কিশোর কুমার ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের সর্বাধিক সফল এবং চলচ্চিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ নেপথ্য গায়ক এবং নায়ক, জন্ম দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি l।

0
17

কিংবদন্তী সঙ্গীত শিল্পী কিশোর কুমার কে চেনেননা এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল। শুধু দেশ নয়, গোটা বিশ্বে তিনি এক অতি পরিচিত নাম। সঙ্গীতের আকাশে তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র । কিশোর কুমার ছিলেন ভারতীয় গায়ক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং রেকর্ড প্রযোজক। সাধারণত তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের সর্বাধিক সফল এবং চলচ্চিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ নেপথ্য গায়ক হিসেবে বিবেচিত হন।
কুমার ছিলেন একজন বাঙালি পেশাজীবী পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান।কিশোর কুমার ১৯২৯ সালের ৪ ই আগস্ট ৪ টের সময় মধ‍্যপ্রধেশের খান্ডোয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের নাম আভাস কুমার গঙ্গোপাধ‍্যায়। তাঁর ডাক নাম ছিল কিশোর। তাঁর পিতার কুঞ্জলাল গাঙ্গুলী। তিনি ছিলেন উকিল। তাঁর মাতার নাম গৌরি দেবী, তিনি ছিলেন একজন গৃহকর্তী।
কুঞ্জলাল গাঙ্গুলীর পৈতৃক বাড়ি ও জন্মস্থান হলো ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরে (বর্তমান নাম মুন্সীগঞ্জ)। কুঞ্জলাল জীবিকার তাগিদে মধ্য প্রদেশে চলে যান। কিশোর কুমারের জন্মনাম ছিল আভাস কুমার গাঙ্গুলী। চার ভাই বোনের ভিতর কিশোর ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। সবথেকে বড় ছিলেন অশোক কুমার তারপর সীতা দেবী। তারপর অনুপ কুমার আর অনুপ কুমারের থেকে পাঁচ বছরের ছোট ছিলেন কিশোর কুমার। যখন তিনি একজন কিশোর ছিলেন, তিনি বোম্বে টকিজ ফিল্ম স্টুডিওতে মাঝে মাঝে কোরাস গায়ক হিসাবে বোম্বেতে (এখন মুম্বাই) চাকরি পেয়েছিলেন, যেখানে তার বড় ভাই অশোক কুমার ছিলেন বর্তমান তারকা।  যদিও তাঁর হৃদয় ছিল গান গাওয়ার মধ্যে, ছোট কুমার ১৯৪৬ সালে ননডেস্ক্রিপ্ট ফিল্ম শিকারীতে অভিনয়ে আত্মপ্রকাশ করেন।  এটি ছিল ১৯৫১ সালের আন্দোলনের রিলিজ, যা তাকে গায়ক-অভিনেতা হিসাবে স্টারডমে প্ররোচিত করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাকে তার ভাই অশোকের ছায়া থেকে মুক্ত করেছিল।
চার স্ত্রী ছিলেন কিংবদন্তি গায়ক কিশোর কুমারের- রুমা গুহ ঠাকুরতা, মধুবালা, যোগিতাবালি এবং লীনা চান্দাভাকর। কিশোর কুমারের প্রথম স্ত্রী এবং বাঙালি গায়িকা-অভিনেত্রী রুমার ছেলে অমিত কুমার। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত বিবাহবন্ধবে আবদ্ধ ছিলেন তাঁরা। রুমা গুহঠাকুরতা (১৯৫০-১৯৫৮), মধুবালা (১৯৬০-১৯৬৯), যোগিতা বালী (১৯৭৫-১৯৭৮) এবং লীনা চন্দাভারকর (১৯৮০-১৯৮৭)। কিশোরের প্রথম পুত্র (রুমা গুহ ঠাকুরতার সাথে) অমিত কুমার একজন বিখ্যাত গায়ক। কিশোর কুমারের প্রথম স্ত্রী রুমা গুহ ঠাকুরতা এবং কিশোর কুমারের সুযোগ্য সন্তান অমিত কুমার তার বাবার মত সাফল্য না পেলেও বেশ কিছু কালজয়ী হিন্দি ও বাংলা সুপারহিট গান উপহার দিয়েছেন। কিশোরের ছোট ছেলে সুমিত কুমার। সুমিত কুমার ছিলেন লীনা চন্দ্রভারকারের সন্তান।
খাদ্যাভাসে তাঁর ছিল খাঁটি বাঙালিয়ানা। তিনি পছন্দ করতেন বাঙালী খাবার । লুচি মাংস, আলুরদম, বেগুন ভাজা ইত‍্যাদি।  তিনি এতটাই মাছের প্রতি দূর্বল ছিলেন যে তাঁর সাথে যদি কেউ  দেখা করতে আসেন তাহলে তাঁর জন‍্য সেই অতিথি মাছ নিয়ে আসতেন। এমনকি তাঁকে গান রেকর্ডিং এ রাজি করানোর জন‍্য মাছ ঘুষ দিতেন। ঈলিশ মাছ ছিল তাঁর প্রিয়।তিনি মদ‍্যপান করতেন না।
কিশোর কুমার বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, অসমীয়া, গুজরাটি, কন্নড়, ভোজপুরি, মালয়ালম, ওড়িয়া, এবং উর্দু। এছাড়াও তিনি তার ব্যক্তিগত গান সংকলনেও বিভিন্ন ভাষায় গান গেয়েছেন, বিশেষত তার বাংলায় গাওয়া গানগুলি সর্বকালের ধ্রুপদী গান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তিনি ৮ বার শ্রেষ্ঠ পুরুষ নেপথ্য গায়কের জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেছেন এবং একই বিভাগে সর্বাধিক ফিল্মফেয়ার পুরস্কার বিজয়ের রেকর্ড করেছেন। তাকে মধ্যপ্রদেশ সরকার কর্তৃক লতা মঙ্গেশকর পুরস্কার প্রদান করা হয় এবং তার নামে হিন্দি চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য কিশোর কুমার পুরস্কার প্রদান চালু করে।কিশোর কুমারের গান বাংলা সঙ্গীতজগতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাঙালির সংষ্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতাবে জড়িয়ে রয়েছেন কিশোর কুমার। তার উদাত্ত কণ্ঠ মাধুর্য্য বাঙালিকে এখনও মুগ্ধ করে রেখেছে।

শধু গায়ক হিসাবে নন, তিনি হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের একজন নামি অভিনেতাও ছিলেন। তবে তিনি তাঁর প্রথম জীবনে গায়ক হিসেবে ততটা সাফল্য অর্জন করতে পারেননি যতটা তাঁর পাওয়া উচিত ছিল। তবুও তিনি অভিনেতা হিসেবে যথেষ্ট সুনাম ও মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তার অভিনীত বিখ্যাত কয়েকটি হাস্যরসাত্মক চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে বাপ রে বাপ (১৯৫৫), চলতি কা নাম গাড়ি (১৯৫৮), হাফ টিকিট (১৯৬২), পড়োশন (১৯৬৮), হাঙ্গামা (১৯৭১), পেয়ার দিবানা (১৯৭৩), বাড়তি কা নাম দাড়ি (১৯৭৪)। এছাড়া অন্যান্য চলচ্চিত্রের ভিতর রয়েছে নোকরি, বন্দী, দূর গগন কি ছাঁও মে, দূর কা রাহি প্রভৃতি।  তিনি সুদক্ষ অভিনেতা হওয়া সত্ত্বেও অভিনয় বস্তুটি অতটাও পছন্দ করতেন না। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ছিল সঙ্গীত।
ভারতের প্লেব্যাক গায়কদের শীর্ষে কুমারের উত্থান একটি অসাধারণ কীর্তি ছিল।  পেশায় তার সহকর্মীদের থেকে ভিন্ন, যাদের বেশিরভাগই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন, কুমারের কোনো আনুষ্ঠানিক সঙ্গীত প্রশিক্ষণ ছিল না।  তবুও, তিনি একজন দক্ষ অনুকরণকারী, দোভাষী এবং উদ্ভাবক ছিলেন।  তিনি রঙিন টিমব্রাল ইফেক্ট ব্যবহার করেছেন—যেমন ইয়োডেলিং—তার কণ্ঠে, বৈদ্যুতিক অঙ্গ এবং অন্যান্য অ্যাটিপিকাল যন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন এবং উচ্ছ্বসিত ছন্দে তার অভিনয়কে প্রাণবন্ত করেছেন।  এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলি শেষ পর্যন্ত কুমারের সামগ্রিক শব্দে আধুনিকতার একটি আকর্ষণীয় অনুভূতি প্রদান করেছে।
কিশোর কুমার সর্বমোট ২,৭০৩টি গান গেয়েছেন, যার মধ্যে ১১৮৮টি হিন্দি চলচ্চিত্রে, ১৫৬টি বাংলা এবং ৮টি তেলুগু ভাষায়।
প্লেব্যাক করা বাংলা ছবি—-
কবিতা, গুরুদক্ষিণা, জীবন মরণ, জ্যোতি, তুমি কত সুন্দর, অমরকন্টক, আশ্রিতা, অনিন্দিতা, অমর সঙ্গী, দোলন চাঁপা, পাপ পুণ্য, অমানুষ, বান্ধবী, মিলন তিথি, অন্তরালে, বৌমা, মোহনার দিকে, সঙ্কল্প, আনন্দ আশ্রম, রাজকুমারী, অন্যায় অবিচার, লুকোচুরি, অনুসন্ধান, সুরের আকাশে, দেবিবরণ, জীবন মরণ ইত্যাদি।
জনপ্রিয় বাংলা গান—
তোমায় পড়েছে মনে, নীল নীল আকাশে, সেদিনও আকাশে ছিল কত তারা, আমার মনের এই ময়ূর মহলে, আমার পূজার ফুল, এক পলকের একটু দেখা, এ আমার গুরুদক্ষিণা, একদিন পাখী উড়ে যাবে যে আকাশে, এই যে নদী, চিতাতেই সব শেষ, হাওয়া মেঘ সরায়ে, কি আশায় বাঁধি খেলাঘর, কি উপহার সাজিয়ে দেব, কত মধুর এ জীবন, এই যে নদী, চেয়েছি যারে আমি, নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে, সেই রাতে রাত ছিলো পূর্ণিমা, চোখের জলের হয় না কোনো রং, কেন রে তুই চরলি ওরে, কথা দিলাম, প্রেমের খেলা কে বুঝিতে পারে, শুনো শুনো গো সবে।
অভিনয় এবং গানের পাশাপাশি কুমার ভারতীয় চলচ্চিত্রের জন্য সঙ্গীত রচনা করেছিলেন।  তিনি দূর গগন কি ছাওঁ মে (১৯৬৪) এবং দূর কা রাহি (১৯৭১) সহ বেশ কয়েকটি প্রযোজনাও পরিচালনা করেছিলেন।  হালকা হৃদয়ের চলচ্চিত্রগুলির বিপরীতে যেখানে তিনি সাধারণত একজন অভিনেতা, গায়ক বা সুরকার হিসাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, কুমার যে চলচ্চিত্রগুলি পরিচালনা করেছিলেন সেগুলি প্রায়শই ট্র্যাজেডি ছিল।
তিনি বেশ কয়েকটি গানের জন‍্য পরপর আটবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। এখনো পর্যন্ত পরপর এতবার কেউ পায়নি। যে গান গুলির জন‍্য পেয়েছেন সেগুলি হল-  রুপ তেরা মস্তানা (১৯৭০), দিল অ্যাইসা কিসি নে মেরা (১৯৭৬), খাইকে পান বানারাস ওয়ালা (১৯৭৯), হাজার রেহেন মুডকে দেখেন (১৯৮১), পাগ ঘুঙরু বাধ( ১৯৮৩), আগার তুম না হতে (১৯৮৪), মাঞ্জিলে আপনি জাগা হ‍্যান ( ১৯৮৫), সাগর কিনারে (১৯৮৬)। ১৯৭৫ সালে কোরা কাগজ সিনেমায় গানের জন‍্য  “সেরা নেপথ্য গায়ক” হিসাবে পুরষ্কার পান। এছাড়া আরো সিনেমায় পুরষ্কার পান। সেগুলি হল,  আনন্দ (১৯৭১), আন্দাজ (১৯৭২), হরে রাম হরে কৃষ্ণ (১৯৭৫)।
আজ কিংবদন্তি গায়ক কিশোর কুমারের মৃত্যুবার্ষিকী। শেষ জীবনটা বড্ড একাকীত্বে কাটছে। ১৯৮৭ সালের ১৩ ই অক্টোবর মাত্র ৫৭ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটার্কে তাঁর মৃত‍্যু হয়। মৃত‍্যুর আগের দিনেও অর্থাৎ ১২ অক্টোবর তিনি স্টুডিয়োতে রেকর্ডিং করেন।আইকনিক গায়ক এবং অভিনেতা তাঁর গাওয়া বেশ কয়েকটি হিট গান এবং অনেক স্মরণীয় ছবিতে অভিনয়ের জন্য সকলের মনে এখনও জায়গা করে আছেন ও থাকবেন চিরদিন।
।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।