ইংরেজ অধিকৃত দেশমাতাকে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত করার মানসে সাধারণের চেতনা যখন নানাভাবে পথের অনুসন্ধান করছে , তাদের শক্তিকে কাজে লাগাতে ,সঠিক পথ দেখাতে , গড়ে উঠে যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতি নামে দুটি প্রতিষ্ঠান । দুটি সমিতিই ছিল গোপন দুটি বিপ্লবী গোষ্ঠীর আড্ডা-স্থল । এই সমিতিগলো সাধারণ কুস্তীর আখড়ার আড়ালে নিজেদের গোপন কাজ করতো ।
যুগান্তরের কিছু সদস্য ধৃত হয়ে ফাঁসিতে প্রাণ দিয়েছিল আর কিছু সদস্য যাবজ্জীবন দণ্ডিত হয়ে আন্দামানের সেলুলার জেলে প্রেরিত হয়েছিলেন ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সেলুলার জেলের অনেক রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হলে তাঁরা আবার নতুন করে তাঁদের রাজনৈতিক জীবন শুরু করার সুযোগ পান । তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন উল্লাসকর দত্ত । উল্লাসকর দত্তের লেখা ‘আমার কারাজীবনী’ গ্রন্থের সম্পাদক নরেন্দ্র্চন্দ্র দত্ত লিখেছেন ‘চেনা বামুনের পৈতার দরকার নাই’ । উল্লাসকরের পরিচয় অনাবশ্যক । আলীপুরের বোমার মামলার ফাঁসির দায় মাথায় লইয়া যে উল্লাসকর স্বীয় স্বভাবসুলভ সরলতা , অনাবিল হাস্যকৌতুক ও মর্মস্পর্শী রাগ-রাগিনীতে ফৌজদারী আদালতের কঠোরতা ও নির্মমতা সাময়িকভাবে বিদূরিত করিয়াছিল, যে উল্লাসকরের নির্ভীকতা ও সত্যবাদিতা সাধারণের প্রাণে এক অনির্বচনীয় উচ্চনৈতিক ভাবের সঞ্চার করিয়াছিল এবং যে উল্লাসকরের অকৃত্রিম স্বদেশপ্রেম এই প্রাণহীন দেশেও এক অভিনব ভাবের বন্যা প্রবাহিত করিয়াছিল, সেই উল্লাসকর আজ তাহার কারা-জীবনী লইয়া পাঠকবর্গের সমক্ষে উপস্থিত’।
উল্লাসকরের জন্ম বর্তমানের বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কালিকাছায় হয়েছিল । তাঁর পিতা দ্বিজদাস দত্তগুপ্ত ব্রাহ্মসমাজের সদস্য ছিলেন । ১৯০৩সালে এন্ট্রান্স পাশ করে তিনি কলিকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন । সেই সময় ভারতের ইংরেজরা ভারতীয়দের অবজ্ঞা করতো এবং ভারতীয়দের সম্পর্কে ঘৃণ্য মন্তব্য করতে দ্বিধা করতোনা কারণ ইংরেজ শাসনে কোনপ্রকার শাস্তির ভয় তাদের ছিলনা । কিন্ত্ত প্রেসিডেন্সি কলেজের একজন ইংরেজ শিক্ষক প্রোফেসার রাসেল বাঙালিদের সম্বন্ধ অশিষ্ট উক্তি করলে উল্লাসকর তাকে শারিরিক আঘাত করেন আর সেই কারণে তাকে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয় ।
এই ঘটনা সম্বন্ধে উল্লাসকর তাঁর লিখিত ‘আমার কারাজীবন’ বইটিতে লিখেছেন ‘ইতিমধ্যে Bengal partition লইয়া সমগ্র বঙ্গদেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন উপস্থিত । আমাদেরও অন্তরাত্মা যেন এইসময়ে স্বদেশ-প্রেমের এক অপূর্ব আস্বাদন লাভ করিয়া দিন দিন আপন অকিঞ্চিৎকরতার নগণ্যতা ভুলিয়া গিয়া , জীবনের সর্বাঙ্গীন সার্থকতা লাভের জন্য একটি বিশেষ লক্ষের দিকে অগ্রসর হইতে চাহিল ।