মূল্যবান মনুষ্য জীবন ও জন্মাষ্টমী : স্বামী আত্মভোলানন্দ(পরিব্রাজক)।।

0
18

জন্মাষ্টমী সনাতন ধর্মের প্রাণপুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ জন্মতিথি। তিনি নিজেই ভগবদ্গীতায় বলেছেন:-
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত|
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজম্যহম্ ||
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুস্কৃতাম্ |
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ||
(গীতা-৪/৭-৮)
অনুবাদ: “যখনি পৃথিবীতে অধর্ম বেড়ে যায় সাধুদের পরিত্রাণ করার জন্য এবং দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।” শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে, রোহিণী নক্ষত্র যোগে বৃষ লগ্ন ও বুধবার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মধুরায় (বর্তমান উত্তর প্রদেশ,ভারত) কংসের কারাগারে, মাতা দেবকীর অষ্টম সন্তান রূপে রাত বারোটার পর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর এই জন্মদিনকে জন্মাষ্টমী বলা হয়। এই বছর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমী তিথি পড়ছে ২৬ অগস্ট ২০২৪। ২৬ তারিখ সোমবার জন্মাষ্টমী পালিত হবে।আমরা হিন্দু সনাতন ধর্বাবলম্বীরা দিনটিকে বিভিন্ন আনন্দ উৎসবের মধ্যে দিয়ে পালন করে থাকি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মাতা হলেন দেবকী, পিতা বসুদেব, যশোদা পালক-মাতা, নন্দ পালক-পিতা। সহোদর ভাই বলরাম, বোন সুভদ্রা, যোগমায়া হলেন পালক-বোন।

পৌরাণিক ব্যাখ্যা মতে, কংসের বোন দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের হাতে নিজের বিনাশের দৈববাণী শুনে সে সর্বদাই আতঙ্কে থাকত। ফলে সে তার বোনের গর্ভে সদ্যভূমিষ্ট প্রতিটি সন্তানকেই নৃশংসভাবে হত্যা করত। তবে গর্ভ স্থানান্তরিত করায় রোহিনীর গর্ভে জন্ম নেয় দেবকীর সপ্তম সন্তান বলরাম। সবশেষে অধর্মের বিনাশ ঘটাতে জন্ম হয় কৃষ্ণের। তবে তার প্রাণরক্ষার্থে ভগবান বিষ্ণুর নির্দেশ অনুসারে বাসুদেব কৃষ্ণপক্ষের সেই দুর্যোগ পূর্ণ প্রলয়ের রাতে সদ্যভূমিষ্ট সন্তানকে মা যশোদার কাছে রেখে আসেন। পাশাপাশি মা যশোদার কন্যাকে নিয়ে আসেন। এদিকে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের ভুমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদ পেয়ে কারাগারে ছুটে আসেন কংস। তারপর যখনই সেই কন্যা সন্তানকে আছাড় মারার উদ্দেশ্যে ঊর্ধ্বে তুলে ধরলেন, তখনই সেই কন্যা মহাশূন্যে ভাসতে ভাসতে দৈববাণী হয় “কংস, তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে!” এই কন্যাসন্তান ছিলেন স্বয়ং দেবী যোগমায়া। তার পর থেকেই আমাদের সমাজে যে কোনো অন্যায়কারী ও অপশাসককে উদ্দেশ করে বলা হয়, “তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে!” এটা আমাদের দেশের একটি জনপ্রিয় প্রবচন।

যাই হোক, কৃষ্ণের সন্ধান না পাওয়ায় রাজা কংস কুখ্যাত পুতনা রাক্ষসীকে ছয়মাস বয়সী সব শিশুকে হত্যার আদেশ দেন। রাজা কংসের নির্দেশমতো রাক্ষসী পুতনা বিষাক্ত স্তন পান করানোর ছলে একের পর এক শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করতে থাকে। অবশেষে যখন পুতনা কৃষ্ণের সন্ধান পান এবং তাকে স্তন পান করাতে যান, তখন মাত্র ছয়মাস বয়সেই কৃষ্ণ স্তনপানের মাধ্যমে সব বিষ শুষে নিয়ে পুতনার প্রাণনাশ করেন। এরপর একে একে তিনি কালীয়া নাগ, রাজা কংস সহ জগতের নানা দুষ্টকে তাঁর অসীম লীলার মাধ্যমে নিঃশেষ করেন।
শ্রীকৃষ্ণের জন্মের সময় চারিদিকে অরাজকতা, নিপীড়ন, অত্যাচার ছিল চরম পর্যায়ে। মানুষের স্বাধীনতা বলে কিছু ছিল না। সর্বত্র ছিল অশুভ শক্তির বিস্তার। শ্রীকৃষ্ণ সব অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করে সমাজকে কলুষমুক্ত করেন। জন্মাষ্টমী অশুভের উপর শুভবুদ্ধির জয় হিসাবে পালিত হয়।

