মা কালী জিহ্বা বের করে রাখেন কেন এবং এর কারণ কী ? মা কালীকে মহাদেবের বুকের উপর পা রাখা অবস্থায় দেখা যায় কেন?

0
275

মা আনন্দময়ী ও শক্তি রূপিণী দেবী সনাতন ধর্মে পূজ্য। অসুর নিধনের জন্য তিনি মহামায়া রুপে স্বর্গে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। মা কালীকে জিহ্বা বের করে রাখতে দেখি, মা এখানে শুধু জিহ্বা বের করেই রাখেন নি তিনি লাল জিহ্বাকে সাদা দাঁত দিয়ে কামড়ে রেখেছেন।এখানে সাদা রং সত্ত্ব গুনের প্রতীক। লাল রং রজো গুনের প্রতীক। লাল জিহ্বাকে সাদা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরার অর্থ সত্ত্বগুণ দিয়ে রজোগুণকে দমন করা। অনেকে বলে মা কালী রক্ত পান করেছেন তারই জন্য জিহ্বা লাল। রক্ত পান করলে তো দাঁতে লাল রক্ত লেগে থাকতো তাতো নেই। মা সন্তানের রক্ত পান করবেন কেন? অনেকে বলেন শিবের উপর দাঁড়িয়েছেন বলে জিহ্বায় কামড় দিয়েছেন। শিব বলেছেন আমাকে যদি তিনি শক্তি দেন তাহলে আমি শিব নচেত আমি শক্তিহীন শিব শব ( মৃত ) হয়ে যাই।

তাই তিনি মায়ের পদতলে। সবই শক্তির অধীন। এই মহাকালের সাথে মহাশক্তির রমন করেন, তাই তিনিই মা কালী।

হিন্দু ধর্মের দেবদেবীর মূর্তি আসলে মানুষের বাস্তব জীবনের স্বরূপ তুলে ধরে। যেমন মা কালী, তিনি উলঙ্গিনী…. ক্রোধী, ভীষণা, হাতে নরমুণ্ড, গলায় ৫১টি মুণ্ডমালা, শিবের বুকের উপর দিয়ে আছেন আবার জিভ বের করে জিভ কামড়েছেন।
উলঙ্গিনী ও ক্রোধী রূপ এটাই বলে যে মানুষের ক্রোধ উলঙ্গ, ক্রোধের ভূষণ নেই, ক্রোধে মানুষ যা খুশি করতে পারে। ৫১ টি মুণ্ডমালা আমাদের ৫১ টি বর্ণমালাকে নির্দেশিত করে। হাতে নরমুণ্ড নির্দেশ করে যে তিনি মানুষের জ্ঞানকে হাতে ধারণ করেছেন। স্বামীর বুকে পা দেওয়াটা ইঙ্গিত করে যে ক্রোধের বশে সবাই ভুল কাজ করে, এমনকি স্বামীর বুকেও পা দিয়ে দেয়। আর জিহ্বা কাটা নির্দেশ করে ক্রোধের পরে যখন সে ক্ষান্ত হয় তখন সে লজ্জায়, চরম আত্মাপমানে স্বীকার হয়… সে নিজেও জানে না যে রাগের বশে সে কী ভুল কাজ করেছে। স্বামীর বুকে পা দেবার জন্য তিনি লজ্জিতা।
দেবী অসুরদমনের সময় অত্যন্ত ক্রোধের বশে সমস্ত জগত ধ্বংস করতে চলেছিলেন। তাঁর কোপ থেকে কেউ বাদ যান নি। এমনাবস্থায় শিব কালীকে থামানোর জন্য মৃত সেজে মাটিতে শুয়ে পড়েন। দ্বিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য কালী ক্রোধের বশে শিবের বুকেই পা দিয়ে দেয়। এবং পরক্ষণে বুঝতে পারেন তিনি কী চরম ভুল কাজ করেছেন। এবং লজ্জায় জিভকাটতে থাকেন। এটা আরো একটি বিষয় নির্দেশ করে, পুরুষের স্থান নারীর নীচে।

হিন্দু ধর্মে সকল দেব দেবীর মধ্যে মা কালী হলেন নারীদের ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক তথা শক্তিরূপের অন্যতম সেরা প্রতীক। এই রূপ দিয়ে মা সমস্ত বিশ্বকে একদিকে যেমন বুঝিয়েছেন অসুরদের বিনাশ এর জন্য তিনি এই রূপ ধারণ করেছেন, তেমনই নারীরা তাদের মমতাময়ী রূপের খোলস ত্যাগ করে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে সকল অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার শেষ করার ক্ষমতাও রাখে।

মাতা কালী হলেন কৃষ্ণ বর্ণের বা শ্যামা বর্ণের ।তার যে রুদ্রমূর্তি আমরা দেখতে পাই তাতে দেখি তার দুই নেত্র ভয়ংকর রক্ত বর্ণের হয়ে থাকে। মাতা কালীর যে সকল মূর্তি ,চিত্র আমরা দেখতে পাই তাতে সবগুলিতেই আমরা দেখি মা কালী দাঁড়িয়ে আছেন ভগবান শিবের ওপর এবং তার জিভ সম্মুখে অগ্রস্থ অবস্থায় আছে। অনেকের মনেই এই প্রশ্ন দেখা যায় কেন মা কালী তার স্বামীর উপর এইরূপ জিভ বার করে দাঁড়িয়ে আছেন?

মা মহামায়া অবতীর্ণ হলে তিনি দেবতাদের বরাভয় প্রদান করেন এবং অসুর নিধনে তার রুদ্র রূপ ধারণ করেন। দেবতারা তখন এক প্রকার খুশি হন। কিন্তু অসুরেরা সম্মিলিত ভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে।

আর অসুরদের এরকম সম্মিলিত লড়াইয়ে মাতা মহামায়া অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন এবং তার তৃতীয় নেত্র থেকে জন্ম নেয় এক অত্যন্ত রুদ্রমূর্তি এবং এই ভয়ঙ্কর রুদ্রমূর্তি হলো মা কালিকা বা মা কালী ।

যখন তিনি মা কালী রূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন তখন সকল অসুরদের বিনাশ করতে শুরু করেন এবং এক প্রকার হত্যাকাণ্ডের তাণ্ডবলীলা চালিয়ে যান। অসুর হত্যা করে মা তাদের নরমুণ্ড হাতে ধরেন এবং নরমুণ্ডের মালা করে গলায় পরিধান করেন।

এছাড়াও খড়্গের দ্বারা অসুরদের হাত কেটে তিনি তার পোশাক বানিয়ে পরিধান করে নেন নিম্নাঙ্গে। এইরকম অবস্থায় অসুরেরা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। তারা বুঝে উঠতে পারে না কিভাবে এই দেবীর মোকাবিলা করবে?

তখন শুম্ভ-নিশুম্ভ তাদের সেনাপতি রক্তবীজকে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ করেন। এই ভয়ঙ্কর দেবীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অসুরদের মধ্যে এক ভয়ংকর অসুর ছিল রক্তবীজ ।এই অসুর প্রজাপতি ব্রহ্মার আশীর্বাদে পেয়েছিলেন এক অভিনব বর।

বরটি ছিল এইরূপ, অসুর রক্তবীজকে যদি কেউ হত্যা করতে উদ্যত হন কোন অস্ত্র বা তলোয়ার দিয়ে এবং তার শরীর থেকে যদি বিন্দুমাত্রও রক্তপাত হয় তাহলে সেই রক্তের বিন্দুকনা যেখানে যেখানে পড়বে প্রতিটি বিন্দু কণা থেকেই এক একটি করে রক্তবীজের পুনরায় জন্ম হবে অর্থাৎ একপ্রকার নিজেকে অমর করার বর চেয়ে নিয়েছিলেন প্রজাপতির কাছে অত্যন্ত চালাক অসুর রক্তবীজ।

এই রুপ বরশালী রক্তবীজকে দেখামাত্রই মা রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন এবং তাকে হত্যা করতে উদ্যত হন। খড়্গের আঘাতে রক্তবীজের শরীর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করলে তার সারা শরীর থেকে রক্ত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং তখনই প্রতিটি রক্তবিন্দু থেকে সৃষ্টি হয় লক্ষ লক্ষ রক্তবীজ ।

এইভাবে মা প্রতিবার রক্তবীজকে মারতে উদ্যত হলে আরো লক্ষ লক্ষ নতুন রক্তবীজ জন্ম নেয় । তখন মা বুঝতে পারেন রক্তবীজের বরের কথা। তাই মা এইবার সকল রক্তবীজের রক্তকে তার মুখ দিয়ে পুরোটাই গ্রহণ করেন ,হত্যা করার পর ।এইভাবে তিনি রক্তবীজকে হত্যা করতে সফলতা লাভ করেন।

এরপরই শুরু হয় মায়ের তাণ্ডবনৃত্য । সেই তান্ডব নৃত্যে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল কাঁপতে থাকে। দেবতারা যখন এই তান্ডব নিত্য দেখেন তখন তারা বুঝতে পারেন সারা পৃথিবী জুড়ে এক প্রলয়ের সৃষ্টি হতে চলেছে, যা তাদের পক্ষে রোধ করা এক প্রকার অসম্ভব ছিল। আর এই প্রলয় যে সকল কিছুকে ধ্বংস করে দেবে তা তারা উপলব্ধি করতে পারেন।

তখন তারা ছুটে যান দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে। তখন মহাদেব সকলের অনুরোধ শুনে মা কালীর রুদ্রমূর্তি তাণ্ডবনৃত্য বন্ধ করার জন্য মায়ের সামনে আপন দেহ শায়িত করেন । তাণ্ডব নৃত্য করতে করতে মা কালী যখন ভগবান শিবের বুকে পা দেন তখন এক প্রকার সম্বিৎ ফিরে পান।

তখন দেখেন তিনি তার স্বামীর বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ।আর তাই তখন হঠাৎ করে লজ্জায় তার জিভ সম্মুখে বেরিয়ে আসে ।আর এই সন্মুখে বেরিয়ে আসা মা কালীর রুদ্র মূর্তি আমরা প্রত্যক্ষ করি সকল রূপে এবং বিভিন্ন চিত্রকলায় ও বিভিন্ন মূর্তিতে। এই ভাবেই মায়ের চিরাচরিত সম্মুখ বের করা মূর্তি প্রসিদ্ধিলাভ করে এই পৃথিবীলোকে।

সোর্সঃ সংগৃহিত বিভিন্ন ওয়েবপেজ।