“কান্না” কী বা কেন ? একটি আলোচনা  :  দিলীপ রায়।

0
45

দুঃখে কাঁদি, আঘাতে-ব্যথ্যায় কাঁদি, আবার কখনও খুব আনন্দেও কাঁদি ! প্রতিটি মানুষের জীবনে কখনও না কখনও কান্না পায় ।
( ২ )
(১) গাঁয়ের পুণ্ডরীকাঙ্খের বৌমা নীতাম্বরী, হন্তদন্ত হয়ে পটলডাঙ্গা স্টেশনের দিকে ছুটছে । রাস্তার মধ্যে হঠাৎ পুটির মায়ের সাথে দেখা, “কিগো নীতাম্বরী, হন্তদন্ত হয়ে কোথায় ছুটলে ?”
“আর বলবেন না মাসি, আজ আমার ছোট ছেলে পলাশীপাড়া থেকে বাড়ি ফিরছে । তাকে আনতে রেলওয়ে স্টেশনে যাচ্ছি ।“ উত্তরে নীতাম্বরী জানালো ।
তা বাপু, ছেলেটা হঠাৎ পলাশীপাড়ায় কেন ? বুঝতে পারলাম না ।
মাসি ! আপনাকে বলা হয়নি । ছোট ছেলে সেখানকার হাসপাতালের ডাক্তার !
শুনেছি তোমার দুই ছেলেই ডাক্তার ।
“আর মাসি । কি বলবো আপনাকে ! আপনাকে বলতে আমার দ্বিধা নেই । ছেলেদের মানুষ করতে আমার হিমসিম অবস্থা ! নিজের সখ-আহ্লাদের জলাঞ্জলি । ঠিকমতো ঘুমোতে পারতাম না । সব সময় ছেলেদের পেছনে লেগে থাকতে হতো । তাদের পড়াশুনার দিকে নজর দেওয়াই ছিল আমার ধ্যান জ্ঞান । যার জন্য আপনাদের আশীর্বাদে বড় ছেলেটা নিউরো সার্জেন্ট (এম-ডি), ছোটটা মেডিসিনে এম-ডি ।“ কথাগুলি বলার পরে নীতাম্বরীর চোখে জল ! শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছছে ।
(২) সর্বেশ্বর গাঁয়ের প্রান্তিক চাষি । বিঘে কয়েক জমি চাষ করে তাঁর সংসার । একটা ছেলে ও দুটি মেয়ে । বেচারা খেয়ে না-খেয়ে ছেলে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষিত করেছে । মেয়ে দুটিই স্কুল শিক্ষিকা । বিয়েও দিয়েছে । ছেলেটা বাইরের রাজ্যে মস্ত বড় কোম্পানীর উচ্চ পদে কর্মরত । সর্বেশ্বর একদিন ফাইল খুঁজতে গিয়ে ছেলের ইনকাম ট্যাক্সের রিটার্ন দেখতে পায় । গত বছর যে পরিমান আয়কর দিয়েছে সেটা থেকে সর্বেশ্বর ছেলের মাসিক আয় সম্বন্ধে একটা ধারণা পায় ! অথচ ছেলে মেয়েদের পড়াতে গিয়ে এবং মেয়েদের বিয়ে দিতে গিয়ে সর্বেশ্বর আর্থিক দিক দিয়ে নিঃস্ব । সবগুলি জমি বিক্রি করতে হয়েছে । তাঁদের বুড়ো-বুড়ির দুবেলার অন্ন জোগানোই এখন ভীষণ সমস্যা । স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ছেলের অন্য রাজ্যেতে বসবাস, ফলে বাবা-মায়ের খোঁজ নেওয়ার সময় নেই । সুতরাং তাঁরা কীভাবে বাবা-মাকে পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করবে ? ক্ষুধায় যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে ঠিক তখন সর্বেশ্বর নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে গিন্নির চোখের আড়ালে হাউমাউ করে কাঁদে ! শেষ বয়সে এখন তাঁর ভিখারীর ন্যায় অবস্থা !
(৩) ঐ বাংলায় নীরোদ তালিবের ভরা ঘর-সংসার । গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান, পরিবারের বাবা-মা সহ ছেলেমেয়ে নিয়ে মোট এগারো জন, জমি জায়গা, খাওয়া দাওয়া, বাড়ি লাগোয়া পুকুর । পুকুরে সারা বৎসর জল থাকে এবং সেখানে অনেক ধরনের মাছ । যাকে বলে অফুরন্ত শান্তির সংসার । হঠাৎ দেশ ভাগ ।
“পালাও, দেশ ছাইরা পালাও ! এই দ্যাশটায় হিন্দুদের ঠাঁই নাই ।“ রাতের অন্ধকারে হাঁটুর উপর ধুতি পরে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ও বুড়ো বাবা-মাকে নিয়ে অনেক ছিন্নমূল মানুষের সাথে নীরোদ তালিব ছুটলো অজানা উদ্দেশে । পদ্মা, ভাগীরথী পার হয়ে বাবলা নদীর তীরে বট গাছটার তলায় আশ্রয় নিলো বিনোদ তালিব । সব হারিয়ে ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ভয়ে-ভীতিতে আশঙ্কায় বিনোদের চোখে জল । চতুর্দিকে অন্ধকার । অচেনা দেশে রাত্রির অন্ধকারে তাঁর চোখের জল থামানো দায় ! মনের ভিতর সব হারানোর হাহাকার ! বিনোদ তালিবের সে কি কান্না !
উপরের তিনটি ঘটনায় মানুষের তিন রকম কান্না ! এখানকার কান্নাগুলিকে আবেগপূর্ণ কান্না বলা চলে । তাই কান্না হলো একটা আত্ম-উপলব্ধি বা অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম ।
( ৩ )
আবার কান্না শারীরিক ব্যথা-যন্ত্রণার প্রতিক্রিয়ায় হতে পারে অর্থাৎ চোখে অশ্রু ঝরতে পারে । অন্যদিকে কান্নার কারণ হতে পারে এমন আবেগের মধ্যে, যেখানে রয়েছে দুঃখ , রাগ , আনন্দ এবং ভয় ।
মানসিক চাপ বা উদ্বেগের সময় সহানুভূতিশীল প্রতিক্রিয়া কান্নার কারণ হতে পারে । উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে — তমালবাবু শিক্ষকতার চাকরি জীবন থেকে প্রায় দশ বছর হলো অবসর নিয়েছেন । তাঁর দুই ছেলে বিদেশে কর্মরত । বাবা-মাকে দেখার তাদের সময় নেই । পেনশনের টাকায় তাঁদের দুজনের দিনাতিপাত । হঠাৎ গিন্নির কঠিন ব্যামো । বুকে ভীষণ ব্যাথা । এলাকার হাতুড়ে ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন, “অপারেশন জরুরি । তাঁকে অতি সত্বর কলকাতার বড় হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার ।“ তমালবাবুর হাতে একটাও পয়সা নেই । তমালবাবু দুঃখে কষ্টে কপাল চাপড়াচ্ছেন ! এমন সময় দেবদূতের মতো ভোম্বলের আগমন । বিষম বিপদের সময় তাঁর গবেট মার্কা ছাত্র ভোম্বল ছুটে এসে তার প্রিয় স্যারের পাশে দাঁড়ালো । অথচ সাংসারিক জীবনে ভোম্বল কোনোরকমে একটা টী স্টল চালায় । তবুও ভোম্বলের সমস্ত সঞ্চিত টাকা-পয়সা, গিন্নির গহনা, স্যারের পায়ের কাছে রেখে বলল, “স্যার, আর দেরী করবেন না । এক্ষুণি হাসপাতাল চলুন ।“ ভোম্বলের সেই সময়কার চাহনী, কাতর আবেদন, সর্বোপরি তার আন্তরিকতা দেখে তমালবাবু চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না । তাই মনে মনে বললেন, তিনি ছাত্রদের শিক্ষিত করতে পারুক বা না-পারুক, অন্তত একজন ছাত্রকে মানুষ করতে পেরেছেন ।
( ৪ )
এবার জানা যাক, কান্না কেন ঘটে ?
কান্না একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যেখানে আমাদের চোখের ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি অশ্রু উৎপন্ন করে । এই অশ্রুগুলি নালীগুলির মধ্যে দিয়ে গড়িয়ে পড়ে । এগুলি হয় গালের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ে বা নাসোলেক্রিমাল নালীর মাধ্যমে নাকের মধ্যে জমা হয় ।
সঠিকভাবে, চোখের উপরের প্রান্তে উপস্থিত ল্যাক্রিমাল গ্রন্থিগুলির নিঃসরণ হল অশ্রু । আমরা যখন কাঁদি তখন কান্নার পরিমাণ বেশি হয় । আমরা যখন স্বাভাবিক শরীরবৃত্তীয় অবস্থায় থাকি তখন কান্নার পরিমাণ কম হয় । কান্নার অনুভূতির জন্ম মস্তিষ্কে, ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড থেকে । এই গ্ল্যান্ড থেকেই প্রোটিন, মিউকাস বা তেলতেলে নোনা জল তৈরি হয় । এগুলি চোখ দিয়ে অশ্রুর আকারে বেরিয়ে আসে । এই তরলকেই কান্না বলে।
মস্তিষ্কে সেরিব্রাম নামে একটা অংশ আছে, সেখানে দুঃখ জমা হয় বা দুঃখের অনুভূতি তৈরি হয় । সেই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হল কান্না । আরও জানা যায়, দুঃখের বা মন খারাপের কারণে শরীরে একধরনের টক্সিন বা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ তৈরি হয় । সেগুলি বার করে দেয়ার জন্য কান্নার প্রয়োজন । চোখের জলের সঙ্গে সেই ক্ষতিকর পদার্থ বেরিয়ে আসে ।
সেরিব্রাম অংশ থেকে এন্ডোক্রিন সিস্টেম বা অন্তঃক্ষরা পদ্ধতিতে হরমোন নির্গত হয় । দুঃখের কারণে জমা হওয়া ক্ষতিকর পদার্থগুলি বহন করে চোখের আশপাশের অঞ্চলে নিয়ে যায় এই হরমোনগুলি । সেখান থেকে চোখের জলের সঙ্গে টক্সিনগুলো বেরিয়ে আসে কান্নার আকারে । এটিই আসলে আবেগীয় কান্না । যন্ত্রণার বা খুশির কান্নাও একই পদ্ধতিতে আসে।
( ৫ )
কাঁদার আবার বিভিন্ন ধরন আছে । যেমন দুঃখ, ব্যথা ছাড়াও অনেক সময় আমরা অন্য কারণে কেঁদে ফেলি । আবার চোখে ঝাল বা পেঁয়াজের কষ লাগলে চোখে জল আসে । এটাকে ঠিক কান্না বলা যায় না । কিন্তু কান্নার বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এর যথেষ্ট মিল আছে ।
রিফ্লেক্স নামে আরেক ধরনের কান্না আছে । এই কান্না একটু অন্যরকম ! হঠাৎ ব্যথা পেলে, কিংবা ঝাঁঝালো কোনও বস্তু যেমন পেঁয়াজ বা সর্ষের তেলের ঝাঁঝ কিংবা ধুলাবালি নাক বা চোখ দিয়ে ঢুকলে এই ধরনের কান্নার জন্ম । ঝাঁঝালো বস্তু চোখে ঢুকলে, চোখের কর্নিয়ায় যে স্নায়ুতন্ত্র আছে, সেখানে বার্তা পাঠায় । বদলে মস্তিষ্কও প্রতিরক্ষার জন্য হরমোন পাঠিয়ে দেয় চোখের পাতায় । চোখে সেগুলি অশ্রুর মতো জমা হয় । ধুলাবালি বা ক্ষতিকর পদার্থ বয়ে নিয়ে চোখ থেকে বেরিয়ে আসে সেই অশ্রু ।
বেসাল কান্না কাঁদতে হয় না, জানা যায় এরা চোখের মধ্যেই থাকে। বেসাল কান্না এক ধরণের পিচ্ছিল তরল — যেটা আমাদের চোখকে সব সময় ভিজিয়ে রাখে । যার জন্য আমাদের চোখ কখনোই একেবারে শুকিয়ে যায় না ।
আবেগের কান্না শুরু হয় সেরেব্রাম থেকে । সেরেব্রাম হলো মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় অংশ, এজন্য সেরেব্রামকে বলা হয় ‘গুরুমস্তিষ্ক’। সেরেব্রামেই থাকে আমাদের সব ধারণা, কল্পনা, চিন্তা-ভাবনা, মূল্যায়ন ও সিদ্ধান্ত ।
পরিশেষে আমরা বলতে “কান্না মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি ।“ কেননা সহজাত প্রবৃত্তি হচ্ছে কোনো জীবের আচরণের একটি অংশ ! অন্যদিকে উপকারের কথা ভাবলে ‘কান্না’ একটা মানুষকে উদ্দীপ্ত রাখে, চোখ পরিষ্কার রাখে, মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে, আবার বিষণ্ণতা কাটায় ।(তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত) ।