স্মরণে বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় : প্রশান্ত কুমার দাস।

0
23

“সেই ধন্য নরকূলে লোকে যারে নাহি ভুলে,
মনের মন্দিরে যারে পূজে সর্বজন।”
উনিশ শতকে বাংলার বুকে এমন অনেক মনীষী আবির্ভূত হয়েছিলেন যাঁরা আমাদের মনের মন্দিরে সর্বদা পুজো পেয়ে থাকেন, তাঁদের মহৎ কর্মের জন্য আমরা বাঙালি হিসাবে গর্বিত।
এইরূপ একজন স্বনামখ্যাত পুরুষ সিংহ ছিলেন যিনি “বাংলার বাঘ” নামেই সর্বাধিক পরিচিত।আজ থেকে একশত পঞ্চান্ন বছর আগে কলকাতার বৌবাজারে ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দের ২৬ শে জুন তারিখে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতা গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন বিখ্যাত চিকিৎসক। তাঁর মাতা ছিলেন জগত্তারিনী দেবী।
ছোট বেলা থেকেই আশুতোষ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী।চক্রবেড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে তিনি কলকাতার সাউথ সুবার্বন স্কুলে পড়াশুনা করেন।তিনি পড়াশুনাতে অত্যন্ত মনোযোগী ও অধ্যবসায়ী ছিলেন।সারাদিন তিনি এত পড়াশুনা করতেন যে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হলো।তখন একদিন তাঁর পিতা তাঁকে একটা ঘরে আবদ্ধ করে রাখলেন।সারদিন শেষে ঘরের দরজা খুলে দেখা গেল যে,ঘরের মেঝেতে  ও দেওয়াল গুলিতে অংক কষা ও জ্যামিতি আঁকা রয়েছে।সকলে উনার অধ্যবসায় দেখে বিস্মিত হলেন।প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় স্থান এবং বি.এ পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেন এবং সেই সঙ্গে “প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ” বৃত্তি লাভ করলেন।তাঁর অংক শাস্ত্র সম্পর্কে কয়েকটি তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ ইংল্যান্ডেও প্রকাশিত হওয়ায় তাঁর নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

আশুতোষ শুধুমাত্র অংকশাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন না,তিনি বিজ্ঞান,দর্শন,আইন,এমনকি বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন।আইন গবেষণা করার জন্য তিনি “ডক্টর অফ ল” উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯০৩ খ্রিঃ থেকে ১৯১৩ খ্রিঃ পর্যন্ত তিনি কলকাতা তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ অলংকৃত করেছিলেন। ২৪ বছর বয়সেই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি আজীবন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতিকল্পে নানাপ্রকার কাজ করেছিলেন।তিনিই প্রথম বাংলাভাষার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন।
তিনি আইন পরীক্ষায় ভালভাবে উত্তীর্ন হয়ে কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করতে শুরু করেন।অল্পদিন পরে নিজ প্রতিভার জোরে তিনি হাইকোর্টের বিচারপতির পদ অলংকৃত করেন।এক্ষেত্রেও তিনি যথেষ্ট সুনাম ও প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন।
তখন ব্রিটিশ রাজত্ব পুরোদমে চলছে।তাদের দাপটে সকলে তটস্থ।এই অবস্থাতেও কত নির্ভিক ও সাহসী পুরুষ ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তার পরিচয় পাওয়া যায়।একদা তিনি আলিগড় থেকে ট্রেনে আসছেন ।আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সেখানে ট্রেনের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন,তাঁর নতুন জুতো খুলে রেখে ঘুমোচ্ছিলেন।
এমন সময়ে একটা স্টেশনে একজন ইংরেজ সাহেব সেই কামরাতে আরোহন করলেন।ধুতি-চাদর পরিহিত এক বাঙালিকে ট্রেনের কামরার মধ্যে ঘুমোতে দেখে তিনি তো রেগে আগুন।তিনি আশুতোষের নতুন জুতো জোড়া জানলার বাইরে ফেলে দিয়ে অপর একটা বেঞ্চে ঘুমোতে শুরু করলেন।কিছুক্ষণ পরে আশুতোষের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি তাঁর জুতো দুটি দেখতে না পেয়ে বিস্মৃত হলেন।তিনি বুঝতে পারলেন যে,ঐ ইংরেজ সাহেবই তাঁর জুতা ফেলে দিয়েছে।আশুতোষও কম সাহসী ছিলেন না।তিনি দেখলেন সাহেবের মাথার উপর তাঁর টুপিটা ঝুলছে।আশুতোষ টুপিটা নিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলেন।একটু পরে সাহেব ঘুম থেকে উঠলেন,কিন্তু তিনি তাঁর টুপি খুঁজে না পেয়ে খুব রেগে গেলেন এবং আশুতোষকে টুপি সম্পর্কে জিঙ্গাসা করলেন ।আশুতোষ নির্ভিক ভাবে উত্তর দিলেন – “Your hat has gone to fetch my shoes”. সাহেব নিজের অন্যায় বুঝতে পেরে আশুতোষ কে আর কিছু বলতে সাহস করলেন না।এরূপ তেজস্বী নির্ভিক পুরুষ বাঙালীর মধ্যে খুবই কম দেখা যায়।তাঁর এই তেজস্বীতার জন্য তিনি ‘বাংলার বাঘ’ নামে সুপরিচিত।

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মাতৃভক্তি ছিল প্রবল।প্রাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মাতৃভক্তির মতই ছিল তাঁরও অসীম মাতৃভক্তি একবার বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড কার্জন আশুতোষকে ইংল্যান্ড যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান।কিন্তু আশুতোষের মাতার ছেলেকে ইংল্যন্ড যেতে দিতে মত ছিল না।আশুতোষ লর্ড কার্জনকে জানালেন ‘মায়ের অমতে আমি ইংল্যান্ড যেতে পারব না।‘ তখন গর্বিত লর্ড-কার্জন আশুতোষকে লিখলেন- ‘আপনি আপনার মাকে জানিয়ে দেন যে,ভারতের বড়লাট আপনাকে ইংল্যান্ড যেতে আদেশ করছেন।‘ কিন্তু নির্ভিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায় স্পষ্ট করে জানালেন  – “আমার কাছে মায়ের আদেশই সবচেয়ে বড় আদেশ।মায়ের আদেশ ছাড়া আমার পক্ষে ইংল্যান্ড যাওয়া সম্ভব নয়।”
এভাবে সারাজীবন তিনি অনেক তেজস্বীতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ‘বাংলার বাঘ’ নামকরন তাঁর সার্থক হয়েছিল।
বাংলার এই তেজস্বী দেশপ্রেমিক কর্মবীর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ শে মে তারিখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজও তাঁর সম্পর্কে মূল্যায়ন ঠিক মত হয়নি।আমরা তাঁর জন্মদিনে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাঁকে স্মরণ করবো। যদি বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা আশুতোষের মত ব্যক্তির উজ্জ্বল কর্মপ্রেরণা,তেজস্বীতা,স্বদেশপ্রেম ইত্যাদি বিষয় সমূহ জানতে পেরে অনুপ্রানিত হতে পারে তাহলেই তাঁর মত মনীষীর জন্মদিন পালন করা সার্থক হবে।
আমরা জানি,তিনি বাংলার বুকে যে জ্ঞানের আলো জ্বেলেছিলেন –
“সেই আলোক-শিখা আজও উজ্জ্বল
ঘুচে গেছে সব কালো।“

শিক্ষারত্ন প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক (বাজিতপুর উচ্চ বিদ্যালয়(উঃমাঃ)
(পোঃ-পাথাই, ময়ূরেশ্বর-১,বীরভূম)