“আমি নেই,আমি নেই — ভাবতেই ব্যথায় ব্যথায় মন ভরে যায়–যেই ভাবি আর কোন খানে নেই ———-”
সুভাষ চন্দ্র দাশ ,ক্যানিং — ১৯২৯ সালের ৪ ঠা আগষ্ট ভোর চারটের সময় ভারতমাতার মুখে হাসি ফোটাতে গৌরী দেবীর কোলে ভূমিষ্ঠ হন তিনি। পিতা কুঞ্জলাল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন বিখ্যাত আইনজীবি,বড়দাদা অশোক কুমার ছিলেন ভারতীয় চলচিত্র জগতের যুগপুরুষ,মেজদাদা অনুপ কুমার ছিলেন হিন্দি চলচিত্র জগতের কৌতুক অভিনেতা,দিদি সতী দেবী ছিলেন গায়িকা এবং সর্বকনিষ্ঠ আভাস কুমার ওরফে কিশোর কুমার গাঙ্গুলী।
পিতা-মাতা ছিলেন সঙ্গীতানুরাগী। সেই সুত্রে এক বোন ও তিন ভাই-ই সঙ্গীত জগতে প্রতি বিশেষ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়।বড়দা দাদামণি যখন হিন্দি চলচিত্র জগতের নায়ক হয়ে উঠেছেন,ঠিক তখন আভাষ কুমার নিতান্তই কিশোর।
বাড়ীতে সঙ্গীত এবং অভিনয়ের পরিবেশ পেয়ে আভাস নেহাতই সঙ্গীতানুরাগী হয়ে ওঠেন। তার একটা বড় গুণ ছিল ছোটবেলা থেকেই যে গান একবার শুনতেন,তার সুর গেঁথে থাকতো তাঁর মনের মধ্যে। পরে তা হু-বহু গাইতেন।বলা বাহুল্য আর সেই কারণেই কিশোর বয়সেই নিজেকে তৈরী করতে পেরেছিলেন আভাস কুমার। ঘরোয়া জলসায় গান গেয়ে তার পিতার বন্ধুদের কাছ থেকে অজস্র পুরষ্কার পেতেন।দাদামণির হাত ধরেই একদিন চলে আসেন তৎকালীন বোম্বাই-তে। নয়ন ভরা স্বপ্ন ——-কিন্তু কি ভাবে বড় গায়ক হওয়া যায়। বহু ঝড়,বাধা বিপত্তি চড়াই উৎরাই পথ অতিক্রম করে নিজের স্বপ্ন কে প্রথম পাওয়া যায় একটি পাঞ্জাবি দ্বিভাষিক ছবিতে। সেটির হিন্দি নাম ছিল ‘গাঁও কী গোরী’।
ছবিটির সুরকার ছিলেন শ্যাম সুন্দর। এরপর একাধিক হিন্দি ছবিতে তিনি কোরাস গায়ক হিসাবে কন্ঠ দিয়েছিলেন। তারপর কিশোর কুমারের জীবনে স্বর্গদূত হয়ে নেমে আসেন নৌসাদ। নৌসাদের সুরে তিনি ‘প্যাহলে আপ’ ছবিতে দ্বৈত সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ছবিটি দারুণ হিট করায় তাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। । তার স্বপ্নের গায়ক কে কুন্দনলাল সায়গল (কে এল সায়গল)এর সাথে দ্বৈত সঙ্গীত পরিবেশন করলেন ‘শাহজাহান’ ছবিতে। এমন কি নৌসাদের সুরে ‘মেরে স্বপ্ন কি রাণী’ ও দারুণ হিট করে। সেই থেকেই কিশোর কুমারের পায়ের তলার ভিত শক্ত হতে শুরু করে।