তি। মন্দিরের শ্রীকৃষ্ণ মূর্তিটি কষ্টিপাথর দ্বারা নির্মিত। এই মন্দিরের দেওয়াল দেখা মিলবে সুন্দর পঙ্খ অলংকারের কাজ। রয়েছে পাঁচটি খিলান। মন্দিরের পাশেই আছে প্রায় ৩০০ বছর পুরোনো একটি বকুল গাছ। এটি ‘সিদ্ধ বকুল’ নামেই পরিচিত। একসময় শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকা বিগ্ৰহটির মিলন হয়েছিল এই বকুল গাছের তলায়। তাই গাছটি শ্রীকৃষ্ণের ভক্তদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ষষ্ঠীপুজোর দিন বহু মহিলা এখানে আসেন পুজো দেওয়ার জন্যে। তাদের বিশ্বাস, জ্যৈষ্ঠ মাসে যুগল কিশোরের পুজো দিলে এই জন্মে ও পরের জন্মে বৈধব্যদশা ভোগ করতে হবে না।

প্রতিবছর এই জ্যৈষ্ঠ মাসেই মন্দিরের মূল উপাস্য দেবতা অর্থাৎ যুগল কিশোরের বাৎসরিক পুজা উৎসব উদযাপন করা হয়। এই সময় একটি মেলাও বসে সেখানে। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু মানুষ আসেন এই মেলাতে। বলা যেতেই পারে নদীয়ার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান আরংঘাটা যুগল কিশোর মন্দির । কলকাতার শিয়ালদা স্টেশন থেকে গেদে ট্রেনে আড়ংঘাটায় নেমে পাঁচ মিনিট পথ । অন্যদিকে কৃষ্ণনগর থেকে বাসে করে আরংঘাটা নেমে পাঁচ মিনিটের পথ ।