“…কোনো অনুষ্ঠানে যেতে গেলে সোনার গয়না না থাকায় ইমিটেশন আর লিপস্টিকের বদলে সিঁদুর আর বোরোলিন মিশিয়ে ঠোঁট টাকে একটু লাল করা…তাঁদের মতো সাধারণ হতে গেলে হয়তো অনেকটা অসাধারণত্ব লাগে…”
বহু দিন ধরেই ভাবছিলাম এই লেখাটা লিখবো। কিন্তু কিছুতেই বসাও হচ্ছিলো না, আর কোনো না কোনো কারণে লেখাও হচ্ছিলো না। কিন্তু আজ সব কাজ ফেলে, সব বাধা দূরে সরিয়ে লিখতে বসলাম। আজকের লেখাটা যাঁকে নিয়ে তিনি খুবই সাধারণ একজন মহিলা। আর পাঁচ জন তথাকথিত সফল মহিলাদের মধ্যে তিনি কোনো ভাবেই আসেননা। অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থেকে সমাজের মুখ্য শ্রেণীর একজন হয়ে ওঠার বিন্দুমাত্র উদাহরণ নেই তাঁর কাজে। আদর্শ নাগরিকের সমস্ত গুণাবলীও যে প্রবল ভাবে প্রকট তাও নয়। তাহলে কেন লিখছি? প্রথম কারণ ২০ শে জানুয়ারি তাঁর শুভ জন্মদিন (বাংলা মতে আজকে) আর দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ বা বাদবাকি সব কারণ হলো আমি তাঁকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি তাই। তিনি আসলে তাঁরই মতো আরোও লক্ষ লক্ষ সাধারণ নারীর প্রতিভূ। যাঁরা কোনোদিনও প্রচারের আলোতে আসতে পারেন না। যাঁদের নিয়ে তুফানী চায়ের আড্ডায় কোনো চর্চা হয়না। বাড়ির বা পরিবারের সবচেয়ে কম আলোচিত মানুষ হয়েই থেকে যান যাঁরা বছরের পর বছর বা সারাটা জীবন। কিন্তু এখন অনুধাবন করি তাঁদের মতো সাধারণ হতে গেলে হয়তো অনেকটা অসাধারণত্ব লাগে।
১৯৬০ সালের ২০শে জানুয়ারি ভবানীপুর নিবাসী শ্রী ব্রজেন্দ্র কুমার গুহবর্মন এবং শ্রীমতি শান্তিরানী গুহবর্মন এর কোলে আসে তাঁদের তৃতীয় সন্তান। নাম রাখা হয় মা কালির নামানুসারে – শিবানী। টাকি শ্রীপুরের মহারাজ প্রতাপাদিত্য রায়ের ২৫ তম বংশধর কিংবা ড: বিধান চন্দ্র রায়ের ভাগ্নে ব্রজেন্দ্র কুমার ছিলেন টাকি শ্রীপুরের জমিদার। ঝাড়গ্রামে নিজের বিশাল বাড়ি। তার সাথে ভবানীপুরে বলরাম বসু ঘাট রোডে গঙ্গার ধারে সবচেয়ে বড় বাড়ি (এখন যদিও তা সিকি ভাগে এসে ঠেকেছে)। শিবানীর ছোট বেলাটা তাই মোটামুটি বেশ দুধে ভাতেই কাটে। সমস্যা দেখা দেয় সরকারের পক্ষ থেকে জমিদারি কেড়ে নেওয়া হলে। সেই সময় বেশ কিছুদিন ঝাড়গ্রামে কাটালেও ব্রজেন্দ্র কুমার কে সপরিবারে ফিরে আসতে হয় ভবানীপুরে। বিভিন্ন জায়গায় কর্ম সন্ধানের পর এইচ.এম.ভি আর আকাশবাণী তে বেশ কিছু দিন কাজের পরে ব্রজেন্দ্র কুমার যোগ দেন ঊষা কোম্পানিতে। ততদিনে পরিবারে এসেছে আরোও চার পুত্র সন্তান। কিন্তু এক এক করে চলে গেছে সব বিষয় সম্পত্তি। বড় মেয়ের বিয়ে দিতে ঝাড়গ্রামের সম্পত্তি জলের দরে বেচে দিতে হয়েছে। জমিদারি চলে গেলেও সেই জমির মালিকানা বেশ কিছুদিন ছিল। কিন্তু তাও একসময় পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। আর এভাবেই চলতে চলতে ১৯৭৬ সালে ব্রজেন্দ্র কুমার ইহলোক ত্যাগ করেন। পিছনে রেখে যান স্ত্রী ও সাত সন্তান। ভগ্ন সংসারের হাল ধরতে শান্তিরানী শুরু করেন ঘরোয়া ব্যবসা। ধূপ, আচার, বড়ি এই জাতীয় খুব সামান্য উপকরণ তৈরী ও বিভিন্ন বাড়িতে সরবরাহ করার ব্যবসা। আর সেই কাজে মাকে সাহায্যে এগিয়ে আসে ছোট্ট শিবানীও। তার অনেক আগে থেকেই যদিও নিজের থেকে ছোট চার ভাইকে কিংবা বড়দির ছেলে মেয়েদের মানুষ করার আংশিক ভারও বর্তায় তাঁর উপর। সেই ছোট বয়স থেকেই সংসারের ভার বহন করার গুরুদায়িত্ব শিবানীর বেড়ে ওঠার সাথে জড়িয়ে যায়, যা কিনা আজও একই ভাবে বয়ে চলেছে।
ছোটবেলার মেয়েলি রান্নাবাটি খেলার পরিবর্তে হাতে উঠে আসে আসল হাতা খুন্তি। পুতুল নিয়ে খেলার পরিবর্তে কোলে এসে পরে ছোট ছোট ভাইরা বা বোনপো বোনঝিরা। তাঁর সম সাময়িক শিশু বা কিশোর অবস্থার অন্যান্য বচ্চাদের মননের বদলে তাঁর মনন কিছুটা আলাদা ভাবে গড়ে ওঠে। অসাধারণ হাতের লেখা কিংবা বাংলা সাহিত্যের ওপর ভালো দখল থাকা অথবা বিজ্ঞান বিষয়ে যথেষ্ট মেধা থাকা সত্ত্বেও শিশু মনের পূর্ণ বিকাশের খামতিতে আর যোগ্য সহায়তার অভাবে সে মোটামুটি ভাবে স্কুল ফাইনাল পাশ করে ভবানীপুর গার্লস থেকে। মেধাবী ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও উপযুক্ত গাইডেন্সের অভাবে এগজামিনোফোবিয়া বা পরীক্ষা ভীতির কবলে পরে সে। এরপর যোগমায়া দেবী কলেজ। আর তারপর কন্যা দায়গ্রস্ত বিধবা মায়ের ভার লাঘব করতে ১৯৮০ সালের ২৭শে এপ্রিল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। তাই নতুন কিছু করার বা নতুন কিছু ভাবার অবকাশ থাকেনা তাঁর কাছে। আরোও অনেক ভালো কিছু করতে পারতো হয়তো সে। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি তাঁর প্রতিকূল হয়ে দাঁড়ায়। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা শ্রী সুরথ কুমার চট্টোপাধ্যায় ও শ্রীমতি রানী চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যম পুত্র শ্রী নারায়ণ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সাথে শুরু হয় নতুন জীবন। ফুটবল খেলাকে পেশা করতে চাওয়া নারায়ণের জীবনটাও যে তখন খুব সাবলীল তা নয়। টানাটানির সংসারে বাবার পাশে থাকতে আর স্বপ্ন ভঙ্গ করা শারীরিক অসুস্থতা ফুটবল থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে ততদিনে। তাই রুজি রুটির দায়ে বাটা কোম্পানির সেলসম্যানের চাকরি। আর তারপর এক জেঠতুতো দাদার উৎসাহে পরীক্ষা দিয়ে সি.এম.ডি.এ তে রাজ্য সরকারি কর্মী হিসাবে অন্তর্ভুক্তি। কিন্তু কাজ হলো পাম্প অপারেটরের। চাটার্ড একাউনটেন্সি পড়ার আশা করা বা ফুটবলার হবার স্বপ্ন দেখা ছেলে কিন্তু সেই কাজটিকেই মন প্রাণ দিয়ে করতে থাকেন আর তার সাথে তার পাম্প হাউসে শুরু করেন স্থানীয় যুবক দের নিয়ে গান বাজনার আসর আর শারীরিক কসরতের আখড়া। আর সেই গানের সূত্র ধরেই পরিচয় হলো শিবানীর ভাইয়ের সাথে। কারণ তার পাম্প হাউসের ঠিকানা যে ভবানীপুর আর ছোট থেকেই শিবানী খুব সুন্দর গান গায় যে। তাই পাম্প হাউসের আর পাঁচ জন যুবকের মধ্যে শিবানীর ভাইয়ের সাথে সখ্যতা বেড়ে ওঠে এবং তার সাথেই তাদের বাড়ি যাওয়া। এরপর ধীরে ধীরে সেই যোগাযোগ বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে প্রণয়ের শেষ সিঁড়ি পার করে।
ছোটবেলা থেকেই বাড়ির ভিতর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক চর্চার পাঠ চলতে দেখেছে শিবানী। দাদা নাচ শিখেছে, সেজো ভাই সেতার, নভাই গান কিংবা বাবার এইচ এম ভি তে কাজের সূত্রে বিভিন্ন গায়ক গায়িকাদের কাজের খবর শোনা। আর এভাবেই বিভিন্ন মানুষের গান শুনে শুনে নিজে নিজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গান গেয়ে প্রস্তুতি নেওয়া। আর বাড়ির সব কাজে সাহায্যের পর যেটুকু সময় বেঁচেছে সেই সময় নিজে নিজেই হারমোনিয়াম বাজানো শেখা। সাথে সাঁইবাবার ভজন। তখনকার দিনে ভালো ভজন গাইবার সুবাদে বহু বড় বড় মানুষদের বাড়িতে যাবার সুযোগ মেলে। পার্ক স্ট্রিটের বিশিষ্ট ধনপতি বি.ডি. চোপড়া কিংবা সাঁই সাধিকা মাধুরী আম্মা থেকে শুরু করে টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির প্রখ্যাত অভিনেতা ধীরাজ ভট্টাচার্য কিংবা সুপার ষ্টার রঞ্জিত মল্লিক – এরকম বহু মানুষের বাড়িতে তখন ভজন গাইবার জন্য ডাক পেত কিশোরী শিবানী। কলকাতার বাইরে যাবার জন্য গাড়িও পাঠানো হতো বাড়িতে। ছোট খাটো চেহারা, মাথায় এক ঢাল চুল, সুন্দর গান গায়, ভদ্র স্বভাবের কিশোরী শিবানীর বিবাহের জন্য প্রস্তাব আসে তখনকার দিনের বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এক অভিনেতার বাড়ি থেকে। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে কোনো প্রযোজকের নজরে পড়ায় বাড়ি বয়ে এসে ফিল্মে অভিনয় করার প্রস্তাব আসে। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই বাড়ির অমত আর লাজুক স্বভাবের শিবানীর কোনো উদ্যোগ না থাকা তাঁকে রুপালি পর্দার জগৎ থেকে দূরেই রাখে। আর বিয়ের পর স্বামী-সংসার-সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকাই জীবনের মুখ্য লক্ষ্য হয়ে ওঠে। শখ আহ্লাদের মতো ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র বিষয় গুলো নিয়ে তখন ভাবার সময় কৈ।
চট্টোপাধ্যায় পরিবারে বিয়ে হয়ে আসার পর প্রথম যে জিনিষটা শিবানীকে হারাতে হয়, তা হলো তার পিতৃদত্ত নাম। পরিবারে তার এক বড় ননদের নাম শিবানী হওয়ায় তার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মৌসুমী অর্থাৎ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় আর ডাক নাম শম্পা। জমিদার বংশের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও, বিয়ের সময় যেহেতু তাদের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল তাই নারায়ণকে প্রভূত পরিমাণ ত্যাগ, পরিশ্রম এবং বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হয় নিজের স্ত্রী এবং শ্বশুর বাড়ির সম্মান অক্ষুন্ন রাখতে। আসলে প্রত্যেক পরিবারেই তো কম বেশি অনেক ‘শুভাকাঙ্খী’ আত্মীয় থাকেন। তাই তাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে চায়নি। যাইহোক বেশ ভালো ভাবেই বিবাহ সম্পন্ন হয়। কিন্তু গোল বাঁধে বৌভাতের পরদিন থেকে। যৌথ পরিবারের একমাত্র কাজের দিদি প্রিয়বালার পরিবারের কেউ অসুস্থ হওয়ায় সে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছুটি নেওয়ায় বাড়ির বেশির ভাগ কাজের দায়িত্বই এসে বর্তায় শম্পার কাঁধে। কারণ বাড়িতে মহিলা বলতে তখন দুজন। শাশুড়ি মা রানী আর সে নিজে। রান্না করা, কাপড় কাচা, বাসন মাজা, তিন তলা বিশাল বাড়ির ঘর পরিষ্কার, কুয়ো থেকে জল তোলা, রান্নার জ্বালানির