বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মৃণাল সেনের অবদান – একটি বিশেষ পর্যালোচনা।।

0
65

প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও লেখক মৃণাল সেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যিনি তাঁর ছবির মধ্য দিয়ে মানুষের কথা, তাদের দুঃখ-বেদনা, হেরে যাওয়ার কথা, আর সেই হেরে যাওয়া থেকে লড়াই করে উঠে আবার বেঁচে ওঠার কথা  বলেছেন।  তৎকালীন যে তিন স্তম্ভ (সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেন এই ত্রিশঙ্কু), বাংলা চলচ্চিত্র কে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করেছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মৃণাল সেন। আজ তার জন্ম দিবস।

জন্ম——

১৯২৩ সালের ১৪ মে মৃণাল সেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত পূর্ব বঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) ফরিদপুরের একটি শহরে বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

প্রথমিক জীবন —

ফরিদপুরে থাকাকালীন সময়ে তিনি সেখানেই উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি পড়াশোনার জন্য কলকাতায় আসেন এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা পড়াশোনা করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখার সঙ্গে যুক্ত হন। যদিও তিনি কখনও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন নি। চল্লিশের দশকে তিনি সমাজবাদী সংস্থা আইপিটিএর (ইন্ডিয়ান পিপ্‌লস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন) সঙ্গে যুক্ত হন এবং এর মাধ্যমে তিনি সমমনভাবাপন্ন মানুষদের কাছাকাছি আসেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবার পর তিনি একজন সাংবাদিক, একজন ওষুধ বিপননকারী এবং চলচ্চিত্রে শব্দ কলাকুশলী হিসাবে কাজ করেন। চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হন কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে, এক জার্মান লেখক রুডল্ফ আর্নহেইম লেখা, ‘ফিল্ম এস আর্ট’ বইটি পড়ে। চলচ্চিত্র জগতে তাঁর প্রথম হাতেখড়ি ঘটে, কলকাতার টলিপাড়ার একটি স্টুডিওতে অডিও টেকনিশিয়ান হিসেবে। যদিও সে কাজটি তাঁর একেবারেই পছন্দ ছিল না।

কর্ম জিবন—

মৃণাল সেন বাংলা, হিন্দি, ওড়িয়া ও তেলুগু ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তিনি কখনও কঠোর বাস্তব, তো কখনও মানুষের মনের থেকে স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নকে নিংড়ে নিয়ে এসে পর্দায় তৈরি করতেন এক অদ্ভুত ছবি।আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বেড়াজালে, যে মানুষগুলোর ভাষা হারিয়ে গেছিল, সেন হয়ে উঠেছিলেন তাদের কণ্ঠস্বর, তাদের প্রতিবাদের ভাষা।
১৯৫৫ সালে মৃণাল সেনের প্রথম পরিচালিত ছবি রাত-ভোর মুক্তি পায়। তবে এই ছবিটি বেশি সাফল্য না পেলেও তার দ্বিতীয় ছবি নীল আকাশের নিচে তাকে স্থানীয় পরিচিতি এনে দেয়। আর তার তৃতীয় ছবি বাইশে শ্রাবণ থেকে তিনি আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান।
১৯৬৯ সালে মুক্তি পায় তার পরিচালিত ছবি ভুবন সোম।অনেকের মতে এই ছবিটি মৃণাল সেনের শ্রেষ্ঠ ছবি। তৎকালীন অন্যান্য বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালকদের মত সেনের ছবিতেও ধরা পড়েছিল শহর কলকাতা। তিনটি ছবি  ‘সাক্ষাৎকার’ , ‘কলকাতা 71’ ,  এবং ‘পদাতিক’, বিভিন্ন কলকাতাকেন্দ্রিক ছবিগুলির মধ্যে সেরা ছবি হিসেবে পরিগণিত হয়। প্রথাগত ধারণার ঊর্ধ্বে এই ছবিগুলি, দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, বেকারত্বের মতন বাস্তব বিষয়গুলি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছিল। মৃণাল সেন মধ্যবিত্ত সমাজের নীতিবোধকে তুলে ধরেন তার দুটি ছবি এক দিন প্রতিদিন (১৯৭৯) এবং খারিজ (১৯৮২) এর মাধ্যমে। খারিজ ১৯৮৩ সালের কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার পেয়েছিল। ১৯৮০ সালের চলচ্চিত্র আকালের সন্ধানে। এই ছবিতে দেখানো হয়েছিল একটি চলচ্চিত্র কলাকুশলীদলের একটি গ্রামে গিয়ে ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষের উপর একটি চলচ্চিত্র তৈরির কাহিনী। আকালের সন্ধানে ১৯৮১ সালের বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার হিসাবে রুপোর ভালুক জয় করে। মৃণাল সেনের পরবর্তীকালের ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহাপৃথিবী (১৯৯২) এবং অন্তরীন (১৯৯৪)। এখনও অবধি তার শেষ ছবি আমার ভুবন মুক্তি পায় ২০০২ সালে।

মৃণাল সেন শুধু বাংলা নয় ওড়িয়া এবং তেলেগু ছবিও তৈরি করেছিলেন, যেগুলি একই রকম প্রশংসার অধিকারী। সত্যজিৎ রায়, তার তেলেগু ছবি, ‘ওকা ওরি কথা’, দেখার পর বলেছিলেন, মৃণাল সেনের ছবি এবং তার তৈরীর ধরন দেখে তিনি ঈর্ষান্বিত।মৃনাল সেন বেশকিছু ডকুমেন্টারি ও শর্ট ফিল্ম তৈরি করেছিলেন, যেগুলি বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক উৎসবে জায়গা করে নিয়েছিল।

ভারত সরকার দ্বারা তিনি, ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৮১) এবং ‘দাদাসাহেব ফালকে’( ২০০৫) পুরস্কার এ ভূষিত হন। এছাড়া তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ অবধি ভারতীয় সংসদের সাম্মানিক সদস্যপদ লাভ করেন। ফরাসি সরকার তাকে কম্যান্ডার অফ দি অর্ডার অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারস (Ordre des Arts et des Lettres ) সম্মানে সম্মানিত করেন। এই সম্মান ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান। ২০০০ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাকে অর্ডার অফ ফ্রেন্ডশিপ সম্মানে ভূষিত করেন।

মৃণাল সেন ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের ৩০ তারিখ রবিবার সকালে নিজ বাসভবনে ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবপেজ।।