বিংশ শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য বাঙালি কবি ও গদ্যকার সুভাষ মুখোপাধ্যায় – একটি বিশেষ পর্যালোচনা।

0
44

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯ অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে মামাবাড়িতে। তার পিতার নাম ক্ষিতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মা যামিনী দেবী। পিতা ছিলেন সরকারি আবগারি বিভাগের কর্মচারী; তার বদলির চাকরির সুবাদে কবির ছেলেবেলা কেটেছিল পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে। তার ছেলেবেলার প্রথম দিকটা, যখন তার বয়স তিন-চার, সে সময়টা কেটেছে কলকাতায়, ৫০ নম্বর নেবুতলা লেনে।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিংশ শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য বাঙালি কবি ও গদ্যকার। কবিতা তার প্রধান সাহিত্যক্ষেত্র হলেও ছড়া, রিপোর্টাজ, ভ্রমণসাহিত্য, অর্থনীতিমূলক রচনা, বিদেশি গ্রন্থের অনুবাদ, কবিতা সম্পর্কিত আলোচনা, উপন্যাস, জীবনী, শিশু ও কিশোর সাহিত্য সকল প্রকার রচনাতেই তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

তিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বাঙালি কবি। আধুনিক বাংলা কাব্যজগতে চল্লিশের দশকের অন্যতম কবি হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৪০-এ প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’ প্রকাশের মধ্য তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জগতে নতুন সুর নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে মানুষের বৈষম্যলাঞ্চিত দুর্দশার বিরূদ্ধে দ্রোহ তাঁর কবিতার মূল সুর। ‘পদাতিক’ প্রারম্ভে ছিল ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য কাঠফাঁটা রোদে সেঁকে চামড়া’। কথ্যরীতিতে রচিত তার কবিতা সহজবোধ্যতার কারণে ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর আনুকূল্য লাভ করে। মানবিক বোধ ও রাজনৈতিক বাণী তার কবিতার অন্যতম প্রধান অভিমুখ।
কাব্যগ্রন্থ—–
পদাতিক (১৯৪০), অগ্নিকোণ (১৯৪৮), চিরকুট (১৯৫০), ফুল ফুটুক (১৯৫৭), যত দূরেই যাই (১৯৬২), কাল মধুমাস (১৯৬৬), এই ভাই (১৯৭১), ছেলে গেছে বনে (১৯৭২), একটু পা চালিয়ে ভাই (১৯৭৯), জল সইতে (১৯৮১), চইচই চইচই (১৯৮৩), বাঘ ডেকেছিল (১৯৮৫), যা রে কাগজের নৌকা (১৯৮৯), ধর্মের কল (১৯৯১)।
কবিতা সংকলন—–
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৭০), সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যসংগ্রহ, প্রথম খণ্ড (১৩৭৯ বঙ্গাব্দ), সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যসংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড (১৩৮১ বঙ্গাব্দ), কবিতাসংগ্রহ ১ম খণ্ড (১৯৯২), কবিতাসংগ্রহ ২য় খণ্ড (১৯৯৩), কবিতাসংগ্রহ ৩য় খণ্ড (১৯৯৪), কবিতাসংগ্রহ ৪র্থ খণ্ড (১৯৯৪)।
অনুবাদ কবিতা—–
নাজিম হিকমতের কবিতা (১৯৫২), দিন আসবে (১৩৭৬ বঙ্গাব্দ, নিকোলো ভাপৎসারভের কবিতা), পাবলো নেরুদার কবিতাগুচ্ছ (১৩৮০ বঙ্গাব্দ), ওলঝাস সুলেমেনভ-এর রোগা ঈগল (১৯৮১ বঙ্গাব্দ), নাজিম হিকমতের আরো কবিতা (১৩৮৬ বঙ্গাব্দ), পাবলো নেরুদার আরো কবিতা (১৩৮৭ বঙ্গাব্দ), হাফিজের কবিতা (১৯৮৬), চর্যাপদ (১৯৮৬), অমরুশতক (১৯৮৮)।
