মূল্যবান মনুষ্য জীবনে গুরু পূর্ণিমার মহত্ব : স্বামী আত্মভোলানন্দ (পরিব্রাজক)l

0
67

ওঁ নমঃ শ্রী ভগবতে প্রণবায়।
ওঁ অজ্ঞানতিমিরান্ধ্যস্য জ্ঞানাঞ্জন-শলাকয়া ।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ ।।
প্রাচীনকালে আমাদের মূল্যবান মনুষ্য সমাজে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্ব পেত। সেই কারণে একটা দিন গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গুরুচরণে নিবেদন করত সকল ভক্ত ও শিষ্যগণ। গুরুর প্রতি শিষ্যের শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসাবে উদযাপন করা হয় এই দিন। বৈদিক মতে, প্রতি বছর আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পড়ে এই দিন। সংস্কৃতে ‘গু’ শব্দের অর্থ অন্ধকার। ‘রু’ শব্দের অর্থ অন্ধকার দূরীকরণ। গুরু শব্দের অর্থ, যিনি শিষ্যদের অন্ধকার বা অজ্ঞতা থেকে আলোর দিশা দেখান সেই ব্যক্তি গুরু। যিনি অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যান তিনিই গুরু। গুরু আমাদের মনের সব সংশয়, সন্দেহ, অন্ধকার দূর করেন এবং নতুন পথের দিশা দেখান। সকল ভক্ত ও শিষ্যগণ এই দিনে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রাচীনকাল থেকেই এই দেশে গুরুদের সম্মানজনক স্থান দেওয়া হয়েছে। গুরুর দেখানো পথে চললে, কোনও ব্যক্তি শান্তি, আনন্দ ও মোক্ষ প্রাপ্ত করতে পারেন। তাই গুরুকে শ্রদ্ধা জানাতে বৈদিক যুগ থেকেই গুরু পূর্ণিমা পালিত হয়ে আসছে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এই পূর্ণিমায় গুরুর পূজার্চনা করলে অক্ষয় আশীর্বাদ মেলে। তাই এই তিথিকে গুরু পূর্ণিমা আখ্যা দেওয়া হয়।

পুরাণ মতে, ভগবান শিব বা দেবাদিদেব মহাদেব হলেন আদি গুরু। সপ্তর্ষির সাতজন ঋষি হলেন তাঁর প্রথম শিষ্য – অত্রি, বশিষ্ঠ, পুলহ, অঙ্গীরা, পুলস্থ্য, মরীচি এবং কেতু। শিব বা মহাদেব এই তিথিতে আদিগুরুতে রূপান্তরিত হন এবং এই সাত ঋষিকে মহাজ্ঞান প্রদান করেন। তাই এই তিথিকে গুরু পূর্ণিমা আখ্যা দেওয়া হয়। এই তিথিতেই মুণি পরাশর ও সত্যবতীর ঘরে ব্যাসদেবের জন্ম হয়। জন্মের পরে তাকে ত্যাগ করেন সত্যবতী। পরবর্তীকালে নিজের যোগ্যতায় মহর্ষি হয়ে ওঠেন ব্যাসদেব। চতুর্বেদের সম্পাদনা ছাড়াও ১৮টি পুরাণ তিনি রচনা করেন। মহান এই ঋষির হাত থেকেই মহাকাব্য মহাভারতের রচনা। বেদের ব্যাখা ও বিন্যাস ঘটিয়েছেন বলেই মহর্ষিকে বেদব্যাস ও বলা হয়। মহাভারতের রচয়িতা মহর্ষি ব্যাসদেবের জন্মজয়ন্তী পালন করা হয় এই দিন। সেই কারণে এই বিশেষ দিনটিকে ব্যাস পূর্ণিমাও বলা হয়। বোধিজ্ঞান লাভের পর আষাঢ় মাসের পূর্ণিমায় প্রথম সকলকে উপদেশ দেন গৌতম বুদ্ধ। সেই কারণে এই দিনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের কাছেও।