জন্য কাঠ কাটা বা কয়লার গুঁড়ো দিয়ে ছাতে গুল দেওয়া (কারণ তখনও গ্যাসে রান্নার প্রচলন হয়নি, তাই কাঠ এবং গুলের উনুনেই রান্না হতো) ইত্যাদি প্রভৃতি প্রায় সব কাজেই চলতে থাকলো তার সক্রিয় অংশগ্রহণ। যদিও শ্বশুর মশাই সুরথ কুমার এবং শাশুড়ি রানী সব সময়েই তাকে সাহায্য করে গেছেন। অভাবের সংসারে বিয়েটাই যেখানে বিশাল বড় ব্যাপার সেখানে মধুচন্দ্রিমা তো সত্যি আকাশের চাঁদ। তাই কোনোদিনই আর সেটা হয়ে ওঠেনি। বছর ঘুরে ১৯৮১ সালের ১৯ শে এপ্রিল বড় ভাসুর পার্থসারথির সাথে বিয়ে হয় পুরুলিয়া নিবাসী চাটার্জ্জী পরিবারের ছোট মেয়ে মীনাক্ষীর সাথে। সেই বিয়ের সাজ সরন্জাম প্রায় একা হাতেই সামলায় সে। কিন্তু যৌথ পরিবারে লোক সংখ্যা বাড়লে কাজের লোকেরও যে প্রয়োজন সে কথা অনুধাবন করে বৌভাতের দিন থেকে একজনকে নিয়োগ করেন শম্পার জেঠি শাশুড়ি।
৮১ সালের লক্ষ্মী পুজোর পর ঠিক হয় প্রথম বারের জন্য তারা জুটিতে কোথাও ঘুরতে যাবে। মধ্যবিত্ত পরিবারে ঘুরতে যাওয়াটা যেখানে বিলাসিতা সেখানে ভিনরাজ্যে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই, তাই দী.পু.দা-ই সেরা পছন্দ। শম্পার দিদি-জামাইবাবুদের দার্জিলিং-এ হোটেলের ব্যবসা, তাই একসাথে দুই বোনের পরিবার সেখানেই যাওয়া মনস্থির করলো। কিন্তু ভগবান বোধহয় অন্য কিছু চেয়েছিলেন। ঠিক লক্ষ্মী পুজোর আগের দিন সেলিমপুরের মোড়ে রিক্সার ধাক্কায় মারাত্মক ভাবে জখম হলেন শাশুড়ি মা। চোয়াল ভেঙে গেছে, হাত পা ভেঙে গেছে, প্রচণ্ড খারাপ অবস্থা। এদিকে বড় জা সীমা (মীনাক্ষীর বিয়ের পর নাম) তখন তার বাপের বাড়ি পুরুলিয়ায়। অতএব দার্জিলিং যাত্রা বাতিল। সেই ৮১ সালের স্থগিত হয়ে যাওয়া দার্জিলিং ভ্রমণ তাঁরা পূর্ণ করেন ২০১৫ সালের লক্ষ্মী পুজোর পরে তাঁদের বড় ছেলে ড: অভিষেক ও বৌমা উদিতার সাথে।
এর দুবছর পর ১৯৮৩ সালের ১৪ই জুন নারায়ণ মৌসুমীর কোলে আসে তাঁদের প্রথম সন্তান। প্রথম সন্তান তাই নাম হলো অভিষেক। কিন্তু যতটা সহজে বেশির ভাগ মানুষ বাবা মা হন এক্ষেত্রে তা ছিলনা। সন্তান ধারণের আগের বেশ কিছু জটিল সমস্যা উৎরে গেলেও এক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হতে হয় তাঁদের। শারীরিক সমস্যা বা গাইনিক্যাল সমস্যার কারণে তাঁরা যান কলকাতার এক নাম করা ডাক্তার, ড: বাঙ্গার কাছে। বিভিন্ন ওষুধ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দিলেও সমস্যা কিছুতেই কমছে না। এরকম সময়ে পাড়ায় থাকা আর এক বিখ্যাত ডাক্তার ড: আর বি চ্যাটার্জ্জীর কাছে নিয়ে যান শাশুড়ি মা রানী এবং বড় জা সীমা। তিনি দুদিন আগেই আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। দেখামাত্রই ড: চ্যাটার্জ্জী বুঝতে পারেন সমস্যা কোথায়। শম্পা মা হতে চলেছেন। কিন্তু পরীক্ষা করে যা জানা গেলো, তাতে বাড়ির সবার মাথায় হাত। ততদিনে নাকি গর্ভাবস্থার সাড়ে পাঁচ মাস অতিক্রান্ত। যা কিনা সেই বিখ্যাত ডাক্তার ড: বাঙ্গা ধরতেই পারেননি। আর সেই সময় মধ্যবিত্ত্ব পরিবারের দম্পতিদের পক্ষে বোঝার মতো সরঞ্জামও বাজারে আসেনি। এবার শুরু হলো অন্য লড়াই। পাম্প অপারেটর থেকে সদ্য টাইপিস্ট পদে উত্তীর্ণ হওয়া সরকারি কর্মচারী নারায়ণের পক্ষে বড় কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাবার সামর্থ্য নেই। আবার এতো দিন হয়ে গেছে, তাই সুস্থ ভাবে সন্তানের জন্ম হওয়াটাও জরুরি। তাই সবদিক বিবেচনা করে কার্ড করানো হলো শিশুমঙ্গল হাসপাতালে। কিন্তু সেখানেও বিভিন্ন বিষয় মিলিয়ে যা খরচ তখন তা দেওয়াও কিছুটা সমস্যার। কারণ সংসার খরচ সামলাতে ১৯৭৫ সালে বাটা কোম্পানিতে চাকরি পাবার পর থেকেই মাইনের সমস্ত টাকাই মায়ের হাতে তুলে দেয় নারায়ণ। যাইহোক এক আত্মীয়ের পরামর্শে তাঁরা গেলেন মাতৃভবন হাসপাতালে। কিন্তু সেখানকার প্রধান অর্থাৎ বড়মা কিছুতেই ভর্তি নেবেন না। কারণ ততদিনে সাড়ে ছয় মাস অতিক্রান্ত। সেই আত্মীয়ের পরামর্শেই এবার তাঁরা গেলেন মাতৃভবনেরই ড: এ কে ঘোষের বাড়িতে। তিনি দেখে বললেন অবস্থা খুবই সংকটজনক। দ্রুত কার্ড না করালে এরপর চূড়ান্ত অসুবিধায় পড়তে হবে। এর সাথে তিনি এই বলেও আস্বস্ত করলেন যে তিনিও বড়মা কে অনুরোধ করবেন। এবার হাসপাতালে গেলেন শ্বশুর মশাই সুরথকুমার। একজন বয়স্ক মানুষের অনুরোধ এবং ড: ঘোষের অনুরোধে বড়মা রাজি হলেন কার্ড করাতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের তখনও শেষ নেই। কিছুদিন যেতে না যেতেই তা বোঝা গেলো। প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে জানা গেলো “ব্রিচ বেবি” হয়েছে তাঁর। অর্থাৎ মাতৃ গর্ভে সন্তানের অবস্থান উল্টে গেছে। মাথা ওপরে পা নিচে। এবং ইম্পিরিয়াল কর্ডও গলার সাথে জড়িয়ে গেছে। অনতিবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। ৩৯ দিন হাসপাতালে থেকে, তিনটে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে ড: এ কে ঘোষ সেদিন বাঁচিয়ে আনেন তাঁর “মৌসুমী মা”- কে (ডাক্তার বাবু তাঁর শেষ দিন অবধি এই নামেই ডাকতেন) আর তাঁর পুত্র সন্তানকে। তিনি তখন চট্টোপাধ্যায় পরিবারের কাছে ভগবান, কারণ অপারেশনের আগেও এটাই ভবিতব্য ছিল যে, হয় মা বাঁচবে নয়তো সন্তান।
