মহাত্মা গান্ধী তৎকালীন সময়ে একজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ । তিনি প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে স্বীকার্য । আমরা জানি, মহাত্মা গান্ধী ছিলেন সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা । সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মাধ্যমে ইংরেজদের স্বৈরশাসনের বিরূদ্ধে জনসাধারণের অবাধ্যতা ঘোষিত হয়েছিল । এই আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অহিংস মতবাদ বা দর্শনের উপর এবং এটাকেই বলা হতো, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম চালিকা শক্তি, সারা বিশ্বে মানুষের স্বাধীনতা এবং অধিকার পাওয়ার আন্দোলনের অন্যতম অনুপ্রেরণা । একজন শিক্ষিত ব্রিটিশ আইনজীবি হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিপীড়িত ভারতীয় সম্প্রদায়ের নাগরিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে গান্ধী প্রথম তাঁর অহিংস শান্তিপূর্ণ নাগরিক আন্দোলনের মতাদর্শ প্রয়োগ করেন । ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে আসার পর গান্ধী সমগ্র ভারতব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারী স্বাধীনতা, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, বর্ণবৈষম্য দূরীকরণ, জাতির অর্থনৈতিক সচ্ছলতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রচার শুরু করেন । কিন্তু এর সবগুলোই ছিল ভারতকে বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে । মহাত্মা গান্ধী সমস্ত পরিস্থিতিতেই অহিংস মতবাদ এবং সত্যের ব্যাপারে অটল থেকেছেন । তিনি সাধারণ জীবন যাপন করতেন । যার জন্য মহাত্মা গান্ধী ভারতে এবং বিশ্ব জুড়ে মহাত্মা ( যার অর্থ, মহান আত্মা ) এবং বাপু (আমরা জানি, বাপু অর্থাৎ বাবা) নামে পরিচিত। সেই সময় ভারত সরকার তাঁর সম্মানার্থে তাঁকে “জাতির জনক” হিসাবে উপাধি ঘোষণা করে । এমনকি তৎকালীন ভারত সরকার মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন ‘গাঁধী জয়ন্তী’ হিসাবে জাতীয় ছুটির দিন ঘোষণা করে, যেটা আজও জাতীয় ছুটির দিন হিসাবে গণ্য । আজ তাঁর জন্মদিন সারা দেশে মর্যাদার সাথে পালিত হচ্ছে ।
মহাত্মা গান্ধীর ভাল নাম, আমরা জানি, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী । তিনি ২রা অক্টোবর, ১৮৬৯ সালে গুজরাট রাজ্যের পোরবন্দরের হিন্দু মোধ পরিবারে জন্মগ্রহন করেন । পিতা করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন পোরবন্দরের দেওয়ান (প্রধান মন্ত্রী) । মা পুতলিবা করমচাঁদের চতুর্থ স্ত্রী । করমচাঁদের প্রথম দুই স্ত্রীর প্রত্যেকেই একটি করে কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন । অজানা কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছিল । ধার্মিক মায়ের সাথে এবং গুজরাটের জৈণ্য প্রভাবিত পরিবেশে থেকে মহাত্মা গান্ধী ছোটবেলা থেকেই জীবের প্রতি অহিংসা, নিরামিষ ভোজন, আত্মশুদ্ধির জন্য উপবাসে থাকা, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সহিষ্ণুতা ইত্যাদি বিষয় শিখতে শুরু করেন । তিনি জন্মেছিলেন হিন্দু বৈশ্য গোত্রে, যেটা ছিল ব্যবসায়ী গোত্র ।
মহাত্মা গান্ধী তার ছোটবেলায় পোরবন্দর ও রাজকোটের ছাত্র জীবনে মোটামটি মানের ছাত্র ছিলেন। কোন রকমে গুজরাটের ভবনগরের সামালদাস কলেজ থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন । পরিবারের ইচ্ছা মোতাবেক তিনি ১৮ বছর বয়সে ১৮৮৮ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে যান । তাঁর লন্ডনে পড়াশুনা চলাকালীন মায়ের কথামতো নিরামিষ ভোজন করতেন । প্রথমদিকে মহাত্মা গান্ধীর ধর্মের প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না, কিন্তু পরবর্তিতে লন্ডনে পড়াশুনার সাথে সাথে মহাত্মা গান্ধী হিন্দু, খ্রীস্টান, বৌদ্ধ, ইসলাম ও অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে এবং ঐ ধর্মের রীতি সম্পর্কে পড়াশোনা করেন ।