হিন্দীতে মোট ২৬৪৮ টি এবং বাংলায় মোট ১৫৪ টি গান গেয়েছিলেন কিশোর কুমার। হিন্দী ও বাংলার পর গুজরাটী ভাষায় তাঁর গান ছিল ৮টি। সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে মোট ১৬ টি ছবিতে সুর করেছিলেন। তাঁর সুরে প্রথম ছবি হঢ় ‘ঝুমুর’(১৯৬১)। নৌসাদ,ফিরোজ নাজমি,পিনায়ার,শচীদেব বর্মন থেকে রাহুল বর্মন কিংবা বাপ্পী লাহিড়ীর সুরেও তিনি একাধিক জনপ্রিয় গান গেয়েছেন। সুরকারদের মধ্যে শচীনদেব বর্মন এর সাথে তাঁর সখ্যতা ছিল মধুর। শচীন কর্তার সুরে প্রথম গান করেনর ‘নওজওয়ান’ ছবিতে। তারপর একে একে ‘জাল’ ,‘মুনিমজি’ ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ , ‘ফান্টুস’ , ‘ন-দো-এগারা’ , ‘কালাপাণি’ সহ প্রভৃতি ছবিতে অসাধারণ গানে মাতিয়ে দিয়েছেন। শচীন দেবের সুরে কিশোর কুমারের শেষ গান ‘মিলি’ ও ‘অভিমান’ ছবিতে। অন্যদিকে রাহুল দেবের সুরে ৫৫৮ টি গান গেয়েছেন কিশোর কুমার। গান গুলির মধ্যে একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন ২৪২ টি তে। রাহুলবেব বর্মন এর সুরে প্রথম গান করেন ‘ভুত বাংলো’ ছবিতে। ১০২ টি হিন্দি ছবি ও ৪টি বাংলা ছবিতে অভিনয়ও করেন কিশোর কুমার। অভিনেতা হিসাবে তাঁর প্রথম ছবি ‘শিকারি’(১৯৪৭)।জানা যায় “নায়ক হিসাবে প্রথম ছবি ‘সতী বিজয়’(১৯৪৮)। দাদা অশোক কুমারের সাহায্যে বম্বে টকিজের ‘জিদ্দি’ ছবিতে সর্বপ্রথম অভিনয় করেন। এবং নায়ক হিসাবে প্রথম ছবি ‘আন্দোলন’(১৯৫১)” এই তথ্যটি সম্পূর্ণ ভূল।
তাঁর প্রথম অভিনিত বাংলা ছবি হল কমল মজুদারের পরিচালনায় এবং স্বয়ং কিশোর কুমার প্রযোজিত ‘লুকোচুরি’(১৯৫৮)।
ছোট বেলাতেই কিশোর কুমারের মধ্যে একটা খামখেয়ালিপন ছিল। তাঁর এই খামখেয়ালিপনার জন্যই বেশি গান তিনি করেন নি। রুমাগুহ ঠাকুরতা কে ১৯৫১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী বিয়ে করেন। সেই সুত্রে সত্যজিৎ রায় কিশোর কুমারের মামা শ্বশুর হন।সত্যজিৎ রায় চেয়েছিলেন তার ‘পরশপাথর’ ছবিতে (১৯৫৭) তুলসি চক্রবর্তীর ভূমিকায় এবং ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ (১৯৬৮) ছবিতে গুপীর চরিত্রে অভিনয় করাতে। কিন্তু কিশোর তাঁ খামখেয়ালিপনা খেপামির জন্য অভিনয় করতে রাজী হননি।অবশ্য ‘চারুলতা’(১৯৬৪) ‘আমি চিনি গো চিনি ——’ রবীন্দ্র সঙ্গীতটি কিশোর কুমার কে দিয়ে গাওয়াতে সক্ষম হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। আশ্চর্যের বিষয় শক্তি সামন্তের ’অমানুষ’ ছবিতে ‘কি আশায় বাঁধি খেলাঘর—–’ ‘আনন্দ আশ্রম’ ছবিতে ‘আশা ছিল ভালোবাসা ছিল’ , ‘মুকাদ্দর কি সিকান্দর’ ছবির ‘সলামি ইস্ক —’ এই গান গুলি তিনি প্রথমে গাইতে চাননি। পরে অবশ্য মাথা খ্যাপামি থেকে ভুত নামে।এবং প্রতিটি গানই অসম্ভব রকম জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি ভীষণ রসিক মজার মানুষ ছিলেন। একবার এক জলসায় কিশোর কুমার গান গাইতে গিয়ে তাঁর সহকারীর কাছে জানতে পারেন দাদামণির সঙ্গে তাঁদের (আহ্বায়কদের)বেশ খাতির থাকায় তাঁরা অর্ধেক জায়গা দিয়েছেন। কিশোর কুমার এ বিষয়ে কাউকে কিছু আগাম না জানিয়ে আড়াই খানা গান গেয়েমঞ্চ থেকে নেমে পড়েন। সকলে হতবাক হয়েই কি ব্যাপার জিঞ্জাসা করায় ,কিশোর কুমার মুচকি হেসে বলেন “বাকি গান দাদামণি কে দিয়ে গাইয়ে নেবেন”।