হাজারো সমস্যা জয় করে এলো প্রথম বার মাতৃত্বের অনুভূতি। এরপর আরোও দুবার মাতৃত্বের স্বাদ পেলেও প্রথম বারের অনুভূতি সব সময়েই আলাদা। সেটা হয়তো বলে বোঝানো যাবে না। হাসপাতাল থেকে এতদিন বাদে বাড়ি ফিরলো। শরীর খুবই ক্লান্ত। তাই দোতলার ঘরে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে যায় নারায়ণের এক মাসতুতো ভাই – সেন্টু। তার গায়ে অসম্ভব জোর। কিন্তু দোতলার সিঁড়ি দিয়ে ঘরে ঢুকতেই যে আক্রমণটা ঘটে তার কোলে থাকা শম্পা ও কোলের শিশুটির ওপর তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। বাড়ির পোষ্য কুকুর ঘাউড়ি (বিখ্যাত ক্রিকেটার কারসন ঘাউড়ির নামানুসারে) এক তীব্র লাফে একেবারে তাঁর কোলে। এতদিন বাদে বাড়ির মানুষটিকে দেখতে পেয়ে তার আনন্দ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এখানেই হয়তো মানুষের সাথে কুকুরের পার্থক্য। তার অত বড় শরীর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরেও শম্পার শরীরে একফোঁটা আঁচড় পর্যন্ত লাগেনা। বলা যেতে পারে একটুও টের পায়নি সে, যে তার কোলে একটা মস্ত বড় প্রাণী ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একেই বলে ভালোবাসা। যাইহোক শুরু হলো এক নতুন জীবন। এই সময় ঘটলো এক অন্য ঘটনা। নতুন বাচ্চাকে দেখতে এলেন নারায়ণের এক মামা। তিনি সংগীত জগতের মস্ত পণ্ডিত মানুষ (বর্তমানে বলিউড বা টলিউড খ্যাত গায়ক অ্যাশ কিং অর্থাৎ আশুতোষ গাঙ্গুলীর জেঠামশাই)। বৌমার গানের প্রতি আগ্রহ দেখে শাশুড়ি মা প্রস্তাব দিলেন তাঁর দাদার কাছেই গান শেখার জন্য। বৌমাও খুশি। সারাদিনের রোজ নামচার পর কিছুটা অন্য কিছুতে নিজের মনের খোরাকি তো হবে। মামা বাবু বললেন সামনেই পরীক্ষা, তো ভালো করে থিওরি গুলো পড়ে নিজেকে তৈরী হতে। নতুন উদ্যমে শুরু হলো গানের জন্য পড়া। এদিকে পড়ায় মনোনিবেশ করায় বাড়ির কাজে তৈরী হলো ফাঁক। শাশুড়ি মায়ের একার পক্ষে সবটা সামাল দেওয়াও মুশকিলের। আর তার ওপর আশির দশকে মধ্যবিত্ত্ব বাড়ির বৌ গান শিখবে বলে বাড়ির কাজ করবে না এটা মানার মতন সামাজিক পরিকাঠামো তখন ছিলো না। তাই কিছুদিন পর স্বামীর সাথে পরামর্শ করেই ইতি টেনে দিলো সংগীত শিক্ষায়। কিন্তু কোথাও গিয়ে নারায়ণের মনের মধ্যে অন্য চিন্তা কাজ করে, তাই বেশ কিছুদিন পর ঢাকুরিয়ার বেঙ্গল মিউসিক কলেজে ভর্তি করে দেয় তাকে। এবারে বাড়ির কাজ সামলেই পাশাপাশি চলতে লাগলো প্রথাগত সংগীত শিক্ষা। যা চলে দীর্ঘ দশ বছর। সংগীত গীতপ্রভা ও সংগীত বিশারদ ডিগ্রি পাওয়ার পর আরোও এগোতে চাইলেও আর্থিক কারণে ও সন্তান প্রতিপালনের মাঝে তা আর করা হয়ে ওঠেনা। অথচ এই সময়েই বিশিষ্ট সংগীত পরিচালক শ্রী নারায়ণ গোস্বামী নিজে তাদের বাড়িতে দুবার এসে অনুরোধ করে যান। কিন্তু সেই সময় ক্যাসেট বের করার খরচ হিসাবে প্রায় ৫ হাজার টাকা দেবার সামর্থ্য নারায়ণের ছিলনা। তাই সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।
দেখতে দেখতে সময় এগিয়ে চলে। ১৯৮৬ সালের ২১ শে জুলাই নারায়ণ শম্পার ঘরে আসে তাঁদের দ্বিতীয় পুত্র। যদিও তাঁদের আশা ছিল কন্যা সন্তান। কিন্তু ভগবান যা চাইবেন তার উপরে তো কারোর কিছু করার নেই। অন্যরকম ইচ্ছে থাকলেও তার আসাকে যেহেতু কোনোভাবে আটকানো যায়নি তাই নাম হলো অনিরূদ্ধ। এবার প্রথম থেকেই সতর্ক থাকায় ও ড: এ কে ঘোষের তত্ত্বাবধানে থাকায় সেই অর্থে কোনো জটিলতা তৈরী হয়না ঠিকই, কিন্তু মুশকিল হয় অন্য জায়গায়। জুলাই মাসে সাড়ে সাত মাস গর্ভাবস্থায় শম্পা তাঁর বাপের বাড়ি যান কিছুদিন মায়ের সঙ্গে সময় কাটাবার জন্য। অফিস ফেরত নারায়ণ সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরে আসে নিজের বাড়ি সেলিমপুর। এদিকে ২০ শে জুলাই বিকেলে প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হলে তাঁর ভাইরা তাঁকে মাতৃভবন হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। তখনকার দিনে টেলিফোনের ব্যবহার না থাকায় জানতে পারেনা নারায়ণ বা তাঁর বাড়ির কেউই। ২১ তারিখ নিয়ম মাফিক অফিস ফেরত শ্বশুরবাড়ি গিয়ে জানতে পারে সব কথা। তড়িঘড়ি হাসপাতালে গিয়ে তো আরেক কাণ্ড। সমস্ত স্টাফেরা অভিনন্দন জানাচ্ছেন – আপনি বাবা হলেন, এবারও ছেলে। কিন্তু প্রিম্যাচিওর বেবি। ওজন খুব কম। সারা শরীর ঠক ঠক করে নাকি কাঁপছে। অনেক ওষুধ কিনতে হবে। হাসপাতালের নার্স লম্বা ফর্দ ধরিয়ে দেয়। নারায়ণের মাথায় বজ্রাঘাত। কারণ সেই দিন অবধিও সে তাঁর পুরোনো অভ্যাস বদলায়নি। অর্থাৎ মাইনের সব টাকা মায়ের হাতেই দিয়ে দেয়। তাই তাঁর কাছে এতো টাকা নেই। আর তার ওপর আবার এরকম অকাল আগমন। দিশেহারা পিতা টাকা জোগাড় করতে ছুটলেন বাড়ি। এদিকে বাড়িতে মা নেই। আলমারির চাবিও তার সাথেই বাইরে। সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন ছোটবেলার বন্ধু পাশের পাড়ার বাসিন্দা বিপুল রায় (আজ যিনি এই পৃথিবীতে আর নেই) আর অফিসের এক বন্ধু যিনি সারা জীবন নিঃস্বার্থ ভাবে পাশে থেকেছেন – প্রণব চৌধুরী। রাত্রি বেলা সেই টাকা নিয়ে হাসপাতালে জমা দেওয়া হলো । মাতৃগর্ভেই সন্তানের সব কিছুর প্রথম পাঠ। সেই পাঠ সম্পূর্ণ হলেই তার আবির্ভাব ঘটে পৃথিবীতে। কিন্তু এই পুত্রটি হয়তো তার সমস্ত পাঠ সময়ের আগেই সেরে নিয়েছে, তাই আর বেশি দেরি না করে আগে ভাগেই সশব্দে পদার্পন। যাইহোক আবার ২৫ দিনের দীর্ঘ হাসপাতাল সফর কাটিয়ে বাড়ি ফেরা।
দ্বিতীয় সন্তানের পর নারায়ণের চাকরিতে প্রমোশন হয়। রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে টাইপিস্ট থেকে অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট। এর সাথে অফিসের বামপন্থী ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য। গেমস ও স্পোর্টস সেক্রেটারি। বাড়িতে সময় দেবার মতো সময় নেই। তাই শম্পারও দিন এগোতে লাগলো দুই ছেলেকে মানুষ করতেই। তবে তার জন্য খুব একটা বেগ পেতে হয়না। বড়ই শান্ত বাচ্চা। যেখানে বসিয়ে রাখা হয় সেখানেই বসে থাকে। নিজেদের মধ্যে মারামারিও করে না। বড় ছেলেকে খাওয়ানোর জন্য তাও মামদো ভূতের ভয় দেখাতে হলেও দ্বিতীয় জনের সেসবের বালাই নেই। কারণ সে তো খেতেই চায় না। সেরেল্যাক পেলেই হলো, আর কিছু চাই না। আর খুব বেশি হলে চারটি সাদা ভাত। শম্পার নিজের পড়াশোনা বেশি না করার আক্ষেপ আর নারায়ণের খেলাধুলোয় অনিশ্চয়তার অভিজ্ঞতা, তার ফলে প্রথম থেকেই তাঁরা ঠিক করে রেখেছিলো ছেলেদের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেবে। নিজেরা না খেয়ে হলেও তাদের পড়াশোনায় কোনো কার্পণ্য করবে না। ১৯৮৯ সালের ২৬ শে জানুয়ারি ছোট দেওর গৌতমের সাথে বিবাহ সম্পন্ন হয় কলকাতার স্যান্যাল পরিবারের ছোট মেয়ে রূপালীর (বিয়ের পর যা হয় রুপা)। আর বৌভাতের দিন অর্থাৎ ২৮ শে জানুয়ারি খবর আসে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাইমারি সেকশান শিশু বিদ্যা বীথির এডমিশন টেস্টে অভিষেক উত্তীৰ্ণ। শুরু হয় শম্পার জীবনের এক নতুন অধ্যায়। ৮৯ সালে বড় ছেলের জন্য নরেন্দ্রপুরের সাথে যে সম্পর্ক শুরু হয় তা চলতে থাকে ২০০৭ সালে ছোট ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষা অবধি। অর্থাৎ দুই দশক। আর এই পুরো সময়টার ৯৫ শতাংশেই শম্পার অবদান।
১৯৯০ সালের ৫ই জুন। এবার হ্যাটট্রিক। আবারও পুত্র সন্তান। আবারও মাতৃভবন হাসপাতাল। আবারও ড: এ কে ঘোষ। হাসপাতাল আর রোগীর মধ্যেও যে এতটা আন্তরিক বন্ধন হতে পারে তা হয়তো ঐদিনটা না দেখলে কেউ অনুধাবন করতে পারবেন না। হাসপাতালের সমস্ত স্টাফকে সেদিন মিষ্টি মুখ করিয়েছিলো নারায়ণ। আর তাঁরাও আন্তরিক আশীর্বাদে ভরিয়ে দিয়েছিলো তাঁদের তৃতীয় পুত্রকে। সমস্ত বিপক্ষকে দমন করতে পারার আশীর্বাদ, তাই তার নাম হলো অরিন্দম। জুন মাসে তার জন্ম হলো আর তার ঠিক চার মাস বাদে অর্থাৎ অক্টোবর মাসের লক্ষ্মী পুজোর আগের দিন ঘটলো চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সবচেয়ে বেদনাদায়ক মুহূর্ত। এতদিনকার যৌথ পরিবার সামান্য কিছু কারণে ভেঙে গেলো। বাসস্থান এক থাকলেও হাঁড়ি আলাদা হলো। আর তার ফলেই পরিবারের জেষ্ঠ্য পুরুষ সুরথ কুমারের সেরিব্রাল এট্যাক। পুরো ডান দিকটা প্যারালাইসিস হয়ে গেলো। এই যন্ত্রণা ওনাকে ভোগ করতে হয় আরোও দশটা বছর। ২০০০ সালের ২৬ শে আগস্ট শেষ দিন অবধি তিনি থেকে গেলেন বিছানাতেই।
যাইহোক, ৭ বছর, ৪ বছর, আর ৪ মাসের তিন ছেলেকে নিয়ে শুরু হলো নতুন সংগ্রাম। এক কামরার একটা ঘরে ৫ জনের জীবন সংগ্রাম। ছোট ছেলেকে দেখা শোনার জন্য এবার লোক রাখতে হলো। কারণ তখন শম্পার জীবনের রোজনামচা ছিল ঠিক এরকম। ভোর বেলা মেজ ছেলেকে নিয়ে ১৩ কিমি দূরে নরেন্দ্রপুরে স্কুলে নিয়ে যাওয়া। স্কুলে পৌঁছে দিয়েই বাড়ি এসে রান্না করে বড় ছেলেকে খাইয়ে আবার সেই নরেন্দ্রপুরে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে মেজ ছেলেকে নিয়ে বাড়ি আসা। তারপর তাকে আর ছোট ছেলেকে খাইয়ে আবার নরেন্দ্রপুর বড় ছেলেকে আনতে যাওয়া। তাকে বাড়ি ছেড়ে গানের ক্লাস করে রাতে বাড়ি ফিরে আবার রান্না করে বাকিদের মুখে ভাত তুলে দেওয়া। ছেলেরা আর একটু বড় হলে নরেন্দ্রপুর মিশনে ভর্তির জন্য বিভিন্ন