মহাত্মা গান্ধী হিন্দু হলেও তিনি সর্ব ধর্মকেই সমান চোখে দেখতেন । তাঁর মতে, ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্ম যে সংস্কৃতি বয়ে এনেছে, তা ভারতকেই সমৃদ্ধ করেছে । মা ছিলেন পানামি সম্প্রদায়ভূক্ত, যা হিন্দু ধর্মানুসারী হলেও নানা ধরনের ইসলামি বৈশিষ্ট্য ধারণ করত । শৈশবে তাঁর উপর জৈন ধর্মের প্রভাব পড়েছিল । তাঁর ছোটবেলার বন্ধু, মক্কেল, বেশির ভাগ ছিলেন মুসলমান । দক্ষিণ আফ্রিকায় যাঁদের খামার বাড়িতে থাকতেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইহূদি ও খ্রিস্টান । তাই ধর্মীয় সংযোগ যে মানুষকে মানুষের থেকে আলাদা করতে পারে না, এবং ভিন্নধর্মবিশ্বাসী হয়েও প্রয়োজনে অন্যের পাশে দাঁড়ানোটা কর্তব্য হয়ে ওঠে, গান্ধীজির জীবন দর্শনে পরিস্কার । এরই ফসল, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া । তা ছাড়া আরও অনেক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন । (সূত্রঃ আ-বা-প, তাং-১০.১০.১৯ ) ।
তারপর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভায় বক্তব্য রাখেন, কিন্তু ভারতীয় ইস্যু রাজনীতি এবং ভারতীয় জনগণের সাথে পরিচিত হন গোপালকৃষ্ণ গোখলের মাধ্যমে, যিনি তৎকালীন সময়ে একজন বড় মাপের প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা ।
মহাত্মা গান্ধীর লেখার জগতে ছিল অবারিত দ্বার । গান্ধীর বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে । তাঁর লেখার জগৎ ছাড়াও অনেকদিন ধরে তিনি সম্পাদনা করেছেন গুজরাটী, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকা “হরিজন” । এই হরিজন পত্রিকা ভারতবর্ষে সেই সময় হৈ-চৈ ফেলে । কেবল ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত তার সম্পাদিত পত্রিকার মধ্যে অন্যতম ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ । তা ছাড়া তাঁর হাতেই সম্পাদিত হতো গুজরাটী ভাষার মাসিক পত্রিকা ‘নবজীবন’ যা পরে হিন্দি ভাষায়ও প্রকাশিত হয়েছিলো ।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে মহাত্মা গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দায়িত্বপ্রাপ্ত পদে নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বে কংগ্রেস স্বরাজের লক্ষ্যকে সামনে রেখে নতুন সংবিধান গ্রহণ করেন। মহাত্মা গান্ধী তাঁর অহিংস নীতির পরিবর্ধন করেন এবং স্বদেশী পলিসি যোগ করেন । স্বদেশী পলিসি মোতাবেক সকল বিদেশী পণ্য বিশেষত ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করা হয় । এর পথ ধরে তিনি সকল ভারতীয়কে ব্রিটিশ পোশাকের বদলে খাদি পরার আহ্বান জানান । তারপর আমরা জানি, “অসহযোগ” আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও সাফল্য লাভ করে । গান্ধী গ্রেপ্তার হন ১৯২২ সালের ১০ মার্চ, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গান্ধীকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় । ১৯২২ সালের ২৮ মার্চ শুরু হওয়া শাস্তির কেবল দুই বছরের মতো ভোগ করতে হয় তাঁকে । ইতিমধ্যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ভিতরে ফাটল ধরে, যা কিনা পরবর্তিত দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায় । একটি অংশের নেতৃত্ব দেন চিত্তরঞ্জন দাস এবং মতিলাল নেহরু তাঁরা আইনসভার পার্টির অংশগ্রহণ সমর্থন করেন। চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বের অপর অংশ বিরোধিতা করে । এছাড়া হিন্দু ও মুসলিমদের অহিংস আন্দোলন চলাকালীন সৌহার্দ্যর ভাঙ্গন ধরে। মহাত্মা গান্ধী তখন বিরোধ মেটাবার জন্য সেতুবন্ধের কাজ করেন এবং এজন্য ১৯২৪ সালের শরৎকালে তিন সপ্তাহের অনশন করেন।
