মূল্যবান মনুষ্য জীবনে শ্রী শ্রী মহাকালী পূজা : স্বামী আত্মভোলানন্দ(পরিব্রাজক)।

0
11

ॐ জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী ।
দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোঽস্তুতে ।।
ওঁ কালী কালী মহাকালী কালীকে পাপহারিণী
ধর্মার্থমোক্ষদে দেবী নারায়ণী নমোস্তুতে’ ।।

দুর্গাপূজার পরবর্তী অমাবস্যাতে দীপান্বিতা কালীপূজা করা হয়। এছাড়াও মাঘ মাসে রটন্তি কালীপূজা এবং জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী কালীপূজা ধুমধাম করে অনুষ্ঠিত করা হয়। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যায় এছাড়াও বিভিন্ন সিদ্ধ অমাবস্যায় এছাড়াও বিভিন্ন সিদ্ধ পিঠে প্রতিদিন এবং প্রতি শনি ও মঙ্গলবার মা কালী পূজার প্রচলন দেখা যায়। মা কালীর উত্‍পত্তির পৌরাণিক ব্যাখ্যা সনাতন ধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী মা কালীর আবির্ভাব সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তা হল পুরাকালে শুম্ভ এবং নিশুম্ভ নামক দুই দৈত্য সারা পৃথিবী জুড়ে তাদের ভয়ঙ্কর ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। দেবতারাও এই দুই দৈত্যের কাছে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। ফলে দেবলোক তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়, তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেবলোক ফিরে পাওয়ার জন্য আদ্যশক্তি মা মহামায়ার তপস্যা করতে থাকেন। তখন দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের কাছে আবির্ভূত হন এবং দেবীর শরীর কোষ থেকে অন্য এক দেবী সৃষ্টি হয় যা কৌশিকী নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত দেবী কৌশিকী। তন্ত্র অনুসারে কালী দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী। শক্তির দেবী হিসেবে শ্যামা বা কালীমূর্তির আরাধনা করেন শাক্তগণ। শাস্ত্রে বলা রয়েছে, তন্ত্র মতে যে সব দেব-দেবীদের পূজো করা হয়, তাঁদের মধ্যে কালী পুজো অন্যতম। বলা হয়, যাঁরা সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করতে চান, তাঁরা তন্ত্র-মন্ত্র ক্ষমতায় বিশ্বাসী। মানুষরূপী ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী হতে চাইলে নিষ্ঠা সহকারে কালী পুজো করে থাকেন।