টিচারদের কাছে পড়াতে নিয়ে যাওয়া। কখনো বারুইপুর তো কখনো খড়দা। কখনো সোনারপুর তো কখনো গড়িয়া। এর সাথে আবার ছেলেদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বিষয়ে চর্চার জন্য সেখানেও নিয়ে যাওয়া। বেঙ্গল মিউসিক কলেজেই বড় ছেলের গান, মেজ ছেলের তবলা, ঢাকুরিয়ার অবন মহলে ছোট ছেলের নাটক। বিভিন্ন জায়গায় বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় নিয়ে যাওয়া। এরকম আরও হাজারটা কাজ, যা হয়তো গুনে শেষ করা যাবে না। না কোনো জায়গায় ঘুরতে যাওয়া, না কোনোদিন হোটেলে গিয়ে খাওয়া দাওয়া, না দামি শাড়ি বাড়ি গাড়ি নিয়ে মাথাব্যথা। কোনো অনুষ্ঠানে যেতে গেলে সোনার গয়না না থাকায় ইমিটেশন আর লিপস্টিকের বদলে সিঁদুর আর বোরোলিন মিশিয়ে ঠোঁট টাকে একটু লাল করা। আর এমনি সময় মেজ ছেলেকে পড়াতে নিয়ে যাবার পথে শিয়ালদহ স্টেশনে বসা হকারের থেকে কেনা ১ টাকা দামের কাঁচের দুল। তাও সেটা ছেলের জোরাজুরিতে কেনা। সিনেমা হলে যাওয়া শেষ বারের মতন ১৯৯১ সালে গুপী বাঘা ফিরে এলো। তারপর ২০১৪ সালে চতুস্কোন, তাও ভুল করে বেশি টিকিট কেটে ফেলার ফলে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়। ছেলেদের পড়াশোনা নিয়ে যখন দিন রাত প্রাণপাত করে চলেছে সে, ঠিক তখনই বেশ কিছু আত্মীয় স্বজনের চোখা চোখা শব্দবাণেও জর্জরিত হচ্ছে। চাকরি করে স্বামীর পাশে দাঁড়াতে না পারলেও অন্য ভাবে সব সময় ব্যয় সংকোচন করে গেছে। শিক্ষকদের অনুরোধ করে গুরুদক্ষিণা বা স্কুলের মাইনে কম করিয়েছে। শখের মধ্যে গান, তাও বন্ধ করে দিয়েছে। মন ভালো রাখতে শুধু গাছ লাগিয়েছে। ফুলের গাছ ফলের গাছ। ওগুলোই তখন তার সঙ্গী। এদিকে নারায়ণ তখন অফিসে ইউনিয়নের সেক্রেটারি। প্রচুর দায়িত্ব। তার সাথে পাড়ায় নাগরিক কমিটির সেক্রেটারি, ক্লাবের সেক্রেটারি। শনি রবিবার কদাচিৎ সময় বের করতে পারলে ছেলেদের পড়াতে নিয়ে যাওয়া বা স্কুলে নিয়ে যাওয়ায় সাহায্য করতে পারে। তিনটে সিজার অপারেশনের ধাক্কা সামলে, প্রয়োজনীয় পথ্য না পেয়ে এরকম অমানুষিক দৌড়াদৌড়ি তে শম্পার শরীর ক্রমশ ভাঙতে শুরু করলো। মুঠো মুঠো পেইন কিলার খেয়ে সব জায়গায় যাওয়া শুরু হলো। বড় ছেলেকে পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনে, মেজ আর ছোট ছেলেকে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি করতে পেরে যখন একটু শান্তিতে সময় কাটাবে বলে ভাবছে ঠিক তখনি ধরা পড়লো অস্ট্রিয় আর্থারাইটিস আর রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস। তার সূত্রপাত অবশ্য বেশ কিছু বছর আগে। মেজ ছেলে, ছোট ছেলে আর দেওরের মেয়ে সুপর্ণা কে নিয়ে রিকশা করে বিবেক নগরে আঁকা প্রতিযোগিতায় যাবার পথে চলন্ত রিকশা থেকে পরে যায়। পায়ের হার বেড়ে যায়। আর সাথে ওই দুখানি রোগের সূত্রপাত।
২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে মা শান্তিরানী দীর্ঘ ৪ বছর প্যারালাইসিস ও কথা বলতে না পারার থেকে মুক্তি লাভ করেন। মা চলে যাবার পর ভবানীপুরের বাড়ির প্রতি টানটাও কেমন আলগা হয়ে যায়। বিয়ের পর থেকে বাপের বাড়ি গিয়ে থাকার উদাহরণ খুবই কম ছিল আর মায়ের মৃত্যুর পর সেটা আরোও কমে যায়। বড় হয়ে যাবার পর ভাইদের মতাদর্শ আলাদা হয়ে যাবার ফলে তাঁদের সাথেও যোগাযোগ কমতে থাকে। ২০০৫ এর পর থেকে আস্তে আস্তে বিছানা নিতে শুরু করে। হাঁটাচলা বন্ধ। অমানুষিক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়ার শুরু। বাইরে বেরোনো বন্ধ। ডাক্তার দেখাতে গেলেও হুইল চেয়ার। বাড়ির সবাই বাইরে চলে গেলে একা একা বাড়ির মধ্যে গল্পের বই আর খবরের কাগজ পড়ে কাটিয়েছে। কারণ ২০০৬ এর আগে ঘরে টিভি আনতে পারেনি। তাও সেটাকে টিভি বলা চলেনা। মেজ ছেলের ইঞ্জিনিয়ারিং এর পড়ার জন্য এডুকেশন লোনে কেনা কম্পিউটার এ টিভি টিউনার কার্ড লাগিয়ে টিভি দেখা। ২০১২ সালে ঘরে টিভি আসে। এর আগে সন্ধ্যে বেলা পাড়ার কারো বাড়িতে একটু টিভি দেখতে গিয়েও শুনতে হয়েছে হাজার রকমের কথা। ইচ্ছে অনুযায়ী অনুষ্ঠান দেখা তো দূর কি বাত। পুজোর সময় সারা কলকাতা যখন উন্মাদনায় ফেটে পড়ে, সেই সময় সে ঘরে টিভিতে পুজো পরিক্রমা বা সিরিয়াল দেখে আর পুরোনো কাপড় জামা সেলাই করে বা বাগানের গাছের তুলো দিয়ে বালিশ বানিয়ে সময় কাটিয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে গৃহ বন্দী দশা। নিজের ভাই দিদি রা একে একে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে কিন্তু শেষ দেখা টুকু দেখতে যেতে পারেনি। পরিবারের কোনো অনুষ্ঠানেও যেতে পারেনি। ২০০৯ এ যখন একেবারেই শয্যাশায়ী তখন উপায়ান্তর না পেয়ে নারায়ণ ও তার তিন ছেলে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব দের থেকে ধার নিয়ে ২০১০ সালের জুলাই মাসে হাঁটু প্রতিস্থাপন অপারেশন করায়। তারপর চলে দীর্ঘ ফিজিওথেরাপি। হাঁটা চলা আগের থেকে অনেক ভালো হলেও সেই পুরোনো রোগেরা শরীর ছাড়েনা। ধীরে ধীরে শরীরের সব হার গুলো ক্ষয়ে যাওয়া শুরু হয়। সমস্ত দাঁত ফেলে নতুন দাঁত বাঁধাতে হয়। দিনে ২০ – ২২ টা করে ক্যাপসুল আর ইনজেকশনের ওপর এখন দিন চলছে। গোড়ালি অবধি লম্বা চুল এখন পিঠে এসে ঠেকেছে। বয়সের তুলনায় একটু বেশিই জুবুথুবু হয়ে গেছে সে। দিন দিন ওজন বেড়ে চলেছে। সারা শরীরে এতবার ছুরি কাঁচি চলার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে এসেছে। সারা দিনের সঙ্গী বলতে সেই ফুল ফলের গাছ, ঠাকুর পুজো আর বাংলা সিরিয়াল। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ব্যালেন্স রাখতে না পেরে সিঁড়িতে, ছাদে পড়ে গেছে। কিন্তু এখনও রান্নার দিদি না এলে রান্না করা, সবাইকে খেতে দেওয়া, বাড়ির লোকেদের জন্মদিনে পায়েস বানানো, শীতকালে পাটিসাপ্টা বানানো চলছে। শরীরের জোর কমে গেলেও মনের জোরে এগুলো চলছে আজও।
এতক্ষণ পড়ার পরে সবাই নিশ্চই ভাবছেন এত এত ভালো কথা লিখছি, খারাপ কি কিছু নেই। অবশ্যই আছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো নিজের প্রতি কনফিডেন্সের অভাব, সংসারের বাকি দিক গুলো নিয়ে অত্যন্ত উদাসীন আর নিজের আইডেন্টিটি তৈরী করতে অপারগ। হয়তো ছোট বেলা থেকেই অন্যের দেখভাল করতে করতে নিজের কথা ভাবাও যে উচিত সেটা মনে করেনি। নিজের প্রতি আস্থা না থাকায় সবার সামনে কথা বলতে গিয়ে এলোমেলো হয়ে গেছে, গুছিয়ে কথা বলতে পারেনি। নিজের চাহিদার কথা জোর গলায় বলতে পারেনি। আর চেপে রেখে রেখে যখন তা বেরিয়েছে তা সামনের লোকের জন্য কঠোর বা কর্কশ হয়ে উঠেছে। ছেলেদের পড়াশোনা আর গেরস্থালি সামলাতে গিয়ে কোনোদিন মাথাই ঘামায়নি কিভাবে ইলেক্ট্রিসিটি বিল, ট্যাক্সের বিল, ব্যাঙ্কের কাজ, পোস্ট অফিসের কাজ ইত্যাদি সামলাতে হয়। রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড কিভাবে বা কোথায় গেলে পাওয়া যাবে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা নেই। টিভি, ফ্রিজ, এসি এসবের জন্যই বা কাকে খবর দিতে হবে সেসবও ভাবতে যায়নি কখনো। আসলে নারায়ণ বা তার ছেলেরাই সেসব করে দিয়েছে। যথেষ্ট শিক্ষা থাকা সত্ত্বেও মোবাইল ফোন বা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করার প্রতি কোনো রকম ইচ্ছে প্রকাশও করেনি। আসলে সময়ের সাথে সাথে নিজেকে উপযোগী করে তোলেনি। আর তাই অন্যান্য ছিদ্রান্নেষী মানুষদের কটূক্তি হজম করেছে। তার হয়তো এই নিয়ে কোনো কিছু যায় আসেনা, কিন্তু তাঁকে যারা ভালোবাসে তাঁদের যে যায় আসে সেটা বুঝতে চায়নি কখনো।
এতক্ষনে নিশ্চয়ই সবাই বুঝে গেছেন আমি কার কথা বলছি। বা তার সাথে আমার কি পরিচয়। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, তিনি আমার মা। জন্মেরও আট মাস আগে থেকে তাঁর সাথে আমার পরিচয়। ছোটবেলা থেকেই আমি শুনে এসেছি আমি নাকি মায়ের দলে আর দাদা নাকি বাবার দলে আর ভাই নিউট্রাল। ছোটবেলায় সব বাচ্চা দের যেমন মায়ের সাথে যোগাযোগ থাকে আমারও তাই ছিল। কিন্তু তাও একটা আলাদা ব্যাপার ছিল সেই সম্পর্কে। তাই ভাইয়ের জন্মের সময় মা যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিল আমি কিছু খেতাম না, ইলেক্ট্রোল এর জল ছিল মূল খাদ্য। একা একা কাঁদতাম। বয়স কম থাকায় রোববার ছাড়া হাসপাতালে ঢোকার অনুমতি ছিল না, তাই প্রথম যেদিন গেলাম সেদিন লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে মায়ের বেডেই শুয়ে গেলাম। আর তারপর বাচ্চাদের রাখার ছোট দোলনাটাতে। ভাইকে পেয়ে আমার আনন্দ ছিল সবচেয়ে বেশি। আবার তার সাথেই যুক্ত হলো মাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। তাই ভাই একপাশে আমি এক পাশে মধ্যিখানে মা। মায়ের গায়ের ওপর একটা পা তুলে দিয়ে শোয়ার মজাটাই আলাদা ছিল। মায়ের সাথে স্কুলে যাওয়া, পড়তে যাওয়া, মায়ের গানের ক্লাসেও মায়ের সাথে যাওয়া, গোলপার্কের কালচারাল ইনস্টিটিউটে আঁকা শিখতে যাওয়া, সব জায়গাতেই মা। বাড়ির কাজে মাকে সাহায্য করতে পারলে খুব ভালো লাগতো। টিফিনের পয়সা থেকে কিছু টাকা জমিয়ে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ২ টাকা দামের কাঁচের দুল, কিংবা পুজোর সময় পাড়ার দোকান থেকে প্রথম লিপস্টিক কিনে দেওয়া, জোর করে সালোয়ার কিনতে বাধ্য করার মধ্যে একটা সীমাহীন আনন্দ ছিল। হাঁটতে না পারার সময় তিন ভাই মিলেই পালা করে হুইল চেয়ারে করে ঠাকুর দেখানোর মধ্যে কোনো ক্লান্তি ছিল না। মনের সব কিছু উজাড় করে কোনোদিন কিছু বলতে না পারলেও চুপচাপ পাশে বসে থেকে বা রাত্রে পাশে শুয়ে থেকেই মনে হতো আমি সম্পূর্ণ। এরপর মিশনের হোস্টেলে চলে