সাধারণভাবে যিনি সদগুরু হবেন তাঁর কোন আকাঙ্খা, বিষয় কামনা থাকবে না। গুরু যদি শিষ্য করে তার সঙ্গে কারবার করেন, তাহলে হবে না। গুরু সদগুরু হলে তাঁর সানিধ্যে এলে মন শুদ্ধ হবে সেই গুরু যে পথে নিজে চলবেন, সেই পথ শিষ্যকে বলে দিতে পারেন। সেই পথে শিষ্য চললে পবিত্র জীবন যাপন করতে পারবে। গুরুর প্রধান গুন্ হচ্ছে তিনি শাস্ত্রজ্ঞ এবং ব্রহ্মনিষ্ঠ হবেন। তাঁর আচরণ শাস্ত্রসম্মত হবে, স্বার্থবুদ্ধি রহিত হয়ে কেবল শিষ্যের প্রতি করুণাদ্র চিত্তে অজ্ঞান সমুদ্র থেকে উদ্ধারের উপায় উপদেশ করবেন। শ্রোত্রিয় এবং ব্রহ্মনিষ্ঠ – এই দুটি কথা গুরু সম্বন্ধে বলা হয়। শাস্ত্রজ্ঞান না থাকলে প্রকৃত তত্ত্ব বুঝতে পারবে না , আবার ব্রহ্মনিষ্ঠ নাহলে সংশই দূর হয় না। ব্যবহারিক জীবনের গুরুর সঙ্গে আধ্যাত্মিক গুরুর এখানেই পার্থক্য।

প্রকৃত গুরুর যেমন কতকগুলি বিশেষ গুন্ থাকা দরকার, তেমনি শিষ্যেরও অর্থাৎ যে গুরুর কাছ থেকে উপদেশ ও নির্দেশ পেতে চায়, তারও কতকগুলি বিশেষ গুন্ থাকা দরকার। তবেই গুরুর নির্দেশ কার্যকর হবে। সেগুলি হল – পবিত্রতা, গুরুর প্রতি শ্রুদ্ধা ও তাঁর কথায় বিশ্বাস। কৌতুহল চরিতার্থ করবার জন্য দীক্ষা নেব, এরকম যেন না হয়। গুরুর নির্দেশের প্রতি পরম নিষ্ঠা থাকা চাই। শিষ্যের চরিত্র শুদ্ধ হতে হবে, গুরু এবং শিষ্য উভয়েরই চরিত্র-শুদ্ধির ওপর সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিষ্যকে বিনীত হতে হবে, উদ্ধত নয়। গভীর শ্রদ্ধার ভাব না থাকলে গুরুর আশ্রয় নেওয়া সম্ভব নয়।
গুরুপদ বরণ করার পরে নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর অনুসরণ করা শিষ্যের একান্ত প্রয়োজন। গুরুর জ্ঞান-সম্ভার গ্রহণে শিষ্যের নম্রতাই তাকে উপযুক্ত আধারে পরিনত করে। বিনয়, ঐকান্তিকতা, পবিত্রতা এবং সেবার মনোভাব না থাকলে গুরুসঙ্গ করে কোন লাভ হবে না।
গুরুর কৃপা হয় গুরুকে ভালবাসলে, বহু জন্ম ধরে একটু একটু করে শুভ কাজ করতে করতে তার একটা শুভ ফল জমা হয়। এইভাবে জমতে জমতে যখন ফল খুব বাড়ে, তখনই গুরুর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা হয়।

“ওঁ গুরুব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু গুরুর্দেবো মহেশ্বর।
গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।”
এই শ্লোকের অর্থ- জীবনে গুরুই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। তিনিই আমাদের সৃষ্টি, স্থিতি, লয়ের পরম ব্রহ্মজ্ঞান দান করেন। সেই গুরুর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাই। বর্তমানে শ্রীশ্রী গুরুপূর্ণিমা এক সর্বভারতীয় মহোৎসব, ভারতের প্রতিটি আশ্রম, মঠ, মন্দিরে, এ দিন মহাসমারোহ। নিজ নিজ রীতিনীতি অনুসারে সর্বত্র শ্রীশ্রীগুরুপূজার মহাধুম। এই দিন আনন্দ ও প্রীতির সহিত শ্রদ্ধা, ভক্তি, আনুগত্য, সেবা, আত্মনিবেদনের আবেদন সর্ব্বত্র সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। এইবছর আগামী ৫-ই শ্রাবণ রবিবার ১৪৩১, শ্রীশ্রী গুরুপূর্ণিমা তিথি। (21.07.2024). আসুন আমরা সকলে নিষ্ঠার সঙ্গে গুরুপূর্ণিমা উদযাপন করি। শ্রী শ্রী গুরু পূর্ণিমাতে জগৎ গুরু ভগবান স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজের শুভ ও মঙ্গলময় আশির্বাদ আপনাদের সকলের শিরে বর্ষিত হোকএই প্রার্থনা করি…!
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্ ।
স্বামী আত্মভোলানন্দ(পরিব্রাজক) l