মাকালী করালবদনা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, মুন্ডমালা বিভূষিতা। তিনি বড় অনাদরের, তার কোনও অশনবসন নেই। নিজের ঘরদোর, সংসার কিছুই নেই। গণেশ, দুর্গা, লক্ষ্মী সবাই সব নিয়ে নেওয়ার পরে যেটুকু পড়ে থাকে, তাই কুড়িয়ে নিয়েই মাকালী। তার না আছে মাথার উপরে ছাদ, না আছে পায়ের তলায় মাটি। শ্মশান, হাড়গোড়, মাথার-খুলি, সাক্ষাৎ মৃত্যুকে গয়না করে পরে আছে গায়ে। আদর, সোহাগ, রূপ, ঐশ্বর্যের কোনও দাবিই নেই তার। ঘোর অমাবস্যার অন্ধকারকে আপন করে সে দিব্যি সুখী। এত অনাদরের পরও হেসে যাচ্ছেন তিনি অট্টহাস্যা, তিনি সদা হাস্যমুখী।

আমাদের শাস্ত্রে তন্ত্রে ৯ রকম কালী মূর্তির কথা আছে। সংক্ষিপ্ত আকারে তা দেওয়া হল ।
দক্ষিণা কালী মাতা।।
“করালবদনাং ঘোরাং” ধ্যান মন্ত্র টি দক্ষিণা কালীর ধ্যান। তিনি করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, দিব্যা এবং মুন্ডমালা বিভূষিতা। তিনি মহা মেঘ প্রভা শ্যামা ও দিগম্বরী। তাঁর গলদেশের মুন্ডমালা থেকে রুধিরধারা বিগলিত হয়ে সর্বাঙ্গ অনুলিপ্ত করছে। তার কর্ণে শবদ্বয় ভূষণ রুপে বিদ্যমান, এবং তাতে তিনি হয়েছেন আরো ভয়ানক। দেবীর বদন সুখপ্রসন্ন, তাঁর শ্রী মুখপদ্ম মৃদুমন্দ হাস্যে সমুজ্জ্বল। আমরা সকলে দক্ষিণা কালীরই পূজো করে থাকি।
শ্মশ্মান কালী মাতা।।
ইনি অঞ্জনাদ্রিনিভা, রক্তনেত্রা, মুক্তকেশী, শুস্কমাংসা, অতি ভৈরবা, পিঙ্গল নয়না। এঁনার বাম হস্তে মাংস ও মদ থাকে দক্ষিণ হস্তে সদ্যশ্ছিন্ন নরমুণ্ড থাকে। ইনি স্মিতবক্ত্রা, সর্বদা আমমাংস চর্বণ তৎপরা, নগ্না, সদা মদ্যপানে প্রমত্তা। ইনি নানা অলঙ্কার পড়েন।
এঁনার পূজা গৃহস্থ বাড়িতে হয় না। শ্মশ্মানেই এই মায়ের পূজো হয়।
গুহ্যকালী মাতা।।
ইনি মহামেঘপ্রভা, কৃষ্ণ বস্ত্র পরিধান করেন, লোলজিহ্বা, ঘোর দ্রংষ্ট্রা, কোটাক্ষী, হসন্মুখী, এঁনার কন্ঠে নাগ হার। ভালে অর্ধচন্দ্র, শিরের জটাজাল নভো স্পর্শী। ইনি শব আস্বাদনে আসক্তা। গুহ্যকালী নাগ যজ্ঞপবীত ধারন করেন, নাগশয্যেপরি বিরাজিতা।গুহ্যকালীর পূজো গৃহস্থ বাড়িতে হয় না। তিনি কেবল সাধকদের দ্বারাই পূজিতা। তবে কিছু পণ্ডিত এর মতে গ্রহ দোষ কাটানোর জন্য গৃহস্থ বাড়ীতে এই মায়ের পূজো করা যেতে পারে।
সিদ্ধকালী মাতা।।
সিদ্ধকালী তার দক্ষিণের হস্তের খড়গ দ্বারা চন্দ্র মণ্ডল উদ্ভিন্ন করছেন। সেই চন্দ্র মণ্ডলের গলিত রস দেবীর সর্বাঙ্গ প্লাবিত করছে। তিনি বাম হস্তের কপাল পাত্রে ঐ অমৃত ধারন করে পান করছেন। দেবী ত্রিনয়নী, মুক্তকেশী, দিগম্বরা। তাঁর কটিদেশ কাঞ্চী দ্বারা বদ্ধ। শিরে মনি মুক্ত খচিত মুকুট। তিনি দীপ্তজীহবা, এঁনার তনু কান্তি নীলোৎপল সদৃশ। কর্ণে তার রবি শশী তুল্য সমুজ্জ্বল কুন্ডল দ্বয়, দেবী আলীঢ়পাদা। সিদ্ধকালী মাতা কেবল সাধক দের দ্বারাই পূজিতা। গৃহস্থ ব্যাক্তিরা এঁনার পূজো করেন না।
আদ্যাকালী মাতা।।