গেলাম। সেখানেও তপন মহারাজ বলতেন – “এই চাটুজ্জে হলো গিয়ে ওর মায়ের ছেলে”। আসতে আসতে বড় হলাম। প্রাকৃতিক নিয়মেই ভালোবাসার সম্পর্কে জড়ালাম। মায়ের মনে হলো আমি বোধহয় মাকে ভুলে যাচ্ছি। কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না আমার মনের কথা গুলো। আর বয়ঃসন্ধির সময়ে আসতে আসতে তৈরী হলো দূরত্ব। কিন্তু কোনো দিনই চাইনি মাকে হারাতে। ভালোবাসার মানুষটার মধ্যেও মায়ের ছায়া খুঁজতে চেয়েছি। নিজের আইডেন্টিটি তৈরী করেই সম্পর্কে থাকতে চেয়েছি সবাইকে নিয়ে, একা একা নয়। যখন তা সম্ভব হয়নি বেড়িয়ে এসেছি সম্পর্ক থেকে। আসলে ছোটবেলায় বাবা মার মধ্যে ঝগড়া হলে কষ্ট হতো, খারাপ লাগতো, মায়ের কষ্ট করে বেঁচে থাকার কথা শুনে কান্না পেতো, তাই চাইনি আমার জীবনেও এরম কিছু ঘটুক। প্রথম বার চাকরি পেয়ে মায়ের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলেছিলাম নিজের মতো খরচ করো। কিন্তু সেটাও বাবা কে দিয়ে দিতে বলে। কারণ মার খরচ করবার কিছু নেই তো। বাবার পকেট থেকে কোনো দিনও একটা টাকাও নিতে দেখিনি। মাঝে মাঝে মনে হতো এতো নিরাসক্ত কেন? কেন কোনো চাহিদা নেই জীবনে? কেন নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্য ভাবলো না? তাই আগের বছর যখন নিজে মুখে বলল এবারে হায়দ্রাবাদ থেকে ফেরার পর আমায় একটা সোনার গয়না কিনে দিস তো সেদিন মনে হলো আমার চাকরি করা সার্থক। ছোটবেলার বেশিরভাগটাই হোস্টেলে কাটানো আর তার পর কলেজ অফিস ফিল্মের কাজে জড়িয়ে থাকায় মায়ের সাথে কাটানো সময় ছিল খুবই কম। তাই ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে মাকে আমার সাথে হায়দ্রাবাদে নিয়ে আসি। মা প্রথম বার প্লেন চড়ে। সে এক মিষ্টি অভিজ্ঞতা। তারপর একসাথে সিনেমা দেখি, রেস্ট্ররেন্টে খাই, বাড়িতে একসাথে রান্না করি, ঘর পরিষ্কার করি, একদিনের জন্য গোয়া যাই একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের প্রাইজ আনতে। মানে ওই সময়টা শুধু আমি আর মা, মা আর আমি। হায়দ্রাবাদে কাটানো ওই কটা দিনের স্মৃতি আমার সেরা কিছু স্মৃতির মধ্যে অন্যতম।
অনেক কে বলতে শুনি তাদের মা নাকি তাদের বন্ধু, সব কিছু শেয়ার করতে পারে। জড়িয়ে ধরে আহ্লাদীপনা করতে পারে। কিন্তু কেন জানি না, আমি সেভাবে ভাবতে পারিনি কোনোদিন। আমার কাছে মা হলো খুব আদরের, ভালোবাসার, সম্মানের আর সর্বোপরি শ্রদ্ধার জায়গা। তাই সেখানে আমি কোনোদিনও বন্ধু হতে পারিনি। বরাবরের চাপা স্বভাবের হওয়ার কারণে কোনোদিনও মনের কথা গুলো বলতে পারিনি, কিন্তু বাড়ি ফিরে মায়ের খোঁজ করেছি। চুপচাপ কিছু না বলে পাশে বসে থেকেও মনে হয়েছে কত কথা বলা হলো। ভাই যখন মাকে জড়িয়ে ধরে গালের মধ্যে গালটা ঘষে বা নাকের সাথে নাক লাগিয়ে মজা করে আমার মনটা ভরে যায়। আমিও ওদের দুজন কে একসাথে জড়িয়ে ধরে আনন্দ পাই। কত লোক বলে একা একা থাকিস মায়ের জন্য মন খারাপ করেনা? আমি বলি না। কারণ আমি চোখ তা বন্ধ করলেই ওদের দেখতে পাই। সব সময় মনে হয় ওরা আমার চার পাশেই আছে, টিভি দেখছে, গল্প করছে, রান্না করছে, কথা বলছে। তাই আমার হায়দ্রাবাদের তিন কামরার ফ্ল্যাটে একা লাগে না। পুজোর দিন গুলো বা অন্যান্য দিন গুলো মা একা একা কিভাবে কাটাতো সেটা অনুধাবন করে মনের জোর পাই। মায়ের জন্য হয়তো সত্যিই কিছু করতে পারিনি, কিন্তু চেষ্টা করেছি। খুব ছোট বেলায় ঘুম থেকে উঠে একদিন যখন দেখলাম মা পেট ব্যাথায় কাতরাচ্ছে আমিও কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিলাম, কারণ জানি না। গভীর ঘুমে থাকা কালীন আচমকা কে যে সেদিন ধাক্কা দিয়ে ডেকে দিয়েছিলো বুঝিনি, যেদিন মা প্রথম সিঁড়ি থেকে পরে গেলো। ২ লাফে ঘর থেকে ছাদের সিঁড়ি তে গিয়ে একা মাকে কোলে তুলে নিয়ে এসেছিলাম। আমার গায়ে এত শক্তি তার আগে জানতামই না। ২০০৯ সালে যেদিন আমাদের বন্ধু অরুনাংশু জলে ভেসে যায় সেদিন মাকে জড়িয়ে খুব কেঁদেছিলাম। আগের বছর হায়দ্রাবাদে একদিন সকালে যখন সন্দেশের মুখে শুনি ওর বৌদি পরে গিয়ে মিসক্যারেজ হয়ে গেছে সেদিনও মাকে জড়িয়ে কেঁদেছিলাম। ২০১৬ সালের ২রা আগস্ট সৌদি যাবার প্লেন ধরতে গেলে মা কেঁদে ফেলে, আমি অনেক কষ্ট করে সংযত ছিলাম। এখন রোজ রোজ হয়তো কথা হয়না। কি রান্না করলাম বা কি খাবার কিনে আনলাম তা বলা হয়না, শরীর খারাপের খোঁজও নেওয়া হয়না, কিন্তু আমি জানি আমার পাশে মা ছিল, আছে, থাকবে। কোনোদিন যেটা করিনি বা করতে পারিনি আজ সেটা এই লেখার মাধ্যমে বলতে চাই, মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে চাই – “মা, তোমায় অন্তর থেকে ভালোবাসি, মুখে বলতে পারিনি কোনোদিন, চিন্তা করোনা, আমি আছি তোমার পাশে।”
ছবির সৌজন্যে: Arindam Chattopadhyay ও Narayan Kumar Chattopadhyay
Leave a Reply