১৯৮২ সালের পর আর তিনি অভিনয় করেন নি। সম্পুর্ণ ভাবে আত্ম নিয়োগ করেছিলেন সঙ্গীতে। তাঁর অভিনীত সর্বশেষ ছবি ’চুর বাদি যো মেকহী’(১৯৮২)। ছবিটি ছিল তাঁর নিজেরই প্রযোজিত,পরিচালিত,সুরারোপিত এবং অভিনিত। বিশেষ উল্লেখ্য নিজে সঙ্গীত পরিচালক হয়ে ওতিনি কোন গান করেন নি।অন্যদিকে আমরা প্রায় সকলেই জানি মহম্মদ রফির পতনের সূচনা ‘আরাধনা’ ছবি থেকেই। এর চার বছর আগে কিশোর কুমার মহম্মদ রফি কে ছাপিয়ে ‘গাইড’ ছবিতে ‘গাতা রহে মেরে দিল—–’ গানটি গেয়ে। আসলে কিশোর কুমারের অন্যতম পজিটিভ দিকটা হল তৎকালীন নায়কের গলাতেই অনবদ্য অসাধারণ ছিলেন তিনি।রাজেশ খান্না,দেব আনন্দ,অভিতাভ,ধর্মেন্দ্র,জীতেন্দ্র,মিঠুন,মহা নায়ক উত্তম কুমার থেকে শুরু করে আজকের সঞ্জয় দত্ত,অনিল কাপুর,গোবিন্দা সকলেরই সঙ্গেই তিনি একাত্ম হতে পেরেছিলেন। তাই তো এঁদের সকলের কাছে তিনি একজন আদর্শ গায়ক। আধুনিক গান যেমন গেয়েছেন,তেমনই গেয়েছেন সিনেমার গানও।
আবার ‘শিং নেই নাম তার সিংহ, র মতো রক অ্যান্ড রোল মার্কা গানেও সমান ভাবে সফল তিনি। তাই তিনি একজন সার্থক শিল্পী ।
সঙ্গীত শিল্পী কিশোর কুমারের চার চার টি অদ্ভূত কাহিনী আজও বিদ্যমান। তাঁর জন্ম ৪ ঠা আগষ্ট ৪ টের সময়। তিনি চলচিত্র জীবনে ৪ টি বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন,এমন কি ৪ টি বিয়েও করেছেন(রুমা গুহঠাকুরতা ১৯৫১-১৯৫৮, মধুবালা ১৯৬০-১৯৬৯, যোগীতাবালি ১৯৭৬-১৯৭৮, লীনা চন্দ্রভারকর১৯৮০-১৯৮৭)।
তিনি সঙ্গীত জীবনে বাংলা,হিন্দী,মারাঠী,অসমীয়া,গুজরাটী,কন্নড়,ভোজপুরি,উর্দু,উড়িয়া ও মালয়ালম ভাষায় গান গেয়েছেন।নেপথ্য গায়কের জন্য তিনি ৮ বার ফিল্ম ফেয়ার পুরষ্কার পেয়েছেন এবং একই বিভাগে সর্বোচ্চ ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার পেয়ে রেকর্ড করেছেন। একদিকে গীতিকার,সুরকার,অভিনেতা,নায়ক,পরিচালক,প্রযোজক,কাহিনীকার ও চিত্রনাট্যকার সব কিছুই ছিল তাঁর সহজজাত। এমন বহুমুখী প্রতিভার অন্য কোন শিল্পীর মধ্যে দেখা যায়নি। তারঁ তুলনা তিনি নিজেই।
তাঁর সেই অনবদ্য গান “আমি নেই,আমি নেই — ভাবতেই ব্যথায় ব্যথায় মন ভরে যায়–যেই ভাবি আর কোন খানে নেই ———-” তিনি এমন গান গাইলেও আজও তিনি প্রতিটি ভারতবাসী তথা বাঙালীর মনে এক বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছেন।
আজ তাঁর ৯১ তম জন্ম দিবস স্মরণ করে রইলো বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য।