ছড়া—–
মিউ-এর জন্য ছড়ানো ছিটানো (১৯৮০)।
কবিতা সম্পর্কিত গদ্যরচনাসম্পাদনা
কবিতার বোঝাপড়া, টানাপোড়েনের মাঝখানে।
রিপোর্টাজ ও ভ্রমণসাহিত্য—-
আমার বাংলা (১৯৫১), যেখানে যখন (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), ডাকবাংলার ডায়েরী (১৯৬৫), নারদের ডায়েরী (১৩৭৬ বঙ্গাব্দ), যেতে যেতে দেখা (১৩৭৬ বঙ্গাব্দ), ক্ষমা নেই (১৩৭৮ বঙ্গাব্দ), ভিয়েতনামে কিছুদিন (১৯৭৪), আবার ডাকবাংলার ডাকে (১৯৮৪), টো টো কোম্পানী (১৯৮৪), এখন এখানে (১৯৮৬), খোলা হাতে খোলা মনে (১৯৮৭)।
অর্থনৈতিক রচনা—-
ভূতের বেগার (১৯৫৪, কার্ল মার্ক্স রচিত ওয়েজ লেবার অ্যান্ড ক্যাপিটাল অবলম্বনের)।
অনুবাদ রচনা—-
মত ক্ষুধা (১৯৫৩, ভবানী ভট্টাচার্যের সো মেনি হাঙ্গার্স উপন্যাসের অনুবাদ), রোজেনবার্গ পত্রগুচ্ছ (১৯৫৪), ব্যাঘ্রকেতন (নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন ও কর্মভিত্তিক একটি অনুবাদ), রুশ গল্প সঞ্চয়ন (১৯৬৮), ইভান দেনিসোভিচের জীবনের একদিন (১৯৬৮), চে গেভারার ডায়েরী (১৯৭৭), ডোরাকাটার অভিসারে (১৯৬৯, শের জঙ্গের ট্রায়াস্ট উইথ টাইগার্স অবলম্বনে), আনাফ্রাঙ্কের ডায়েরী (১৯৮২), তমস (১৩৯৫ বঙ্গাব্দ, ভীষ্ম সাহানীর উপন্যাসের অনুবাদ)।
উপন্যাস—-
হাংরাস (১৯৭৩), কে কোথায় যায় (১৯৭৬)। ‘কমরেড কথা কও'(১৯৯০)।
জীবনী—–
জগদীশচন্দ্র (১৯৭৮), আমাদের সবার আপন ঢোলগোবিন্দের আত্মদর্শন (১৯৮৭), ঢোলগোবিন্দের এই ছিল মনে।
শিশু ও কিশোর সাহিত্য—
নীহাররঞ্জন রায় রচিত বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থের কিশোর সংস্করণ (১৯৫২), অক্ষরে অক্ষরে আদি পর্ব (১৯৫৪), কথার কথা (১৯৫৫), দেশবিদেশের রূপকথা (১৯৫৫), বাংলা সাহিত্যের সেকাল ও একাল (১৯৬৭), ইয়াসিনের কলকাতা (১৯৭৮)।
সম্পাদিত গ্রন্থ—
কেন লিখি (১৯৪৫, বিশিষ্ট বাঙালি সাহিত্যিকদের জবানবন্দী, হিরণকুমার সান্যালের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে রচিত), একসূত্র (১৯৫৫, ফ্যাসিবিরোধী কবিতা সংকলন, গোলাম কুদ্দুসের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনা), ছোটদের পুজো সংকলন – পাতাবাহার, বার্ষিক আগামী ইত্যাদি।
সংকলন—–
গদ্যসংগ্রহ (১৯৯৪) by Rupam Ghosh

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বঞ্চনা ও অসম্মান অনেক জুটলেও সাহিত্যের অঙ্গনে সম্মানিতই হয়েছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার পান ১৯৬৪ সালে; ১৯৭৭ সালে অ্যাফ্রো-এশিয়ান লোটাস প্রাইজ; ১৯৮২ সালে কুমারন আসান পুরস্কার; ১৯৮২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রদত্ত মির্জো টারসান জেড পুরস্কার; ১৯৮৪ সালে আনন্দ পুরস্কার এবং ওই বছরেই পান সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু পুরস্কার ও ১৯৯২ সালে ভারতীয় জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। ১৯৯৬ সালে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মাননা সাহিত্য অকাদেমী ফেলোশিপ পান সুভাষ মুখোপাধ্যায়। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানিত করেছিল তাদের সর্বোচ্চ সম্মান দেশিকোত্তম দ্বারা।
৮ জুলাই ২০০৩ সালে তিনি প্রয়াত হন।।
।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।