কিংবদন্তি অনুযায়ী বর্তমান বছরটি বাংলার ১৪৩১ (২০২৪ সাল) ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ৫২৫০ তম জন্মাষ্টমী। কারণ, বিভিন্ন পুরাণ ও প্রাচীন গ্রন্থ মতে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ১২৫ বছর ধরাধামে লীলা করেন। ১২৫ বছর ধরাধামে অবস্থান করে বৈকুন্ঠে গমন করেন। মাঘ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে তিনি ইহধাম ত্যাগ করে অন্তর্ধান করেন। সেই দিনই কলি প্রবেশ করে। সেই দিন ছিল শুক্রবার। খ্রিস্টপূর্ব ৩১০১ সালে কলিযুগ আরম্ভ হয়। বর্তমান ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ। তা হলে কলির বয়স ৩১০১+২০২৪ =৫১২৫ বছর। শ্রীকৃষ্ণের অর্ন্তধানের দিন কলির আবির্ভাব। শ্রীকৃষ্ণ ১২৫ বছর ধরাধামে লীলা করেছেন। তা হলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ৫১২৫+১২৫=৫২৫০ বছর পূর্বে হয়েছিল। জন্ম ১৮ জুলাই, ৩২২৮ খ্রিস্টপূর্ব মথুরা, শূরসেন রাজ্য (বর্তমান উত্তর প্রদেশ, ভারত) মৃত্যু ১৮ ফেব্রুয়ারি, ৩১০২ খ্রিস্টপূর্ব ভালকা, সৌরাষ্ট্র রাজ্য, (বর্তমান ভেরাভাল, গুজরাত, ভারত)। ভগবদ্গীতায জন্মাষ্টমী অশুভের উপর শুভবুদ্ধির জয় হিসাবে পালিত হয়। পূর্ণব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণ মথুরার যাদববংশের বৃষ্ণি গোত্রের মানুষ, তিনি ছিলেন পরোপকারী, রাজনীতিজ্ঞ ও প্রেমিক।

মাঘ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পূর্ণব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণ ইহধাম ত্যাগ করে অন্তর্ধান করেন। সেই দিনই শ্রীকৃষ্ণের অর্ন্তধানের দিন কলির আবির্ভাব। আর এই কলি যুগের অবতার জগৎ গুরু স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজের আবির্ভাব ও মাঘ মাসের পূর্ণিমা, ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ পুণ্যময়ী মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে৷ তিনি ও সব অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করে সমাজকে কলুষমুক্ত করার চেষ্টা করে গেছেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শুভবুদ্ধির জয়ের চেষ্টা করে গেছেন। হিন্দুর সংহতি চেতনা জাগাবার জন্যে স্বামী প্রণবানন্দ ও বলেছিলেন -“হিন্দুর বিদ্যা বুদ্ধি, অর্থ ও সামর্থ যথেষ্ট আছে, কিন্তু নেই সংহতি শক্তি। এই সংহতি শক্তি জাগিয়ে দিলে হিন্দু আবার জাগ্রত হবে”। আচার্য স্বামী প্রণবানন্দ বলেছিলেন, আমি হিন্দুকে “হিন্দু হিন্দু” জপ করাব, তবেই তাদের মধ্যে মহাশক্তির সঞ্চার হবে। জাতিভেদ প্রথাকে হাতিয়ার করে হিন্দুসমাজকে টুকরো করার যে বিষবৃক্ষ তৈরি করা হয়েছিল, তার মূলে কুঠারাঘাত করতে এগিয়ে এলেন যুগপুরুষ স্বামী প্রণবানন্দ। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন হিন্দুবাদে বাকি ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীরা সঙ্ঘবদ্ধ ও সুরক্ষিত। কিন্তু ভারতের হিন্দু জনগণ অরক্ষিত, বিচ্ছিন্ন, ছিন্নভিন্ন, বিবাদমান, দুর্বল। হিন্দুদের জ্ঞানচক্ষু খুলে দেওয়ার তাগিদে স্বামী প্রণবানন্দ বলিষ্ঠ কন্ঠে বলেছিলেন-“যে যা, তাকে তাই বলে ডাকলে সে সাড়া দেয়। মুসলমানকে মুসলমান বলে ডাক দেওয়া হচ্ছে, তাই সে সাড়া দিচ্ছে। খ্রিষ্টানকে খ্রিষ্টান বলে ডাক দেবার লোক আছে, তাই সে ডাকে সাড়া দিচ্ছে, নিজেদের অস্তিত্বও সেভাবে অনুভব করছে। কিন্তু, হিন্দুকে হিন্দু বলে ডাক দেবার লোক নেই। গত একশ বছর ধরে কেউ ডাক দিয়েছে-‘ব্রাহ্ম’ বলে, কেউ ডেকেছে ‘আর্য্য’ বলে, কেউ ডেকেছে ‘ভারতীয় জাতি’ বলে, কোন পক্ষ তাকে আখ্যা দিয়ে রেখেছে অমুসলমান। বিরাট ভারতীয় জাতটা অসাড়, অবশ হয়ে আত্মভোলা হয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। আজ সময় এসেছে হিন্দুকে হিন্দু বলে ডাক দেবার।” হিন্দুর সংহতি, হিন্দু ধর্মের জাগরণের লক্ষ্যে স্বামী প্রণবানন্দ ও তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন।