আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের চিন্তাধারা ও শিক্ষাদর্শন এখনো সমানভাবে  পাথেয়।।

0
19

একদিকে ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ,অন্যদিকে পাশ্চাত্য চিন্তাধারা –দুই মিশ্রনে পরিপূর্ণ আধুনিক প্রগতিবাদী মানুষ ছিলেন ডঃ সর্বপল্লীরাধাকৃষ্ণন। নেহেরুজীর মতে,রাধাকৃষ্ণন ছিলেন ‘আধুনিক বিশ্বদর্শনের প্রতিভূ। ……….তিনি বিভিন্নভাবে দেশের সেবা করেছেন।কিন্তু সর্বোপরি তিনি একজন মহৎ শিক্ষক।তাঁর নিকট হতে আমরা অনেক কিছু শিখেছি এবং আজও শিখতে থাকবো।’ নেহেরুজী সত্য কথাই বলেছেন। রাধাকৃষ্ণনের চিন্তাধারা ও শিক্ষাদর্শন আমাদের বত’মান যুগেও সমান প্রাসঙ্গিক এবং  পথচলার পাথেয়।তিনি যে সমস্ত উপদেশ ও শিক্ষা দিয়ে গেছেন তা আমরা যদি ঠিকমত গ্রহণ করতে পারি তাহলে আমাদের পথ চলা সুগম হবে,আমাদের জীবনে উত্তরণ ঘটবে।
অত্যন্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে নিরন্তর দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করেও তিনি দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রপতি পদ অলংকৃত করেছিলেন।দুঃখ-দারিদ্রকে জয় করে তিনি অতি সহজেই বলতে পেরেছেন- ‘Often suffering is not punishment but discipline’.

