ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী কমরেড নলিনী দাস এক কিংবদন্তী নায়ক।।

0
32

ভূমিকা—

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল কিছু মানুষের অব্যর্থ পরিশ্রম যার ফলেই ব্রিটিশদের থেকে ভারত রাজনৈতিক দিক থেকে মুক্তি পেয়েছে। ভারত উপমহাদেশের বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সশস্ত্র বিপ্লববাদী লড়াই-সংগ্রাম সংগঠিত হয় এবং যার ধারাবাহিকতায় ভারত স্বাধীন হয়, তার মূলে যে সকল বিপ্লবীর নাম সর্বজন স্বীকৃত তাঁদের মধ্যে নলিনী দাস প্রথমসারির একজন অন্যতম বিপ্লবী। নলিনী দাস (১ জানুয়ারি ১৯১০ – ১৯ জুন, ১৯৮২) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের বিপ্লবী। ১৯২৯ সনে মেছুয়াবাজার বোমার মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তিনি আত্মগোপন করেন। পলাতক অবস্থায় ১৯৩০ সনে কলকাতার পুলিস কমিশনার চার্লস টেগার্ট সাহেবকে হত্যা-প্রচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার হন।

জন্ম—-

একনিষ্ঠ দেশ সেবক এই অকৃতদার মহান বীরের জন্ম ১৯১০ সালের ১লা জানুয়ারি উত্তর শাহবাজপুর বর্তমান ভোলার সদর উপজেলায়। স্থানীয় জমিদার স্টেটের নায়েব দূর্গা মোহন দাসের পুত্র নলিনী দাস ভোলা শহরের কালীনাথ বাজার এলাকায় শৈশব কাটিয়েছিলেন। তার শিক্ষা জীবনের শুরুও ভোলাতেই।  পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় হরতাল ধর্মঘটে যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন। এ কারনে তিনি ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতমাতাকে মুক্তি করার জন্য অগ্নি শপথ নেন। ১৯২৪ সালে তিনি যুক্ত হন বিপ্লববাদী যুগান্তর দলে। পড়াশুনা আর দেশের স্বাধীনতার জন্য দৃঢ়চিত্তে শুরু অক্লান্ত পরিশ্রম। ১৯২৮ সালে ভোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে বরিশাল বি. এম. কলেজে আই.এস.সি. ক্লাসে ভর্তি হন। বরিশালে সে সময় তিনি একজন ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। পরীক্ষার আগেই মামলা পড়ায় আর পরীক্ষা দিতে পারেননি।.এস.সি পরীক্ষার পূর্বেই কলিকাতা মেছুয়া বাজার বোমা মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। শুরু হয় পালাতক জীবন। পলাতক অবস্থায় ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতার পুলিশ কমিশনার ট্রেগার্ড সাহেবকে হত্যার প্রচেষ্টা মামলায় তিনি গ্রেফতার হন। ওই মামলার বিচারে তিনি খালাস পান।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা —

ভোলা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর ছাত্র নলিনী দাস ১৯২১ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও খেলাফত আন্দোলন কমিটির আহ্বানে পাঞ্জাবের জালিওয়ানবাগে ব্রিটিশের নৃশংসয় গণহত্যার প্রতিবাদে হরতাল ও ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করেন। এই অপরাধে ব্রিটিশ পুলিশ অপর ৫ ছাত্রের সাথে নলিনী দাসও গ্রেফতার করে। মাত্র ১১ বছর বয়সে শুরু হয় নলিনী দাসের কারা জীবন। এই মহান সৈনিক আন্দামানের কারা নির্বাসনসহ ৭২ বছর জীবনের ২৩ বছরই কাটিছেন কারাগারের অন্ধকারে। অপর দিকে ২১ বছর ছিলেন আত্মগোপনে। সেখানে থেকেও তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

 

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে কাজ—-

নলিনী দাস ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নিষ্ঠাবান কর্মী হিসেবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিধ্বস্ত কলকাতায় প্রতিরোধ কমিটির কাজে তৎপর ছিলেন।