ইতিমধ্যে কলিকাতা university report এ Prof.Russel কলিকাতা ছাত্রবৃন্দের প্রতি এক কুৎসিত দোষারোপ করায় তাহার বিরুদ্ধে কয়েকটি সভা আহুত হয় এবং সকলেই তথায় Russel সাহেবকে যথেষ্ট ভর্ৎসনা করেন । আমি ও তখন একবার এফ.এ.পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হইয়া দ্বিতীয়বার Presidency College এ পড়িতেছি । ঐসকল আলোচনা গবেষণার পর এমন একটি ব্যাপার ঘটল যার জন্য আমাকে আর Presidency Collegeএ পড়িতে হইলনা, একেবারে সোজা চম্পট দিতে বাধ্য হইলাম এবং Bombay Victoria Technical Institute এ গিয়া Textile class এ প্রথম বার্ষিক শ্রেণীতে কিছুদিন অধ্যয়নান্তে ছুটীতে একবার বাড়ী আসিলাম ।
ঠিক সেই সময়েই বরিশাল প্রাদেশিক সমিতির অধিবেশন, এতদুপলক্ষে আমিও তথায় হাজির । সেখানে পুলিস কর্তৃপক্ষের কাণ্ড-কারখানা অবশ্য অনেকেই অবগত আছেন । বলা বাহুল্য অধমের প্রতি ও পুলিশ regulation লাঠির এক ঘা কৃপা করিতে বিস্মৃত হন নাই । চিত্তরঞ্জন প্রভৃতির প্রতি যা অমানুষিক অত্যাচার হইল তাহাতো স্বচক্ষেই দেখিলাম । ইত্যাদি কারণে মনের অবস্থা ক্রমশঃই একটা দৃঢ় নিশ্চয়ের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল । আমাদের অপরিণত মস্তিষ্কের চিন্তা-স্রোতকে পরিণত ও বিশিষ্ট আকার দান করিবার পক্ষে প্রধান সহায় পাইলাম তৎকালীন সদ্য -প্রবর্তিত যুগান্তর পত্রিকা । স্বদেশী আন্দোলন প্রবর্তিত হইবার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত কাব্য, সাহিত্য অথবা চিন্তাশীল -গবেষণাপূর্ণ রচনা কিছুরই আস্বাদন পাই নাই ।………..বঙ্কিমচন্দ্রের অনুশীলন ও ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি কয়েকখানি বই পড়িয়া পড়ার ভিতরেও যে একটা প্রাণ মাতানো জিনিষ কিছু আছে তাহা এই প্রথম অনুভব করিলাম । এতদ্ব্যতীত বিপিনবাবুর তখনকার বক্তৃতা ও রবিবাবুর স্বদেশী আন্দোলন সংক্রান্ত গান আমাদিগের যুবক হৃদয়ে এক নূতন উন্মাদনা আনিয়া দিল যাহার ফলে স্বদেশকে এক নতুন চক্ষে দেখিতে শিখিলাম’ ।
তিনি দেখিলেন যে শিবপুরে থাকিয়া explosive manufacture বিষয়ে নানাপ্রকার experiment ইত্যাদির চমৎকার সুযোগ আছে । কলেজ লাইব্রেরীতে যথেষ্ট বই পাওয়া যাবে আর laboratoryতে chemicalএর ও অভাব হবেনা । যদি তিনি দুই একটা experiment এ সফল হতে পারেন তাহলে দেশের গুপ্তদলগুলির সভ্য শ্রেণীভুক্ত হয়ে কাজ করতে পারবেন । বোম বানানোয় পারদর্শী হয়ে তিনি যুগান্তর পার্টিতে যোগদান করেন । ক্ষুদিরাম বোস ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে মারার উদ্দেশ্যে যে বোমাটি ছুড়েছিলেন সেটি উল্লাসকর ও হেমচন্দ্র দাস প্রস্ত্তত করেছিলেন ।
পুলিস অভিরূপ ছদ্মনামধারী উল্লাসকরকে মুরারীপুকুর বাগানের গুপ্তস্থান থেকে গ্রেপ্তার করে । পুলিস মানিকতলার গোপন অস্ত্র প্রস্ত্ততের জায়গাটিও খোঁজে বের করতে সমর্থ হয় এবং ডিটেক্টিব অনুসন্ধানে জানতে পারে- যে বোমটি ক্ষুদিরাম ব্যবহার করেছিলেন সেটি উল্লাসকরের বানানো ।আলিপুর বোমা মামলায় ক্ষুদিরাম, বারীন ঘোষ ও তাঁকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয় ।(১৯০৯খ্রীঃ) ।পরে এ্যাপীল করা হলে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে আন্দামানে পাঠানো হয় ।
‘নির্বাসন ও কারাবাস বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও অপরাপর সকলের সহিত একরূপ নহে ।…..আমার কারাজীবনের সাধারন লৌকিক ঘটনবলীর ভিতর দিয়া অতিলৌকিক এমনই কতকগুলি ঘটনার সমাবেশ হইতে থাকে , যে যদি সম্পূর্ণ দ্বাদশবর্ষব্যাপী ঘটনাবলীর একটি চিত্র মানসপটে অঙ্কিত করি , দেখিতে পাই যে সেই অতিলৌকিক ব্যাপারগুলিই প্রায় সবস্থান অধিকার করিয়া বসিয়া আছে’ ।
কালাপানি চালান হওয়ার পর সেখানকার সেন্ট্রাল জেলে প্রায় আড়াই বৎসরের অধিককাল তাঁকে আবদ্ধ রাখা হয় । শুধু তাই নয় জেলের যেসমস্থ কাজ সবচেয়ে কঠিন পরিশ্রমের তাঁদের জন্য তারই ব্যবস্থা হইল । কিছুকাল পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল port mowat এ । সেখানে সাধারণ কয়েদীদের সংগে তাঁকে ও পাথর ভাঙ্গা, রাস্তা দুম্মুট , লাকরি কামান ইত্যাদি কাজ দেওয়া হয় । কিছুদিন পর তাঁকে dundas I’t নামক জায়গায় পাঠানো হয় । সেখানেও তাঁকে ইটা কামানে(brick field)ভর্তি করা হয় । ইটা কামানের পর তিনি শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতে অস্বীকার করলে তাঁর বিচার হয় এবং তাঁকে তিনমাসের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে সেলুলার জেলে পাঠানো হয় ।
আন্দামান দ্বীপের এই কুখ্যাত সেলুলার জেলের কাজ শুরু হয়েছিল ১৮৯৬ এবং শেষ হয়েছিল ১৯০৬ এ । ভারতের ইংরেজ শাসকরা অবশ্য আন্দামান দ্বীপকে শাস্তি দেবার স্থান হিসেবে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিণামের সংগে সংগেই ব্যবহার করতে শুরু করেছিল । মোগল রাজবংশের সবাই ছাড়া ও যারাই কোনভাবে পত্রালাপে বাহাদুর শাহ জাফরের সংগে যোগাযোগ করেছে , তাদের প্রত্যেককেই আন্দামান দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে । সেলুলার জেলের সাতটি বিভাগে ৬৯৩টি ক্ষুদ্রকক্ষ বা cell ছিল । প্রত্যেক কক্ষ ৪.৫ মিটারও ২.৭ মিটার ছিল । আর ৩ মিটার উপরে ছিল একটি ভেন্টিলেটর । কক্ষগুলি এমন ভাবে প্রস্ত্তত ছিল যে এককক্ষ থেকে অন্যকক্ষের পিছনদিক শুধু নজরে আসত । বন্দীদের মধ্যে যোগাযোগ অসম্ভব ছিল । তাদেরে একাকী নিঃসঙ্গ জীবন ভোগ করতে হতো । তাদের উপর অকথ্য অত্যাচারও চালানো হতো ।
সেলুলার জেলে থাকাকালীন উল্লাসকর এখানকার নৃশংস জেলারের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে কিছুদিন সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ছিলেন । ক্রমে শারীরিক সুস্থ হয়ে উঠলে ও তিনি এক ভ্রান্তির রাজ্যে বাস করছিলেন-চারদিকে আত্মীয়স্বজনবর্গের আর্তনাদ ও কাতরধ্বনি শুনতে পেতেন । একসময় আত্মসংযম হারিয় তিনি ফাঁসি লাগাতে উদ্যত হলে তাঁর অতিলৌকিক দর্শনই তাঁকে রক্ষা করে ।তিনি অপর এক কয়েদীকে তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আত্মহত্যা থেকে বিরত হন । সহৃদয় superintendent তখন তাঁকে lunatic asylum এ প্রেরণ করেন যাতে তাঁকে শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতে না হয় ।
