মূল্যবান মনুষ্য জীবন ও রথযাত্রা : স্বামী আত্মভোলানন্দ(পরিব্রাজক)৷

0
37

প্রভু জগন্নাথস্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে ৷
আগামী ২২শে আষাঢ় রবিবার বাংলা-১৪৩১, (07.07.2024.) শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে সারা পৃথিবী জুড়ে হবে শ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রা। যার প্রধান আকর্ষণ শ্রীক্ষেত্র পুরীধাম৷ হিন্দু ধর্মের অন্যান্য উৎসবের মতোই রথযাত্রাও এক জাঁকজমকপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। পঞ্জিকা অনুসারে, রথযাত্রা প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে পালিত হয়ে থাকে। ভারতবর্ষের বহু জায়গায়, বিশেষ করে ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে এই উৎসব বিশেষভাবে পালিত হয়। ওড়িশার পুরীর রথযাত্রা সারা পৃথিবী বিখ্যাত। জগন্নাথ মন্দির থেকে প্রায় তিন কিমি দূরে গুন্ডিচা মন্দির বা মাসীর বাড়ীতে রথযাত্রা শেষ হয়৷ যার সূচনা তৎকালীন মালব বা অধুনা উড়িষ্যার সূর্যবংশীয় পরম বৈষ্ণব রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর হাতে৷ ভগবান শ্রীজগন্নাথ হিন্দুধর্মের অন‍্যতম জনপ্রিয় দেবতা। দেবতাদের বিগ্রহ সাধারনত কোন ধাতু কিংবা মাটি দিয়ে তৈরী হয়। কিন্তু জগন্নাথের মূর্তি তৈরী হয় নীম কাঠ দিয়ে। চৌকো মাথা, বড় বড় চোখ ও অসম্পূর্ন হাত।

পুরাণ অনুযায়ী জগন্নাথ ভগবান বিষ্ণুর অন‍্য রূপ। রাজা ইন্দ্রদুম্ন ভগবান বিষ্ণুর মন্দির তৈরী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিগ্রহের আকার কেমন হবে তা নির্ধারন করতে পারছিলেন না। তাই তিনি সৃস্টিকর্তা ব্র‍হ্মার শরনাপন্ন হন। ব্রহ্মা রাজাকে বললেন, তিনি যেন বিষ্ণুর ধ‍্যান করে জেনে নেন। গভীর ধ‍্যানের পর স্বপ্নাদেশে মতো রাজা গিয়ে দেখলেন পুরীর কাছে এক নদী দিয়ে একটা কাঠের টুকরো ভেসে যাচ্ছে। সেই কাঠ দিয়ে মূর্তি তৈরী শুরু হলো। কিন্তু শিল্পী কিছুতেই তৈরী করতে পারছিলেন না। বার বার ভেঙে যাচ্ছিল। উপয়ান্তর না দেখে, রাজা বিশ্বকর্মাকে অনুরোধ করলেন মূর্তি তৈরী করতে। বিশ্বকর্মা রাজী হলেন একটা শর্তে। যতক্ষন কাজ চলবে কেউ যেন তাঁকে বিরক্ত না করে। দরজা বন্ধ ঘরে কাজ শুরু হলো। বন্ধ ঘর থেকে ঠুকঠাক আওয়াজে চারদিক ভরে গেলো। দেখতে দেখতে দুই সপ্তাহ হয়ে গেলো। হঠাৎ বন্ধ ঘরের আওয়াজ থেমে গেলো। অনেক সময় পেরিয়ে গেলো। রানী, রাজাকে বললো আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেছে। বাইরে থেকে কিছু বুঝা যাচ্ছে না। ঘরের ভিতরে গিয়ে দেখা উচিত। সব ঠিকঠাক আছে কিনা। রাজা অনিচ্ছা সত‍্বেও ঘরের দরজা খুলে দিলেন। দরজা খুলে চমকে উঠলেন। একি, বিশ্বকর্মা ঘরে নেই। কোথায় গেলেন? অসম্পূর্ন বিগ্রহ মাটীতে পরে রয়েছে। বুঝতে পারলেন শর্তের খেলাপ করেছেন। বিশ্বকর্মার আদেশ অমান‍্য করায় রাজা মনে মনে অনুতপ্ত হলেন। তখন দৈববানী হয়। যে আকৃতির বিগ্রহ তৈরী হয়েছে সেই বিগ্রহ যেন প্রতিষ্ঠা করা হয়। হয়তো ভগবান বিষ্ণু তাই চেয়েছিলেন। তখন থেকেই জগন্নাথ, বলরাম,সুভদ্রার হাত হীন অসম্পূর্ন বিগ্রহের মাহাত্ম‍্য দেশ জুড়ে ছেয়ে যায়।