বরিশালে কর্মজীবন—-

নলিনী দাস দেশবিভাগের পর বরিশালে চলে যান। ভোলা জেলায় কৃষক আন্দোলনের কাজে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধকালে এক মিথ্যা মামলায় পাকিস্তান সরকার ১০ বছর কারাদণ্ড প্রদান করে। হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পেলেও জেল গেটে পুনরায় গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিনা বিচারে রাজবন্দি হিসেবে আটক থাকেন। এরপর মুক্তি পান এবং আবার আটক করা হয়। ১৯৫৬ খ্রিস্টবাদের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্দী জীবনযাপন করেন। সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার আমলে ছাড়া পান। ১৯৫৮ সালে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। ১৯৫৮ সাল থেকে আত্মগোপন অবস্থায় বরিশালের গ্রামে গ্রামে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

জেল ও পলাতক জীবন—-

সত্তর বছরের জীবনের ভেতরে ২৩ বছর আন্দামান সেলুলার জেল, ব্রিটিশ ভারতের অন্যানয জেল, ভারতের জেল ও পাকিস্তানের কারাগারে অতিবাহিত করেন। ২০ বছর নয় মাস কাটান গোপন পলাতক জীবন।

একটানা ১৪ বছর জেল খাটার পর তিনি আপর জন্মভূমিতে ফিরে এলে ভোলাবাসী তাকে বিশাল সংবর্ধনা প্রদান করে। ব্রিটিশরা চলে গেলেও নলিনী দাসের ফের পাকিস্তানের সৈরাচারী সরকারের বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। ৪৭ সালেই পাকিস্তান মুসলিমলীগ সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। শুরু হয় তার আবারও পলাতক জীবন। ৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলাকালে বরিশালের নিভৃত এক পল্লীতে গোপন সভা চলাকালীন সময়ে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। পরে তাকে ১০ ছরের কারা দ- দেয়া হয়। ৫৯ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকার তাকে মুক্তি দেন। ৬৯ সালে আইয়ুব খানের শাসনামলে পুনরায় তিনি আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ফের সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তার রচিত “ স্বাধীনতা সংগ্রামে দ্বীপান্তরে বন্দী” গ্রন্থ থেকে বিপ্লবী জীবনের নানা রোমঞ্চকর তথ্য পাওয়া যায়।

জনকল্যাণে আত্মনিয়োগ—

নলিনী দাস শুধু ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনই করেন নি। তিনি এদেশের অবহেলিত কৃষক শ্রমিকের মুক্তির আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিভিন্ন সময়ের দুর্ভিক্ষ, খরা, মহামারি আর দাঙ্গার সময় তিনি সাধারণ মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন। স্বাধীনতার পরে দেশ পুনর্গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ভোলা শহরে তার পৈত্রিক কোটি টাকার সম্পদ তিনি জনকল্যাণে ব্যায় করেছেন। গঠন করেছেন দূর্গামোহন দাস জনকল্যাণ ট্রাস্ট। দানবীর হিসেবে পরিচিত এই মহান ব্যক্তির দানকৃত সম্পদ নিয়ে গড়ে তোলা হয় লায়ন্স হোমিও কলেজ ও নলিনী দাস হাসপাতাল, নলিনী দাস বালিকা বিদ্যালয়, নলিনী দাস স্মৃতি পাঠাগারসহ বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান।জনগণের কল্যাণে স্মস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দুর্গামোহন ট্রাস্টের নিকট প্রদান করেন।

মৃত্যু—

ইস্পাত দৃঢ় সংকল্প ও অফুরন্ত কর্মশক্তির অধিকারী, আমৃত্যু ত্যাগী এই বিপ্লবী যোদ্ধা তাঁর সারাটি জীবন মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। মানব সভ্যতাকে সাম্যবাদে উত্তোরণের ক্ষেত্রে বিপ্লবী সংগ্রামে তিনি ছিলেন আত্মনিবেদিত। মার্কসবাদের মতবাদকে গ্রহণ করে কমিউনিজমের মহান ব্রত নিয়ে নিবেদিত করেছেন জীবনের প্রতিটি মূহূর্ত। আপোষহীণ দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের এই মহান ব্যক্তি দূরারোগ্য যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় উন্নত চিকিৎসার জন্য গেলে ১৯৮২ সালের ১৯ জানুয়ারি মৃত্যু বরণ করেন।

।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।