বাংলার প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট কাদম্বিনী দেবী :: কালিপদ চক্রবর্তী ।।।

0
154

বাংলার প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট এবং মহিলা চিকিৎসা-জীবী হলেন কাদম্বিনী দেবী। তিনি ১৮৬১ সালের ১৮ই জুলাই জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯২৩ সালের ৩রা অক্টোবর ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর পিতা ব্রজকিশোর বসু ছিলেন নারী শিক্ষার একজন অত্যুৎসাহী সমর্থক। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নারীশিক্ষা নিয়ে বাংলা ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যদের মধ্যে এক তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। কেশব চন্দ্র সেন নারীদের উচ্চশিক্ষার বিরোধী হওয়ায় শিবনাথ শাস্ত্রী, দুর্গামোহন দাস, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীসহ অন্যান্য প্রগতিবাদী ব্রাহ্ম সদস্যরা তাঁর সমালোচনা করেন। এমনকি অনেক বিশিষ্ট ব্রাহ্ম পরিবার কেশব সেনের গোষ্ঠী ত্যাগ করে ১৮৭৬ সালে ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’ গঠন করেন। এই গোষ্ঠীর সদস্যরাই পরবর্তীকালে উপযোগবাদী অ্যানেট অ্যাক্রয়েড-এর সঙ্গে ‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছিলেন এবং ১৮৭৮ সালে এই বিদ্যালয়টি বেথুন স্কুলের অঙ্গীভূত হয়ে বেথুন কলেজে রূপান্তরিত হয়। সে সময় যেসব মহিলারা সেখানে বিদ্যালাভ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন সরলা দেবী (দুর্গামোহন দাসের কন্যা), বিনোদমনি দেবী(মনমোহন ঘোষের ভগ্নি) স্বর্ণপ্রভা দেবী (আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর ভগ্নি) সহ কাদম্বিনী বসু।

সে সময় দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী নারীমুক্তির জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ট্রাস পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য ১৮৭৭ সালে সরলা দাস এবং কাদম্বিনীকে উপযুক্ত বিবেচনা করা হয়। অবশেষে শুধু কাদম্বিনী বসু পরীক্ষা দেন এবং দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীকালে ১৮৮৩ সালে কাদম্বিনী বসু এবং উত্তর প্রদেশের বাঙালি খ্রিষ্টান চন্দ্রমুখী বসু বেথুন কলেজ থেকে বি.এ. ডিগ্রী লাভ করেন। ইংরেজদের রাজত্বকালে তাঁরাই ছিলেন প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট। এরপর তিনি ঠিক করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করবেন। ১৮৮৩ সালে মেডিক্যাল কলেজে প্রবেশের কিছু পরেই মাত্র ২১ বছর বয়সী কাদম্বিনী তাঁর শিক্ষক ও বিজ্ঞ পরামর্শদাতা ৩৯ বছর বয়স্ক বিপত্নীক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। মনে করা হয় সমতা-বোধ সম্পন্ন এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে হওয়া এ বিবাহ আপাতদৃষ্টিতে সুখকর হয়েছিল বা বলাযেতে পারে তাদের পরবর্তী জীবন সুখকর হয়েছিল।

কাদম্বিনী দেবী ১৮৮৪ সাল থেকেই সরকারের কাছ থেকে চিকিৎসা বিদ্যার ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত মাসিক কুড়ি টাকার বৃত্তি পেতে শুরু করেন। চূড়ান্ত পরীক্ষায় কাদম্বিনী সবগুলো পত্রের লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছিলেন কিন্তু ব্যবহারিক পরীক্ষায় একটি অপরিহার্য অংশে তিনি কৃতকার্য হতে পারেন নি। ১৮৮৬ সালে তাঁকে জি.বি.এম.সি (গ্র্যাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ) ডিগ্রী প্রদান করা হয় যা তাঁকে চিকিৎসা পেশা গ্রহণের অধিকার প্রদান করে। তিনিই হলেন পাশ্চাত্য ধারার চিকিৎসা-বৃত্তি গ্রহণের যোগ্যতাসম্পন্ন প্রথম ভারতীয় নারী। পরীক্ষায় পাশের পর তিনি স্বাধীন ও সফলভাবে চিকিৎসা বৃত্তিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এর পর ১৮৮৮ সালে তিনি তিনশো টাকার বেতনে লেডি ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে চাকরী পেতে সমর্থ হন।

কাদম্বিনী দেবী শুধু পড়াশোনা করেই থেমে থাকেননি। তাঁর সাহসও ছিল অপরিসীম। ১৮৯১ সালে সাময়িকী বঙ্গবাসী তাঁর প্রতি পরোক্ষভাবে অশ্লীল কিছু কটাক্ষ করাতে তিনি ওই সাময়িকীর সম্পাদক মহেশ চন্দ্র পালের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন এবং তাতে জয়লাভ করেন। অপরাধীর শাস্তি হিসেবে সম্পাদককে ১০০ টাকা জরিমানা ও ছয়মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। দ্বারকানাথ বাবু ১৮৯৩ সালে চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষার জন্য কাদম্বিনীকে এডিনবার্গে প্রেরণ করেন। কলকাতায় ১৯০৬ সালে অনুষ্ঠিত মহিলা সম্মেলনের মূল সংগঠক ছিলেন তিনি নিজে। এছাড়াও ১৯০৮ সালে একটি সভায় তিনি সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেন। শুধু তাই নয় তিনি একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করে তার মাধ্যমে শ্রমিকদের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে অর্থ সংগ্রহ শুরু করেন। চা বাগানের শ্রমিকদের ওপর নিয়োগকর্তাদের শোষণ সম্পর্কে কাদম্বিনী অবহিত ছিলেন এবং আসামের চা বাগানগুলোতে শ্রমিক সংগ্রহের প্রচলিত পদ্ধতির নিন্দাকারী তাঁর স্বামীর মতকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। মৃত্যুর একবছর আগেও অর্থাৎ ১৯২২ সালে তিনি কামিনী রায়ের সঙ্গে সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তদন্ত কমিশনের পক্ষে কয়লাখনিগুলোতে নিযুক্ত নারী শ্রমিকদের অবস্থা জানতে সুদূর বিহার এবং উড়িষ্যায় যান। কলকাতায় ১৯১৪ সালে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ মহাত্মা গান্ধীকে সম্মান জানানোর জন্য এক সভার আয়োজন করেন এবং সেই সভায় কাদম্বিনী দেবী ছিলেন সভাপতি। তিনি আমাদের সকলের গর্ব।