পুরীতে শ্রীশ্রীজগন্নাথ দেব প্রতিবছর নব রথে ওঠেন। নব শব্দের অর্থ এখানে দুটি নতুন ও নববিধা ভক্তি। মানে ভক্তির রথ। রথের দড়ি – বাসুকি নাগ বা “শঙ্খচূড়া নাগুনি “৷ তাই , রথের রশি বা দড়ি ধরে টানলে বাসুকির কৃপা লাভ হয়। পুরীর রথের ৪২ টি চাকা। (দাদা বলভদ্র বা বলদেবের রথের ১৪ টি, জগন্নাথের রথের ১৬ টি, বোন সুভদ্রাদেবীর ১২ টি)। পুরীর রথ চলার সময় রাস্তায় চাকার তিনটি দাগ পড়ে – তা হল গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী। যারা বার্ধক্যজনিত কারণে বা অন্যান্য কারণে ভীড়ে রথের দড়ি ধরতে পারেন না, তারা যদি চাকার এই তিনটি দাগের ধুলি গ্রহণ করেন, বা এই ত্রিদাগে গড়াগড়ি দেন, যাতে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী সঙ্গমে অবগাহন স্নানের পূণ্যফল লাভ হয়। জগন্নাথের রথের নাম নন্দীঘোষ বা কপিধ্বজ বা গুরুড়ধ্বজ। ৪৫ ফুট উচ্চতার এই রথের ১৬টি চাকা। রথের রঙ পীত বা হলুদ। ষোল চাকা মানে দশ ইন্দ্রিয় আর ষড় রিপু। তাই থাকে জগন্নাথদেবের পায়ের নীচে। নীল রঙের বলরাম বা বলভদ্রের রথের নাম হল তালধ্বজ বা হলধ্বজ বা লাঙ্গলধ্বজ। ৪৪ ফুট উচ্চতার এই রথে ১৪টি চাকা আছে। ১৪টি চাকা মানে ১৪ ভুবন। বলভদ্র হল গুরুতত্ত্ব। গুরুতত্ত্বের অধীন ১৪ ভুবন। সুভদ্রার রথের নাম ‘দর্পদলন’ বা “দেবদলন” বা ‘পদ্মধ্বজ’। লাল রঙের দেবতাদের দেওয়া এই রথের উচ্চতা ৩১ হাত বা ৪৩ ফুট। রথটিতে ১২ টি চাকা আছে। ঈশ্বর ভজনার কোন বিশেষ সময় হয় না৷ যা করতে হয় বার মাস ৩৬৫ দিন সবসময়।

রথগুলি যেহেতু কোনরকম আধুনিক সরঞ্জাম ছাড়া শুধুমাত্র কাঠের তৈরি, ফলে রথ চলার সময় কাঠের ঘড়ঘড় আওয়াজ হয়, এটিকে বলা হয় বেদ। জগন্নাথের রথ তৈরীতে ২০৬ টি কাঠ লাগে ৷ যেমন আমাদের দেহেও ২০৬ টি হাড়। সবার বড় বলরাম তাই রথ যখন চলে প্রথমে থাকে দাদা বলদেবের রথ। আসলে তা গুরুর মাহাত্ম্য বা গুরুতত্ত্ব। তিনিই তো নিত্যানন্দ। সবার জীবনে আগে গুরুকৃপা আসতে হবে। এরপর যায় সুভদ্রার রথ। সুভদ্রা হল ভক্তি তত্ত্ব। গুরুকৃপা পেলে ভক্তি দৃঢ় হয় ৷ পাওয়া যায় ভক্তিমহারাণী সুভদ্রাকে।
সবশেষে যায় জগন্নাথের রথ। গুরুর কৃপা থেকে ভক্তির উদয় হলে তবে পাওয়া যায় বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের মালিক ভগবান জগন্নাথকে ৷

পুরান মতে ভগবান জগন্নাথ চার ধামে চার ভাবে বিশ্বে প্রতিভাত হলেও তিনি ভোজনের জন্য পুরী ধামে আবির্ভূত হয়েছেন৷ চার ধামের মধ্যে ভগবান জগন্নাথ শ্রীক্ষেত্র পুরী ধামেই নিত্য আহার করেন, তাই পুরী ধামের ভোগের মহত্ব এত অসীম। শ্রীক্ষেত্র পুরীর মহাপ্রসাদ জগত বিখ্যাত। এই পুরী ধামে শ্রী ভগবানের নিত্য সেবা হয় ৫৬ রকমের ভোগ দিয়ে। স্বয়ং মাতা লক্ষী দেবীই যেন প্রতিদিন প্রভু জগন্নাথের জন্য এই ভোগ রান্না করেন। জগন্নাথ দেবের ভোগ গ্রহনের পর মাতা বিমলা দেবী সেই প্রসাদ গ্রহণ করেন। তাই এই প্রসাদ মহাপ্রসাদ নাম জগত বিখ্যাত। এই মহাপ্রসাদে থাকে ৯ রকমের চালের পদ, ১৪ রকমের সবজি ৯ রকমের দুধের জিনিস, ১১রকমের মিষ্টি, ২৩ রকমের পিঠা-পুলি, মালপোয়া ও অনন্য জিনিস। প্রতিদিন ৭৫২টি উনুনে রান্না হয়, ৬০০জন রাঁধুনি, আর ১,০০০ সহকারী এই কাজ করেন নিষ্ঠা সহকারে। জগন্নাথ দেবের রান্নায় সব সবজি লাগলেও কিছু সবজি একেবারেই নিষিদ্ধ যেমন – সাধারণ আলু (একমাত্র ক্ষামআলু ব্যবহার করা হয়) লঙ্কা, গাজর, রসুন, পিয়াজ, টমেটো প্রভৃতি। তবে শ্রীক্ষেত্র পুরীতে যারা গেছেন তারা সকলেই অবগত আছেন পুরীধামের রান্নাঘরের বিশেষ মাহাত্ম্যা সম্পর্কে।

মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব যেমন অপলক নয়নে বিভোর হয়ে রথে অবস্থিত জগন্নাথকে দেখতেন এবং আনন্দে নাচতেন সেভাবেই ভক্তকে হৃদয় দিয়ে ভগবানকে দেখতে হয় ও প্রণতি জানাতে হয় ৷ ভক্তকে দেখার জন্য ভগবানও আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করেন৷ পুরীতে নেই কোন জাতি বা বর্ণভেদ ৷ আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার এই যোগ হলো রথ দর্শন ৷ রথযাত্রা উচ্চ-নীচ, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ সবরকম ভেদাভেদ ভুলে মানুষের মধ্যে গোষ্ঠীভাব জাগায় এবং সবাইকে নিয়ে একসাথে বাঁচতে শেখায়৷ সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় ