কাহিনী এ সত্য ! শ্রীরূপ চতুর্ভুজ ঠাকুর নামক এক পূজারী ব্রাহ্মণ ছিলেন । বড় সাধু মহাত্মা ছিলেন তিনি। যে বিগ্রহের তিনি সেবায়েত ছিলেন সেই বিগ্রহ অন্ত প্রাণ ছিলেন। দিবারাত্র তাঁর একই চিন্তা বিগ্রহের সেবায় যেন কোন ত্রুটি না থাকে , বিগ্রহের যেন কোন কষ্ট না হয় । তিনি সদা সর্বদা সজাগ থাকতেন এ ব্যাপারে ।
*
সন্ধ্যার পর সভা শেষ করে রাজমহলে বিশ্রাম নিতে যাওয়ার আগে রাজপুত রাণা আসতেন বিগ্রহ দর্শন করতে । এ ছিল তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক কাজ । সেদিন সভার কাজ শেষ হতে একটু দেরী হলো। আর তাই বিগ্রহ দর্শন করতে আসতেও বিলম্ব হলো। কিন্তু, রাজার আগমনে বিলম্ব বলে তো আর বিগ্রহের সেবার অপেক্ষা করা যায় না । তাই রূপ চতুর্ভুজ ব্রাহ্মণ ভোগ অর্পণ করে অর্চন শেষে বিগ্রহকে শয়ন দিয়ে দিলেন। রাজা এসে দেখলেন গর্ভ গৃহের দ্বার রুদ্ধ হয়ে গেছে। দ্বার রুদ্ধ কেন ! বিগ্রহ দর্শন করবেন তো রাজা ! রূপ চতুর্ভুজ বললেন, “মহারাণা বিগ্রহ তো যথাসময়ে শয়ন দিয়ে দিয়েছি। দুঃখিত মহারাণা ! আজ আপনার রাত্রের দর্শন হলো না ।” রাণা বললেন, “জানেন তো প্রতিদিন আমি ঠাকুর দর্শন করতে আসি। আজ একটু দেরি হলো আমার আসতে । আর, ঠাকুরকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন ?”
*
রূপ চতুর্ভুজ অনুধাবন করলেন যে রাণা মনে মনে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু তাঁরও যে কিছু করার নেই। “রাজ্যের মালিক রাণা আর জগতের মালিক যে শ্রীকৃষ্ণ ! জগতের মালিককে তো আর রাজ্যের মালিকের জন্য জাগিয়ে রাখা যায় না ! সময়মতো সেবা যে করতেই হবে। বিগ্রহ সেবায় কোন ত্রুটি আমি ইচ্ছে করে করবো না । শ্রীকৃষ্ণকে আমি কষ্ট দিতে পারবো না।”— ব্রাহ্মণ মনে মনে ভাবলেন ।
*
রাণা ফিরে যাচ্ছিলেন বিফল মনোরথে। চতুর্ভুজ বলে উঠলেন, “রাণা একটু দাঁড়ান। আমি আপনার জন্য প্রসাদী মালা রেখে দিয়েছি । এনে দেই।” রাণা দাঁড়িয়ে পড়লেন । প্রতিদিনের মতন সেদিনও রূপ চতুর্ভুজ মালা এনে দিলেন রাণাকে। বিগ্রহের কন্ঠের মালা এ । শয়নে যাবার পূর্বে খুলে রাখা হয়েছিল। হাতে নিয়ে মাথায় ঠেকাতে যেতেই রাণা লক্ষ্য করলেন মালায় একটি দীর্ঘ পক্ক কেশ লেগে আছে। দেখেই রাজা সর্বাঙ্গ কেমন যেন ঘৃণায় গুলিয়ে উঠল। ভয়ানক ক্রুব্ধ হয়ে গেলেন তিনি। বলে উঠলেন, “কী ব্যাপার ! পক্ক কেশ কেন লেগে ? মালায় এলো কোথা থেকে এটা ? বিগ্রহকে পরানোর আগে খেয়াল করেন নি? এভাবে মালা পরিয়ে দিয়েছেন ! আশ্চর্য !”
