“দৃঢ় সত্যের দিতে হবে খাঁটি দাম,
হে স্বদেশ, ফের সেই কথা জানলাম ।“
সুকান্ত ভট্টাচার্য
প্রথমেই বলে রাখি, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যকে বলা হয় গণমানুষের কবি । অসহায়-নিপীড়িত, নির্যাতিত, সর্বহারা মানুষের সুখ, দুঃখ তাঁর কবিতার মূল বিষয়। অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে ধনী-মহাজন অত্যাচারী প্রভুদের বিরূদ্ধে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কলম ছিল সক্রিয় । তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে শোষণ-বঞ্চনার বিরূদ্ধে অভিব্যক্তি । তিনি চেষ্টা করেছেন কবিতার মাধ্যমে শ্রেণী বৈষম্য দূর করতে । সর্বক্ষণ তাঁর শ্যেন দৃষ্টি ছিল মানবতার জয়ের দিকে । অসুস্থতা এমনকি অর্থাভাব তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি । তাঁর মানবিক বোধ অবিস্মরণীয় । মানুষের কল্যাণ করা ছিল তাঁর একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান । মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা কাব্যধারার প্রচলিত প্রেক্ষাপটকে আমূল বদলে দিতে পেরেছিলেন । সেই কারণে আজও আমাদের কাছে তিনি নমস্য কবি ।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্ম ১৫আগস্ট, ১৯২৬ এবং মৃত্যু ১৩ মে, ১৯৪৭ । তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ঠিক দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে । বাংলা সাহিত্যের নিরিখে তিনি ছিলেন তরুন কবি । তাঁর কবিতার পটভূমি মূলত মার্কসবাদী ভাবধারার এবং প্রগতিশীল চেতনার প্রেক্ষাপটে ।
বাবা ছিলেন নিবারন ভট্টাচার্য এবং মা সুনীতি দেবী । কালীঘাটের মহিম হালদার স্ট্রিটে মাতামহের বাড়িতে তাঁর জন্ম । তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল অবিভক্ত ফরিদপুর জেলার অর্থাৎ বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার, উনশিয়া গ্রামে । তিনি স্কুলে পড়ার সময় ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন । আর তা ছাড়া বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার কারণে তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে । এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, সুকান্তের বাল্যবন্ধু ছিলেন কবি অরুণাচল বসু । তাঁর জীবনে বাল্যবন্ধু অরুণাচল বসুর প্রভাব অবর্ণনীয় । অরুণাচল বসুর মা কবি সরলা বসু । তিনি সুকান্ত ভট্টাচার্যকে পুত্রস্নেহে ভালবাসতেন । সুকান্ত ছেলেবেলায় মাতৃহারা হলেও সরলা বসু তাঁকে সেই অভাব কিছুটা পূরণ করে দিয়েছিলেন । কবির জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছিল কলকাতার বেলেঘাটার ৩৪ হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়িতে । সেই বাড়িটি এখনও অক্ষত আছে । শোনা যায়, পাশের বাড়িটিতে এখনও বসবাস করেন সুকান্তের একমাত্র জীবিত ভাই বিভাস ভট্টাচার্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মম্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরূদ্ধে কলম ধরেন । ১৯৪৪ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন । সেই বছর আকাল নামক একটি সংকলন গ্রন্থ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।
আট-নয় বছর বয়স থেকেই সুকান্ত লিখতে শুরু করেন । স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকা “সঞ্চয়ে” একটি ছোট্ট হাসির গল্প দিয়ে প্রথম আত্মপ্রকাশ । তারপর কয়েকদিন পরে তাঁর লেখা বিবেকান্দের জীবনী প্রথম ছাপার মুখ দেখে বিজন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিখা’ কাগজে । মাত্র এগারো বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ নামে একটি গীতিনাট্য রচনা করেন । এটি পরে ‘হরতাল’ বইতে সংকলিত হয় । এখানে জানিয়ে রাখি, পাঠশালাতে পড়ার সময়ে ‘ধ্রুব’ নাটকের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য । সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাল্য বন্ধু লেখক অরুণাচল বসুর সঙ্গে মিলে আরেকটি হাতে লেখা কাগজ ‘সপ্তমিকা’ সম্পাদনা করেন । সেই সময় হাতে লেখা দেওয়াল পত্রিকার প্রচলন ছিল চোখে পড়ার মতো । বেশীর ভাগ দেওয়াল পত্রিকা স্টেশনের প্লাটফর্মে সাটানো থাকত, যাতে বেশী মানুষ পড়তে পারেন । অরুণাচল বসু তাঁর আমৃত্যু বন্ধু ছিলেন ।
মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত ভট্টাচার্য কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে আলাদা জায়গা করে নিয়েছিলেন । সুকান্ত ভট্টাচার্য কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা “ দৈনিক স্বাধীনতার” (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন । সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় অনাচার ও বৈষ্যমের বিরূদ্ধে প্রতিবাদি কন্ঠস্বর ফুটে ওঠে । গণমানুষের প্রতি গভীর মমতা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর প্রত্যেকটি কবিতায় । তাঁর রচনাবলির মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য: ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি । পরবর্তী কালে উভয় বাংলা থেকে সুকান্ত সমগ্র নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয় ।
পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হন এবং ১৯৪৭ সালের ১৩ মে কলকাতায় মারা যান । মাত্র একুশ বৎসর বয়সে প্রতিভাধর কবির দেহাবসান ঘটে । স্বল্প বয়সে কবির দেহাবসান ঘটলেও সামান্য কয়েকবছরে অত্যাশ্চর্য কবিত্ব শক্তির পরিচয় দিয়ে গেছেন যেটা আজও আমাদের মধ্যে অমলিন । (তথ্যসূত্র: সংগৃহীত)
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ৭৭তম প্রয়াণ দিবসে আমার শতকোটি প্রণাম ।