মহাত্মা গান্ধী কলকাতা কংগ্রেসে ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতকে ডোমিনিয়নের মর্যাদা দেবার দাবি জানান, অন্যথায় নতুন অহিংস নীতির পাশাপাশি পূর্ণ স্বাধীনতা লক্ষ্যের আন্দোলনের হুমকি দেন । মহাত্মা গান্ধী তখন তরুণ নেতা নেতাজী সুভাস চন্দ্র বোসকে এবং জহর লাল নেহরুকে গুরুত্ব দেন, কেননা তাঁরা অবিলম্বে দেশ স্বাধীনতার পক্ষপাতী ছিলেন।
তারপর ১৯২৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর ভারতীয় জাতীয় পতাকার উন্মোচন ঘটে লাহোরে। ১৯৩০ সালের ২৬শে জানুয়ারি লাহোরে মিলিত হয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দিনটিকে জাতীয় স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উৎযাপন করে । ঘোষণামতো মহাত্মা গান্ধী লবণের উপর কর আরোপের বিরুদ্ধে নতুন সত্যাগ্রহ অভিযান শুরু করেন । তারপর মহাত্মা গান্ধী লবণ মার্চ (যেটাকে বলা হয়, ডান্ডি মার্চ) শেষ করেন ৫ এপ্রিল ১৯৩০ তারিখে ডান্ডিতে । তিনি ডাণ্ডির উদ্দেশে লবণ হাঁটা আয়োজন করেন ও ১২ই মার্চ থেকে । ৪০০ কিলোমিটার হেঁটে এলাহাবাদ থেকে ডাণ্ডিতে পৌঁছান গাঁধী, একটাই উদ্দেশ্য নিজের হাতে লবণ তৈরি করা । এছাড়াও তাঁর চরকা আন্দোলন এখনও ভারতবাসীর মধ্যে উজ্জীবিত ।
১৯৩২ সালে দলিত নেতা বি আর আম্বেদকরের প্রচেষ্টার ভিত্তিতে তদানীন্তন ভারত সরকার নতুন সংবিধানের আওতায় অস্পৃশ্যদের জন্য আলাদা ইলেকটোরেট আয়োজন করেন । মহাত্মা গাঁধী দলিত সম্প্রদায়কে, হরিজন বা ঈশ্বরের সন্তান নাম দিয়েছিলেন । সেই অস্পৃশ্যদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন । ১৯৩৩ সালের ৮ মে তিনি হরিজন আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ২১ দিনের জন্য আত্মশুদ্ধি অনশন করেন।
সুতরাং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মহাত্মা গাঁধীর বিপুল অবদান আজও নতমস্তকে অবিস্মরণীয় ।
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গাঁধীকে গুলি করে হত্যা করা হয় । তার কয়েক মাস আগেই ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট স্বাধীন ভারতের জন্ম হয় । তারপর ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকারময় একটি অধ্যায়ের শুরু । রিফিউজি শিবির, দাঙ্গা, অরাজকতায় ক্রমশই ম্লান হচ্ছিলো বহুআকাক্ষিত স্বাধীনতার উৎসব । বয়স তখন ৭৮ ছুঁয়েছে, কর্মক্ষমতা তলানিতে । তবু দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকায় পায়ে হেঁটে ঘুরেছিলেন জাতির জনক । ভেবেছিলেন মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে তাঁর শান্তির বাণীতে। কিন্তু তাঁকে আততায়ীর হাতে নিহত হতে হলো । তাঁর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে, যে ছিলো একজন হিন্দু চরমপন্থী । যদিও গডসে ও তার সহায়তাকারী নারায়ন আপতোকে পরবর্তীতে আইনের আওতায় এনে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ১৯৪৯ সালের ১৪ নভেম্বর তাদের ফাঁসি দেওয়া হয় ।
নতুন দিল্লীর রাজঘাটের স্মুতিসৌধে আছে “হে রাম” অনুবাদ করলে অর্থ দাড়ায় “ও ঈশ্বর”, শব্দ দুটিকে গান্ধীর শেষ কথা বলে আজও ভারতীয়রা বিশ্বাস করে । (তথ্যসূত্র: সংগৃহীত)
——০——-
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী / ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