তিনি বলেছেন ,-‘মানুষের জীবন চলমান কর্মের এক ধারাবাহিক প্রকৃতি-এক মুহূর্ত নষ্ট করা চলবেনা।’ রাষ্ট্রপতির সুমহান ঐতিহ্য পালন করতে গিয়ে অনেক সময় তাঁকে বিবেকের দংশনে দংশিত হতে হয়েছিল,তবুও তিনি কখনও সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হননি।তিনি কখনও নিজের আত্মগরিমা প্রকাশ করেননি,তিনি ছিলেন সহজ সরল ও অমায়িক।
তিনি গীতাঞ্জলির ইংরাজি অনুবাদ ‘Song Offerings’ পড়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর ভাবে আকৃষ্ট হন।রবীন্দ্রনাথের কবিতা “বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখ তাপে ব্যাথিত চিত্তে নাইবা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।”
এই কবিতাটি তাঁর মনে গেঁথে যায়,তিনি বুঝতে পারেন দুঃখের মধ্য দিয়ে যে জয়লাভ তা জীবনের চরম সার্থকতা নিয়ে আসে-
এই উপলব্ধির সঙ্গে উপনিষদের দর্শনতত্ত্বের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন রাধাকৃষ্ণন।
উপনিষদের শ্লোকটি হল-
অসতো মা সদগময়
অসতো মা জ্যোতির্গময়,
মৃতোর্মা অমৃতগময়।”
অর্থাৎ অসত্য থেকে সত্য,অন্ধকার থেকে আলোকে এবং মৃত্যু থেকে অমৃতে চলো।
ডঃ রাধাকৃষ্ণনের জীবনের মর্মবাণী ছিল – “দেবমন্দির হচ্ছে নিত্য পবিত্র মন্দির,আর সেই মন্দিরে তুমি নিজেই, যেমন মৃগের দেহের মধ্যেই কস্তুরি বিরাজ করে।আমরা  একাগ্রচিত্তে মনের মালিন্য দূর করবো।” তাঁর মতে ,জন্ম হোক যেখানে সেখানে,কর্মের মাধ্যমেই আমরা বিশ্বমানব হতে পারি। তিনি বলেছেন-“একান্ত নীরবতার মধ্যে বন্দীর বন্ধন মুক্তির জন্য করুন ক্রন্দনের মতো এবং অন্তরকে পাওয়ার জন্য কাতর ক্রন্দনধ্বনির মতো আমাদের কানে ভেসে আসে ব্যাথিত আত্মার সবিলাপ কণ্ঠস্বর।”
তাঁর শিক্ষাদশ’নও আমাদের ভালভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন।তিনি বলেছেন – “A good Teacher is a candle,it consumes itself to light the way for others.” তাঁর মতে –একজন মানুষের সফলতা,চরিত্র ও ভাল ব্যক্তিত্ব গড়ার পিছনে শিক্ষকের অবদান রয়েছে।একজন শিক্ষককে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।তিনি শুধুমাত্র পুঁথিগত হবেন তা নয়,তিনি জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রের শিক্ষক হতে পারেন।তিনি বলবান,গুনবান ও চরিত্রবান করে তুলতে ছাত্রকে সাহায্য করবেন।সমাজগড়ার কারিগর হিসাবে শিক্ষকের গুরুত্ব অনেকখানি।তাঁর মতে, -“Every one acknowledges how a teacher shapes the life of students and we should be ever greatful to them”
জ্ঞানতপস্বী রাধাকৃষ্ণন কয়েকটি অনবদ্য বাণী রেখে গেছেন-সেগুলি নিম্নরূপ –
১। বইয়ের তাৎপর্য হলো আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে সেতু নির্মান করা।
২। সহনশীলতা হলো শ্রদ্ধা,যা সীমিত মন অসীমতায় পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন।
৩। জীবনের আনন্দ ও সুখ শুধুমাত্র জ্ঞান ও বিজ্ঞানের ভিত্তিতে সম্ভব।
৪। সত্যিকারের শিক্ষক তাঁরাই,যাঁরা নিজের জন্য চিন্তা করতে শেখায়।
৫। একজন পরামর্শদাতা শিক্ষক একজন ব্যক্তিকে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ দেখাতে ক্ষমতায়ন করেন।
৬। যখন আমরা মনে করি আমরা সব জানি,তখনই আমাদের শিখতে হবে।
৭। কেবল নিখুঁত মনের মানুষেরই জীবনে আধ্যাত্মিকতার অর্থ বুঝতে পারেন,নিজের সত্যতা,আধ্যাত্মিক একনিষ্ঠতার পরিচয়।
৮। জ্ঞানও বিদ্যার ফল হলো অনুভব।
৯। মানুষের স্বভাব মূলত ভাল এবং আত্মজ্ঞানের প্রচেষ্টা সমস্ত খারাপকে দূরে ঠেলে ফেলে দেবে।
১০। যদি মানুষ দানবে পরিনত হয় তাহলে তার হার হয়,
যদি মানুষ মহামানব হয়ে যায়,তাহলে এটি তার চমৎকার,
যদি মানুষ মানুষে পরিনত হয় তাহলে এটি তার জয়লাভ।
শিক্ষা সম্পর্কে তিনি খুব সুন্দর কথা বলেছেন – ‘জনগণকে শুধুমাত্র নাগরিক হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেবেনা, তাকে মানুষ হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেব।’
শিক্ষা সম্পর্কে বিবেকানন্দ প্রায় একই কথা বলেছেন –
“Man making is my mission.”
পরিশেষে বলি, ডঃ রাধাকৃষ্ণন একজন পূর্ণমানব-জ্ঞানের এক অতল সমুদ্র।ঋষির মতো প্রাজ্ঞ,জ্ঞানসাগরের অতল তলের ডুবুরী।সারা পৃথিবীর মানুষ তাঁর পান্ডিত্যের ঝরনা ধারায় স্নাত হয়ে উপলব্ধি করেছেন তাঁর দর্শন,শিক্ষা,সংস্কৃতি,সমাজচিন্তা ও দেশত্ববোধ।আজও তিনি দর্শনের মধ্য দিয়ে বটবৃক্ষের মতো আমাদের ছায়া দিয়ে রেখেছেন।সারাজীবন বহু উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েও যেহেতু তিনি প্রথম জীবনে শিক্ষক ছিলেন সেইহেতু তিনি শিক্ষকসমাজকে ভুলে যান নি।তাই তাঁর নিজের জন্মদিনটিকে ‘শিক্ষক-দিবস’ হিসাবে পালন করতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন।তিনি পুঁথি সর্বস্ব শিক্ষা দানের বিরোধী ছিলেন এবং তিনি ছাত্রদের প্রকৃত মানুষ গড়ার কথা বলেছিলেন, তাই শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে সে কথাও উল্লেখ করেছিলেন।
তাই বর্তমান শিক্ষকদের উচিত তাঁর প্রদর্শিত পথে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদান করা।আজ শিক্ষক দিবসে শিক্ষক সমাজকে  তাই আবার নতুন করে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে  তাঁর উপদেশ মতো কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা নিয়ে প্রকৃত মানুষ গড়ার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।তবেই তাঁর জন্মদিনে আমাদের সকলের শিক্ষাগুরুর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন সার্থক হবে।
এই সত্যসন্ধানী জ্ঞানতপস্বী দীর্ঘ ৮৭ বছর কর্মময় জীবন কাটিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৭ই এপ্রিল অমরলোকে যাত্রা করেন।আজ তিনি আমাদের মধ্যে নাই।কিন্তু তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাঁর মূল্যবান বাণী সমূহ ও দর্শন শাস্ত্রের অমূল্য গ্রন্থসমূহ-যেগুলির সাহায্যে পরমার্থিক সত্ত্বার দিব্যজ্যোতি বিদ্যুতের   মতো আমাদের অন্তরকে স্পর্শ করবে।
আসুন,আমরা আজ এই মহামনীষীর প্রয়াণ দিবসে বিনম্রচিত্তে তাঁর উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলি –
আমার মাথা নত করে দাও হে
তোমার চরণ ধুলির তলে।

কলমে : শ্রী প্রশান্ত কুমার দাস।
শিক্ষারত্ন প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ,বাজিতপুর উচ্চ বিদ্যালয়(উঃমাঃ),
পোঃ-পাথাই, ময়ূরেশ্বর-১,বীরভূম ।