*
এমনিতেই ব্রাহ্মণ ঠাকুরের উপর মেজাজটা রাণার ক্ষিপ্ত ছিল আর এখন যখন এই পাকা চুল দেখলেন প্রসাদী মালায় তখন যেন আগুনে ঘি পরার মত হল । আরো বেশি রেগে গেলেন রাণা । এদিকে ঘটনার এই আকস্মিকতা স্বপ্নেরও বাইরে ছিল রূপ চতুর্ভুজের । তিনি মলিন মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। রাণা আরো রেগে গেলেন। বললেন, “কী হলো ? বলুন, এই পক্ককেশ এল কোথা থেকে ?”
*
চতুর্ভুজ ব্রাহ্মণ পরিস্থিতির সামাল দিতে মুখ ফসকে বলে ফেললেন, “তাহলে বোধ হয় বিগ্রহেরই হবে ওটা। আমি তো মালা ভালো করে দেখেই পরিয়েছি গোবিন্দকে।”
*
ক্ষুব্ধ রাণা ব্যঙ্গ করে বললেন, “বাহ্, অসাধারণ যুক্তি তো আপনার, পূজারী ব্রাহ্মণ ! বলার আগে একবার ভাবলেনও না যে কী বলছেন ! বলতে তো পারতেন যে, ভুল হয়ে গেছে, খেয়াল করি নি। মালায় কেশ লাগা ছিল দেখতে পাই নি। তা না বলে, বলেদিলেন বিগ্রহের কেশ ! আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছি আপনার সাহস দেখে । আপনি কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন সেটা ভুলে গেলেন ?”
*
এদিকে চতুর্ভুজ ব্রাহ্মণ ভাবছেন, “হায় ,হায় ! এ আমি কী বলে ফেললাম ভয় পেয়ে গিয়ে ! কি হবে এখন !”
মহারাণা বলে চলেছেন, “বেশ, আমি কাল সকালে আসব বিগ্রহ দর্শন করতে । তখন বিগ্রহের মাথার পক্ক কেশ পরীক্ষা করবো । আর যদি আমায় না দেখাতে পারেন তাহলে উচিত দণ্ডের জন্য এখন থেকেই প্রস্তুত থাকুন।” এই বলে তিনি গটগট করে বেরিয়ে গেলেন মন্দির থেকে।
*
রূপ পূজারির মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়ল। ভীত হয়ে মুখ ফসকে যে কথা বলে ফেলেছেন সে কথাকে আর যে ফেরানোর উপায় নেই ! সব পথ বন্ধ করে রাণা চলে গেলেন । এখন কী করা যায় ! ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন ব্রাহ্মণ ঠাকুর এই ভেবে যে দণ্ড আমায় পেতে হবে তা তো নিশ্চিত ! কিন্তু , রাণা যদি এই দণ্ড দিয়ে বসে যে প্রভু সেবার আর আমি অধিকারী থাকবো না , তাহলে কী হবে ? আমি যে প্রাণে মরে যাব আমার থেকে প্রভুর সেবা কেড়ে নিলে। এ জীবন তখন থাকা না থাকার সমান হবে । যত ইচ্ছা সাজা দিন রাণা , আমায় ভাতে মারুন । কিন্তু ,বিগ্রহ সেবা যেন আমার থেকে না কাড়েন।”
*
রূপ চতুর্ভুজের দু’চোখের পাতা এক হলো না সারা রাত। তিনি প্রতিটি মুহূর্তে গোবিন্দদেবের কাছে প্রার্থনা জানাতে থাকলেন। “হে গোবিন্দ ! হে বিপদভঞ্জন মধুসূদন ! এবার তুমি যদি আমায় কৃপা না কর, তাহলে কী ভাবে আমি এই বিপদসমুদ্র থেকে উত্তীর্ণ হব ! আমায় যে তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হবে। আমি তো আর তোমার সেবাপূজা করতে পারব না ! শাস্ত্রে তো তোমায় বলা হয়েছে ……তোমার যা করার সেটা তুমি করেই ছাড়ো, কারোর সাধ্যি নেই তোমায় তা থেকে সরিয়ে আনার । তোমার যা না করার হয় , তা কারোর সাধ্য নেই তোমায় দিয়ে করানোর । আবার , ‘অন্যথা-কর্ত্তুম’ তুমি অসম্ভব ব্যাপারও যদি চাও তো সম্ভব করিয়ে দাও। তুমি তখন কোন বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সম্ভব-অসম্ভব ,উচিত-অনুচিত, বাস্তব-অবাস্তব কোন কিছুরই আর অপেক্ষা রাখো না। এবার তুমি সত্য করে দেখাও তোমার ‘অন্যথা-কর্ত্তুম’ বিশেষণ। তাহলেই একমাত্র আমার শাস্তি রদ হতে পারবে। প্রভু গো , আমি জানি আমার ভক্তি নেই, কিন্তু , তুমি তো দয়াল ! প্রভু, তোমার সেবা থেকে যাতে আমি বঞ্চিত না হই, তার জন্য একবারের জন্য এমন কী হতে পারে না যে তোমার মস্তক থেকে পক্ক কেশ প্রকাশ পেল । হ্যাঁ , আমি জানি এ আবদার আমার চূড়ান্ত অবাস্তব। কিন্তু এমনটা না হলে যে আমি তোমার সেবা হারাবো তাই এই অনুনয় , এ অনুরোধ, এ নিবেদন তোমার শ্রীচরণে । দয়া করো ওগো দয়াময় ! তোমার চরণে আমি শরণাগত । তুমি তো “শরণার্ত্তি প্রণাশনঃ”—- শরণাগতের দুঃখ মোচনকারী ! এবার তাহলে তোমার এই শরণাগতের দুঃখ মোচন কর। মুখ তুলে চাও, প্রভু !”—- এসব নানান কাকুতি মিনতি করে প্রার্থনা জানাতে থাকলেন তিনি।
*
ওদিকে গোবিন্দদেব ঘুমাবেন কী ! সারারাত ধরে যদি তাঁর ভক্ত এমন অশ্রুজলে প্লাবিত হয়ে প্রার্থনা জানাতে থাকে তাহলে কী ভক্তবৎসল, ভক্তপ্রাণ ভগবানের ঘুম আসে ! তিনিও যে নিজের নিষ্কাম প্রিয় ভক্তের সেবা ভালোবাসার কাঙাল । ভক্তকে সেবা করে তিনিও সুখ পান । অভাব তো তাঁর শুধু ভক্তের ওই ভাবটুকুরই, আর তো কোন কিছুর অভাব নেই তাঁর । তাই ভক্তকে নিজের কাছ ছাড়া করতে চান না তিনি। একারণে সেই রাত্রেই তিনি করলেন এক অদ্ভুত , অবিশ্বাস্য, অবাস্তব লীলা।
*
পরদিন প্রভাত হতেই রাজা তাঁর পদাতিক সেনাদের আদেশ দিলেন পূজারীকে তাঁর কাছে ধরে আনতে। ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন তিনি। তাঁরও রাত্রে এই ভেবে ভালো করে ঘুম হয় নি যে একে তো তাঁর যাওয়ার অপেক্ষা না করেই পূজারী ব্রাহ্মণ বিগ্রহ শয়ন দিয়েছিলেন আর তার ওপর পরিহাস করে বলে কিনা বিগ্রহেরই পক্ক কেশ মালায় লেগে আছে !
*
পদাতিকরা এসে মহারাণার আদেশ জানালেন ব্রাহ্মণকে । অবিলম্বে প্রাসাদে যেতে হবে তাঁকে। রূপ চতুর্ভুজ ব্রাহ্মণ বললেন , “রাণা যে সাজা ঘোষণা করবেন আমি তা মাথা পেতে নেব। কিন্তু, রাজা নিজেই একবার এসে দেখুন আগে, আমি যা বলেছি সত্য কিনা তা ।” পদাতিকরা গিয়ে রাণাকে জানালেন। রাজপুত রাণা আরো রেগে গেলেন শুনে। কোথায় নিজে ছুটে এসে ক্ষমা চাইবে তা না আবার রাণাকে পরীক্ষা করে যেতে বলছে ! মহারাণা আর ক্ষণকালও সময় নষ্ট না করে সভা সেখানেই মুলতবি দিয়ে মন্দির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
*
রাজা এসেছেন বিগ্রহ দর্শন করতে। এতো নিজের নয়নকেও বিশ্বাস করা যায় না ! চন্দ্রবদন,উজ্জ্বল হতেও পরমোজ্জ্বল গোবিন্দদেব কাঁচা-পাকা কেশসহ পরম মনোহার শোভায় দাঁড়িয়ে আছেন। আহা কী অপূর্ব ! অপ্রাকৃত সেই শোভা ! অপ্রাকৃত কেশরাজিও । অদ্ভুত সুন্দর ! দু’চোখ সরানো যাচ্ছে না বিগ্রহের থেকে। যে সুন্দর সে মৃত্তিকা মেখে নিলেও তার সৌন্দর্যের হানি হয় না । আর ইনি তো সাক্ষাৎ ভগবান মুরলী মনোহর শ্রীকৃষ্ণ ! তাঁর তো কথাই নেই। আর তাই শ্রীকৃষ্ণের রূপ দর্শন করে রাণা কাঠের পুতুলের মত স্থির হয়ে গেলেন। তাঁর চোখের পলক যেন পড়ছে না । কিন্তু, পরক্ষণেই মনে কুতর্ক দানা বেঁধে উঠলো ,অবিশ্বাস ও সন্দেহের ঝড় উঠলো।তিনি বলে উঠলেন, “ওহে ব্রাহ্মণ ! আপনি বিগ্রহের শিরে নকল কেশ লাগিয়েছেন নাকি ? আমি পরীক্ষা করতে চাই। একথা বলতে বলতেই বিগ্রহের কাছে এসে কেশ ধরে দিলেন এক হ্যাঁচকা টান। নকল চুল খুলে বেরিয়ে আসবে হাতে এই ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু, ফল হল বিপরীত। শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহের মস্তক থেকে রক্তবিন্দু বেরিয়ে এল। ধারা হয়ে টপটপ করে রক্ত পড়তে থাকলো। রাণা অত্যন্ত ভীত হয়ে গিয়ে কয়েক পদ পিছিয়ে আসলেন। আর ওদিকে, চতুর্ভুজ ব্রাহ্মণ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। “হায়, হায় ! এ আপনি কী করলেন রাণা (!)? আমার ভগবানকে এভাবে ব্যথা দিলেন ! আহত করলেন ! কষ্ট দিলেন ! খুব খারাপ কাজ করলেন । আপনি ভীষণ নিষ্ঠুর কর্ম করলেন।”—– এই বলে রাণাকে তিরস্কার জানালেন তিনি। তখন রূপ চতুর্ভুজের পদে পড়লেন রাণা। “আমায় ক্ষমা করে দিন ঠাকুর ব্রাহ্মণ। আমি অন্যায় করেছি । আপনার ভক্তিতে এত বড় অবিশ্বাস্য লীলা করেছেন ভগবান ! অথচ আমি আপনার ভক্তিতে সন্দেহ করেছি ! ধিক্ আমায় ! ভক্ত ক্ষমা করলে ভগবানও ক্ষমা করে দেন। আপনি আমার অপরাধ মার্জনা করলে ভগবানও করবেন। আপনি তাই দয়া করুন আমায়।”—– বললেন রাণা।
*
ঠাকুর ব্রাহ্মণ তাঁর সেবিত বিগ্রহের কষ্ট পাওয়া মেনে নিতে পারলেন না। তাঁকে(ব্রাহ্মণকে) কষ্ট দিলে ক্ষমা করে দিতেন কিছু না মনে করে , কিন্তু বিগ্রহের কষ্ট তিনি সইতে পারলেন না । বললেন,” রাণা, আপনি শুধু নন, আপনার উত্তরসূরী যে কেউ এই বিগ্রহ দর্শন করতে আসবে মৃত্যু নিশ্চিত তাঁর, জানবেন।এই আমি বলে রাখলাম। আমায় হাজার কষ্ট দিলেও আমি তা সহ্য করে নিতাম। কিন্তু , আপনি ভগবান গোবিন্দকে কষ্ট দিয়েছেন , আঘাত দিয়েছেন—-আপনার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।”
তারপর থেকে সেই বিগ্রহ দর্শন করতে রাণার বংশধররা কেউ আর যান না। কারণ, যাঁরাই যেতেন তাঁরা আর বাঁচতেন না।অকালে প্রাণ হারাতেন। ‘ভক্তমাল’ গ্রন্থে রূপ চতুর্ভুজ ঠাকুর ব্রাহ্মণের এই উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে। সত্য ঘটনা এ।