মূল্যবান মনুষ্য জীবনে ত্যাগ-বৈরাগ্য ও প্রকৃত সাধু : স্বামী আত্মভোলানন্দ (পরিব্রাজক)।

0
10

আমাদের মূল্যবান মনুষ্য জীবনে হিন্দু সনাতন ধর্মে দুর্লভ মনুষ্য জন্ম লাভ করে তিনটি জিনিস লাভ করার প্রবল ইচ্ছা প্রতিটি মানুষের বিশেষ করে সৎ ও সাধু মানুষের জীবনে বিশেষ প্রয়োজন। ১.সদগুরু ভগবান লাভ ও সদগুরুর আশীর্বাদ লাভ করার প্রবল ইচ্ছা, ২. সততা ও সৎভাবে জীবন যাপনের চেষ্টা করার প্রবল ইচ্ছা, আর ৩.আমাদের সুন্দর তপোভূমি, পুণ্যভূমি মহান ভারতভূমিকে জানা, ভারতীয় দর্শনকে জানা, ও ভারত ভূমিকে দর্শনের প্রবল ইচ্ছা। ভারতীয় দর্শনে ত্যাগ কি? ত্যাগের অর্থ হল উদারতায় ত্যাগ করা, পরিত্যাগ করা, ভারতীয় দর্শন অনুযায়ী ত্যাগ হল বর্জন, পরিহার, বিসর্জন, নিক্ষেপ, বৈরাগ্য ও নিরাসক্তি। বৈরাগ্য ও ত্যাগ এই দুটি মানব জীবনে মোক্ষ অর্জনের একটি পথ বা উপায়। বৈরাগ্য হল বিচ্ছিন্নতা বা ত্যাগ, বিশেষ করে অস্থায়ী বস্তু জগতের বেদনা এবং আনন্দ থেকে ত্যাগ। বৈরাগ্য হল সংসারে বা বিষয়ভোগে অনাসক্তি, ঔদাসীন্য, বাসনা রহিত। ত্যাগেই ত্যাগীর সুখ। ধর্মের পরীক্ষা ত্যাগে। যে মানুষ যত ত্যাগী সেই মানুষ ততো ধার্মিক। দধীচি মুনি একজন শ্রেষ্ঠ ত্যাগী ছিলেন। বৃহত্তর স্বার্থে মথুরা গমনকে হেতু করে শ্রীরাধাকে ত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণ ত্যাগেরই পরিচয় দিয়েছিলেন।

আমরা ভারতীয়, আমাদের কর্মময় জীবন, এবং ধর্মময় মনপ্রাণ। কিন্তু, সাধু ব্যক্তি জাগতিক প্রাপ্তির অহংকারে গা ভাসায় না। সাধুর পরিচয় বসনে নয়- চিন্তনে, বচনে ও আচরণে। যিনি কায়মনোবাক্যে ঈশ্বরের শরণাগত, তিনি সাধু। সাধুর জীবনে প্রথম প্রয়োজন আত্মশ্রদ্ধা। আত্মশ্রদ্ধা থেকে আসে আত্মবিশ্বাস। নির্বিচারে অন্যের নির্দেশ মেনে চলাকে দাসত্ব বলে। সাধু ব্যক্তি, স্বাবলম্বী ব্যক্তি কখনোই কারো দাসত্ব করে না। অযোগ্য স্থানে মাথা নত করে না। শিরে জটাজুট ধারণ করলেই সাধু হওয়া যায় না, যেমন তৈলঙ্গস্বামীর জট ছিল না। গলায় বা হাতে রুদ্রাক্ষ ধারণ করলেই সাধু হওয়া যায় না, রামকৃষ্ণ দেবের গলায় বা হাতে রুদ্রাক্ষ ধারণ করা ছিল না। মঠ-মন্দির-মিশন থাকলেই সাধু হওয়া যায় না, বাবা বামদেবের কোন মঠ-মন্দির-মিশন ছিল না। লাল,কালো, গেরুয়া, বস্ত্র পরলেই সাধু হওয়া যায় না, লোকনাথ বাবার পরনে লাল, গেরুয়া বা কালো বস্ত্র থাকতো না। সঙ্ঘ বা সংগঠন করে সাধু হওয়া যায় না, লাহিড়ী মহাশয়ের কোনও সঙ্ঘ বা সংগঠন ছিল না। বেনারসের কিনারাম বাবার গলায় ‘নাদি’ ছিল না, তবুও তিনি অঘোরী সাধকদের গুরু ছিলেন। যিনি সত্যে প্রতিষ্ঠিত, আত্মধর্মে অবিচল, তিনি ছাড়া কেই গুরু হতে পারেন না, তাই দ্রোণাচার্য্য অর্জুনকে শিক্ষা দিয়েও গুরু নন, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের মিত্র হয়েও যথার্থই গুরু।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনকে বৈরাগ্যের জ্ঞানও দেন । সেখানে তিনি অর্জুনকে বলেন, যদি এই মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাও, তাহলে অভ্যাস ও বৈরাগ্য— এই দুই তলোয়ার দিয়ে মনকে প্রহার করতে হবে। জ্ঞানই মানুষের হৃদয়ে বৈরাগ্যের জন্ম দেয়। সেই সত্যিকারের জ্ঞানই আমি তোমাকে প্রদান করছি অর্জুন।

জগৎগুরু আদি শংকরাচার্য বলছেন:-ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ” “ব্রহ্মই সত্য, জগৎ মিথ্যা, জীব ব্রহ্মই, ব্রহ্ম ব্যতীত অপর কিছু নহে।” সমস্ত জগৎ বাস্তবে মিথ্যা, নশ্বর। মায়ার প্রভাবে তা সত্য মনে হয়। সর্বেশ্বরবাদী অনুসারে, মানুষের সত্যিকারের সত্ত্বা আত্মা ও ব্রহ্ম হলো শুদ্ধ চৈতন্য, এবং এ বিষয়ে উপনিষদ গুলিতে সামগ্রিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। অদ্বৈত বেদান্তের প্রধান ব্যাখ্যাকর্তা হলেন আদি শঙ্কর। তবে তিনি এই মতের প্রবর্তক নন। পূর্ব প্রচলচিত অদ্বৈতবাদী মতগুলিকে তিনি সুসংবদ্ধ করেছিলেন।

জীবনে সর্বদা সৎ ও সাধু মানুষকে দুটি জিনিসের সাথে লড়াই করতে হয়, একটি দারিদ্র্য এবং অন্যটি খারাপ লোকের ষড়যন্ত্র। প্রকৃত সাধুকে অনন্ত মুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হয়। তাই, ত্যাগেই ত্যাগীর সুখ, এই পরম সত্য-জ্ঞান বিশ্বাস হয়ে গেলেই বৈরাগ্য সম্ভব। যে মানুষের মধ্যে ত্যাগের প্রাবল্য যত বেশী, তিনি ততই ব্যক্তিত্ববান মানুষ। যে মানুষ যত বেশি ত্যাগী, তিনি ততই ব্যক্তিত্ববান। ত্যাগীর সাথে পেরে ওঠা খুব মুশকিল। ত্যাগীকে বশে আনা খুব মুশকিল। ত্যাগীর ত্যাগ ষড়যন্ত্রকারীর সব ষড়যন্ত্রকে মুহূর্তে নস্যাৎ করে দিতে পারে। মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের চাবিকাঠি ত্যাগ। *তাই, বেশভূষা, বসন ও ভূষণ নয়, দেহ নয়, নিজের মনকে সন্যাসী বানাও, মোহের বন্ধন ছিন্ন কর,ত্যাগ কর।* নিজের কর্তব্যের ওপর মনোনিবেশ কর। তোমার ধর্ম অনুযায়ী কর্ম কর।

জগৎ গুরু ভগবান স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ ও বলছেন “বৈরাগ্যই সর্বপ্রকার বাসনাকে নাশ করিয়া মানুষকে প্রকৃত মুক্তির পথে লইয়া যায়।” তিনি আরও বলছেন:- ধর্ম কি ? ধর্ম হল:- ত্যাগ, সংযম, সত্য ও ব্রহ্মচর্য। অর্থাৎ ধর্মের চারটি ধাপের মধ্যে প্রথম ধাপই হচ্ছে ত্যাগ। তিনি ধর্মের প্রথম ধাপই বলছেন ত্যাগ। তাই, সারকথা হল ত্যাগ ও বৈরাগ্য মানুষকে অনন্ত মুক্তির পথে লইয়া যায়।

প্রকৃত সাধু হতে গেলে প্রকৃত অর্থে অন্তঃশৌচ ও বহিঃশৌচ করার দরকার হয়। সাধু সন্যাসীদের জীবন অত্যন্ত পবিত্র ও ধর্ম নির্দেশিত পথে চলে। কঠোর অনুশাসন, সাধনা, শাস্ত্রপাঠ বা স্ব্যাধ্যায় ও মোক্ষলাভ ই একজন সন্যাসীর জীবনের লক্ষ্য। এছাড়া তাঁর জীবনে উদ্দেশ্য “আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ” যেহেতু নিজের মুক্তি ও মানব কল্যাণ তাই তিনি মানুষ কে ধর্ম শিক্ষা দেবেন ও জনহিতকর কাজে যুক্ত থাকবেন।
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্ …..।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here