‘তখনও আমার মধ্যে মধ্যে কম্প দিয়া জ্বর আসিত ও ভয়ানক spasms হইত এমনকি একএকসময় দেয়ালে মাথা খুঁড়িতাম । জ্বর যখন খুব অধিক হয় ,নানাপ্রকার স্বপ্নচিত্র দেখিতাম । জিজ্ঞাসা করিলে বলিলাম -এক এক সময় মনে হয় যেন সমস্ত পৃথিবী ধ্বংসের পথে চলিয়াছ । শুনিয়া director সাহেব বলিলেন ‘কতকটা ঠিক, শীঘ্রই Europe এ এক মহাযুদ্ধের আয়োজন হইবে’ ।…….একমাসের মধ্যেই আমার transfer এর হুকুম আসিল ও আমাকে মাদ্রাজ চালান দেওয়া হইল’ ।
মাদ্রাজেও তাঁকে lunatic asylum এ থাকার সুবিধা দেওয়া হয় । সেখানেও তাঁর অতিলৌকিক দর্শন চলতে থাকে । কিছুদিন পর তাঁর মা বাবা এসে তাঁর সংগে দেখা করেন । এখানে প্রথমে তাঁতশালায় ও পরে চাটাই বোনার কাজ শুরু করেন । মাদ্রাজ জেলে lunatic ward এ চাটাই বোনার কাজ করার সময় তিনি তালপাতা লইয়া নাড়াচাড়া করতে করতে বেশ একপ্রকার চটিজুতা প্রস্ত্তত করেন এবং নগ্নপায়ে চলার কষ্ট নিবারণ করেন । তিনি লিখেছেন ‘-মনে আছে এই উপলক্ষ্যে তখন একটি দুলাইন গান পর্যন্ত রচনা করিয়া ফেলিয়াছিলাম ও তালপাতার কাজ করিবার সময় বাউল সুরে বুনানির তালে তালে ঐ লাইনদুটি গাহিয়া আমোদ উপভোগ করিতাম -‘আমার তালের পাতা ও আমার তালের পাতা’
তোমার পাতায় চটি বুনি, তোমার পাতায় চাটাই বুনি
তোমার পাতায় পাখা বুনি ,টুপি বুনি, খলতে বুনি , তালের পাতা’ ।
‘আমার কারাজীবনীতে’ সেই সময়ে তাঁর মানসিক অসামঞ্জস্য প্রসংগে তিনি লিখেছেন ‘তখন আমার এমনই একটি অবস্থা যে সেই সময় পশু,পক্ষী ,কীট-পতংগ ,এমনকি বৃক্ষলতাদিতে পর্যন্ত এমনই এক অদ্ভুত চৈতন্যশক্তির খেলা দেখিতে পাইতাম , যে চোখ মেলিয়া চাহিলেই সেই সর্বব্যাপী চৈতন্য আমাকে চারিদিক হইতে ঘিরিয়া ফেলিত’ ।
দীর্ঘ বারো বৎসর কারাবাসের পর যখন তিনি শরীর ও মনে পুরো অবসন্ন হয়ে আসন্ন মৃত্যুর অপেক্ষায় সেইসময়ই তাঁর মুক্তির আদেশ হয় (১৯২০) ও তাঁকে কলিকাতার জেলে নিয়ে আসা হয় ।’gate এ আসিয়াই দেখিলাম বাবা আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন , এতদিনের পর এই শুভ সুযোগ লাভ করিয়া আমাদের উভয়ের মনে যে আনন্দের উদয় হইল তাহা আর বোধহয় কাহাকেও বলিয়া বুঝাইতে হইবেনা’ ।
১৯৩১ এ তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং আঠারো মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয় । ১৯৪৭ এ ব্রিটিশ রাজত্ব সমাপ্ত হওয়া পর তিনি জন্মস্থান কালিকাছায় যান এবং দীর্ঘ দশ বৎসর একাকীত্বের জীবন কাটিয়ে কলিকাতায় ফিরে আসেন । সেখানে তিনি শারীরিকভাব অক্ষম এক মহিলাকে বিয়ে করে আসামের কাছাড় জিলার শিলচরে চলে যান ও জীবনের বাকী সময়কাল সেখানেই কাটান ।১৯৬৫ সালের ১৭ মে তাঁর মৃত্যু হয় ।
————করবী বাগচী ——
Leave a Reply