কানাইলাল ভট্টাচার্য : ভারতের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের বিপ্লবী।

0
22

স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের বিপ্লবী নামে খ্যাত শহীদ কানাইলাল ভট্টাচার্য। মাত্র ২২ বছর বয়সে ১৯৩১ সালে বিচারক গার্লিককে হত্যার অভিযোগে ব্রিটিশ শাসকদের গুলিতে শহিদ হন এই বিপ্লবী। তবে ইতিহাস বলে, মৃত্যু বরণের পর এই বিপ্লবীর পকেটে এক খন্ড কাগজ পাওয়া যায়৷ যাতে লেখ ছিল ‘ধ্বংস হও, দীনেশ গুপ্তকে ফাঁসি দেওয়ার পুরস্কার লও’।
বর্তমান যুগে দেশের জন্য প্রাণত্যাগ করা এই শহীদরা প্রায় বিস্মৃতপ্রায়। কিন্তু বিস্মৃতির পলিতে ঢাকা পড়েছেন কানাইলাল | তিনিও অগ্নিযুগের এক বলিপ্রদত্ত বিপ্লবী | দেশের স্বার্থে‚ বিপ্লবের জন্য নাম-যশ-খ্যাতি কোনও কিছুর পরোয়া করতেন না কানাইলাল ভট্টাচার্যর মতো অগ্নিস্ফুলিঙ্গরা | তাঁর স্মৃতিতে আলিপুরের বেকার রোডের নামকরণ করা হয়েছে বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্য রোড | জন্মস্থান মজিলপুরের একটি রাস্তাও তাঁর নামে নামাঙ্কিত | পৈতৃক বাড়ির সামনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্রোঞ্জ মূর্তি | অবশ্য‚ দেশমাতৃকার মুক্তি ছাড়া এসব নিয়ে ভাববার সময় ছিল না কানাইলালদের।
কানাইলাল ভট্টাচার্য (২৭ জুলাই ১৯০৯ – ২৭ জুলাই ১৯৩১) ছিলেন ভারতের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের বিপ্লবী।

প্রাথমিক জীবন—
কানাইলাল ভট্টাচার্যের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মজিলপুরে। তার পিতার নাম নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।মাতার নাম কাত্যায়নী দেবীI চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সেজো। দুই দাদা কলকাতায় সামান্য চাকরী করতেন। কানাইলাল সেখানে ইলেকট্রিকের কাজ শিখতেন এবং দাদার একটি মুদির দোকানেও বসতেন। দোকানে বসেই তিনি কয়েকটি স্বদেশী বই পড়েন। বালেশ্বরের যুদ্ধ, চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠন প্রভৃতি ঘটনা তাঁকে আলোড়িত করে। ১৯৩১ সালের প্রথম দিকে জয়নগর মজিলপুর ব্যায়াম সমিতির প্রথম বাৎসরিক প্রতিষ্ঠা দিবসের উৎসবে সভাপতির পদ অলংকৃত করেন সুভাষ চন্দ্র বসু। তাঁকে স্বেচ্ছাসেবকরা বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ এর মাধ্যমে অভিবাদন জানায়। ওই কুচকাওয়াজে প্ল্যাটুন কমান্ডার হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন কানাইলাল। ওই দিনই তিনি মন্মথ ঘোষ ও সুনীল চট্টোপাধ্যায় এর হাত ধরে স্বাধীনতা বিপ্লব আন্দোলনে যোগ দেন এবং পরের দিনই দীক্ষিত হন। তিনি বিপ্লবী সাতকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় এর মতো সুপরিচিত বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন। তিনি মজিলপুর জে এম ট্রেনিং স্কুলে পড়াশুনা করেন।
তিনি জয়নগর-মজিলপুর, বহড়ু, বিষ্ণুপুর ব্যায়াম সমিতির সভ্য ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, বাঘাযতীনের বুড়িবালামের যুদ্ধ, মাস্টারদার জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি যুবক বয়সেই স্বাধীনতা বিপ্লব আন্দোলনে যোগ দেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলের সদস্য ছিলেন তিনি। বহড়ুর বিপ্লবী সুনীল চট্টোপাধ্যায়, বোড়ালের সাতকাড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সুপরিচিত বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন এবং একজন বিপ্লবী আন্দোলনের যোদ্ধায় পরিণত হন।
গার্লিক হত্যা—-
ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই কানাইলাল ভট্টাচার্য ‘বিমল দাশগুপ্ত’ ছদ্মনামে বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত ও বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির দণ্ডাদেশকারী বিচারক আর আর গার্লিককে হত্যা করেন এবং পটাশিয়াম সায়ানাইডের ক্যাপসুল খেয়ে নেন। সেই অবস্থায় উপস্থিত প্রহরী সার্জেন্টের গুলি তাঁর শরীর ঝাঁঝরা করে দেয়। সে সময় তাঁর পকেটে একখণ্ড কাগজ পাওয়া যায়। তাতে লেখা ছিল, “ধ্বংস হও; দীনেশ গুপ্তকে ফাঁসি দেওয়ার পুরস্কার লও”। তার পকেটে একখণ্ড কাগজ পাওয়া যায়। তাতে লেখা ছিলো “ধ্বংস হও; দীনেশ গুপ্তকে ফাঁসি দেওয়ার পুরস্কার লও” ইতি —– বিমল গুপ্ত। মাত্র ২২ বছর বয়সে নামহীন, পরিচয়হীন শহিদ হয়ে থেকে, অপর এক বিপ্লবীকে বাঁচিয়ে যাওয়ার এই চেষ্টা ইতিহাসে বিরল। মেদিনীপুরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট পেডির হত্যার ব্যাপারে পুলিস বিমল দাশগুপ্তকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তিনি ছদ্মনাম নিয়ে নিজ জীবনের বিনিময়ে বিমল দাশগুপ্তকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। পুলিস দীর্ঘদিন তার প্রকৃত পরিচয় উদ্ধার করতে পারেনি। এমনকি শনাক্তকরণের সময় কানাইলালের মহীয়সী মাতা কাত্যায়নী দেবীও তার দেহকে অস্বীকার করে বলেন “এ তার কানু নয়”। উল্লেখ্য এই ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ ২৬শে জুলাই ভোরে কসবা উত্তরপাড়ার বিল ধরে ডিঙ্গি চড়ে তপসিয়ায় ধাপার মাঠে এসে এক জঙ্গলে সুনীল চট্টোপাধ্যায়, জিতেন ঘোষ, প্রভাত ঘোষের উপস্থিতিতে টার্গেট প্র্যাকটিস করেন কানাইলাল। তার কিছুদিন আগেই তিনি টাইফয়েড থেকে উঠেছেন | নামহীন, পরিচয়হীন শহীদ হয়ে থেকে, অপর এক বিপ্লবীকে বাঁচিয়ে যাওয়ার এই চেষ্ঠা ইতিহাসে বিরল। কানাইলাল ভট্টাচার্য বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলের সদস্য ছিলেন।তিনি বিপ্লবী নেতা সাতকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মী। সাতকড়িবাবুই তাকে একাজে পাঠান।
সম্মাননা—-
এই দেশপ্রেমিকের স্মৃতিতে “আলীপুর বেকার রোড”-এর নাম পরিবর্তন করে “বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্য সড়ক” নামকরণ করা হয়েছে। মজিলপুরের একটি রাস্তাও তার নামে নামকরণ করা হয়েছে। মজিলপুরের দত্ত বাজারে তার পূর্বপুরুষের বাড়ির কাছে তার একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি রয়েছে।
ছোটবেলা থেকেই দেশের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা৷ আর সেই ভালোবাসাই কাল হয়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের জন্য৷ বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্য আজও বাঙালিদের কাছে দেশপ্রেমের জ্বলন্ত উদাহরণ৷
।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।