ইনি মেঘাঙ্গী, শশী শেখরা, ত্রিনয়না, রক্তাম্বরা, বরভয়করা, রক্তারবিন্দস্থিতা, মাধ্বীক পুস্পজাত মধুর মদ্য পান পূর্বক তাঁর সম্মুখে নৃত্যপর মহাকালকে দর্শন করে দেবী বিকাসিতাননা। আদ্যাকালীর পূজো গৃহস্থ ও সাধক সবাই করতে পারেন।
মহাকালী মাতা।।
তন্ত্রসার গ্রন্থ অনুসারে মহাকালী পঞ্চদশ নয়না, মহারৌদ্রী। এঁনার হাতে শক্তি, শূল, ধনু, বাণ, খড়গ, খেটক, বর ও অভয় থাকে। শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থানুসারে পুরাকালে ভগবান বিষ্ণুর কর্ণ থেকে মধু আর কৈটভ নামক দুই অসুর জন্মান। তারা সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে আক্রমণ করলে, ব্রহ্মদেব প্রান রক্ষার জন্য ভগবান বিষ্ণুর স্তব করতে লাগলেন। কিন্তু যোগমায়ার প্রভাবে ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিলেন। ব্রহ্মদেব তখন ভগবান বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগানোর জন্য আদিশক্তির স্তব করলেন, ব্রহ্মার স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী ভগবান বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগিয়ে প্রকট হলেন। ও মহাকালী রুপে প্রকট হলেন। কেবল সাধক রাই এঁনার পূজো করতে পারেন। কথিত আছে ইনি প্রথমে সাধককে নানা ভাবে ভয় দেখান। সাধক ভয় তুচ্ছ করে সাধনার পরীক্ষায় সফল হলে ইনি নানা রকম সিদ্ধি দান করেন ।
চামুন্ডাকালী মাতা।।
শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থানুসারে চন্ড ও মুন্ড নামক দুই দানব দেবী কৌষিকীর সাথে যুদ্ধ করতে আসলে দেবী তার ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করেন। সেখানে থেকেই দেবী চামুন্ডার আবির্ভাব হয়। চন্ড ও মুন্ড নামক দুই দানব কে বধ করার জন্য তিনি চামুন্ডা নামে খ্যাত হন। তিনি বিচিত্র নর কঙ্কাল ধারিনী, নরমুণ্ড মালিনী, ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা, অস্থি চর্মসার দেহ স্বরূপা। অতি ভীষনা, বিশাল বদনা, লোলজিহ্বা, ভয়ঙ্করী, কোটর গতা, আরক্ত চক্ষু বিশিষ্টা এবং সিংহ নাদে দিক মণ্ডল পূর্ণ কারিনী। চামুন্ডাকালী মাতা শব বাহনা। ইনি চতুর্ভুজা। এঁনার পূজো কেবল সাধক দের জন্যই। গৃহস্থ বাড়ীতে বা গৃহস্থ লোকেরা এনার পূজো করেন না।
ভদ্রকালী মাতা।।
তন্ত্র মতে ভদ্রকালী ক্ষুধায় ক্ষীণা। কোটোরাক্ষী , মসিমলিনমুখী, মুক্তকেশী। ভদ্রকালীর কর দ্বয়ে জ্বলন্ত অনল শিখার ন্যায় দীপ্ত পাশ যুগ্ম থাকে। দেবী পুরাণ বলেন – দেবী অন্তিমে মৃত্যুকালে ভদ্র বা মঙ্গল বিধান করেন, তাই তিনি ভদ্রকালী। কালিকা পুরাণ মতে দেবীর গাত্রবর্ণ অতসী পুস্পের ন্যায়, এবং কর্ণে উজ্জ্বল কুন্ডল থাকে। তাঁর মস্তক জটাজুট, অর্ধচন্দ্র, মুকুটে ভূষিত, নাগ হার ও স্বর্ণ হার তাঁর ভূষন। তাঁর দক্ষিণ বাহুতে শূল, চক্র, খড়গ, শঙ্খ, বাণ, শক্তি, বজ্র, দন্ড এবং বাম করে খেটক, চর্ম্ম, চাপ, পাশ, অঙ্কুশ, ঘণ্টা, পরশু, মূষল থাকে। ইনি সিংহ বাহনা, তাঁর আরক্ত ত্রিনয়ন অতিশয় দীপ্ত। ইনি বামপদ দ্বারা মহিষাসুরকে আক্রমণ পূর্বক শূল দ্বারা তাকে বিদীর্ণ করে অবস্থিতা। বস্তুত ইনি দুর্গামূর্তি।
এঁনার পূজো গৃহস্থ ও সাধক উভয়েই করতে পারেন।
রক্ষাকালী মাতা।।
ইনি চতুর্ভুজা, কৃষ্ণবর্ণা, মুন্ডমালা বিভূষিতা। দক্ষিণ কর দ্বয়ে খড়গ, নীলপদ্ম থাকে। বাম কর দ্বয়ে অসি ও খর্পর থাকে। এঁনার গগনস্পর্শী জটিল শীর্ষে এবং কন্ঠে মুন্ডমালা। ইনি রক্ত চক্ষু বিশিষ্টা এবং বক্ষে নাগ হার যুক্তা। এঁনার পরিধানে কৃষ্ণ বস্ত্র, কটিতে ব্যাঘ্রচর্ম। ইনি বাম পদ শব হৃদয় এ এবং দক্ষিণ পদ সিংহ পৃষ্ঠে স্থাপন পূর্বক মদ্যপানে নিরতা। ইনি অট্টহাস্যা, মহাঘোররাবযূতা এবং সুভীষণা।

হে দেবী, তুমি সর্বোৎকৃষ্টা জয়যুক্তা দেবী জয়ন্তী; তুমি জন্মমৃত্যুবিনাশিনী মোক্ষপ্রদায়িনী দেবী মঙ্গলা; তুমি সর্বসংহারকারিণী কালী; তুমি সুখদায়িনী ভদ্রকালী; আবার তুমিই প্রলয়কালে ব্রহ্মা প্রমুখের মাথার খুলি হস্তে নৃত্যরতা কপালিনী। তুমি দুর্গা, কারণ বহু কষ্ট স্বীকার করে তবে তোমায় লাভ করা যায়; তুমি চৈতন্যময়ী শিবা; তুমি করুণাময়ী ক্ষমা; তুমি বিশ্বধারিণী ধাত্রী; তুমি দেবগণের পোষণকর্ত্রী স্বাহা ও পিতৃগণের পোষণকর্ত্রী স্বধা। তোমায় নমস্কার করি l হে দেবী চণ্ডিকা, তোমার পুণ্য স্তবগাথা ঐশ্বর্য, সৌভাগ্য, আরোগ্য, শত্রুহানি ও পরম মোক্ষলাভের উপায়।আদ্যাশক্তি মহামায়া দেবী শ্রী শ্রী মহাকালী তোমার স্তবমন্ত্রে মানবলোকে জাগরিত হোক ভূমানন্দের অপূর্ব প্রেরণা…..! কালীপুজো পালিত হবে ১৪ -ই কার্তিক বৃহস্পতিবার -১৪৩১ বঙ্গাব্দl (৩১ অক্টোবর ২০২৪), কার্তিক অমাবস্যা তিথি শুরু হবে ৩১ অক্টোবর বেলা ৩টে ৯ মিনিটে। সেদিন রাতেই হবে মা কালীর আরাধনা। পরের দিন ১ নভেম্বর ২০২৪ শুক্রবার সন্ধ্যা ৫টা ৯মিনিট পর্যন্ত চলবে অমাবস্যা তিথি।
শ্রী শ্রী কালীমাতার ও জগৎ গুরু ভগবান স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজের শুভ ও মঙ্গলময় আশির্বাদ আপনাদের সকলের শিরে বর্ষিত হোক… এই প্রার্থনা করি…! কালীমাতা ও গুরুদেব সকলের মঙ্গল করো, সবাই ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক”!
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্…..!
স্বামী আত্মভোলানন্দ(পরিব্রাজক)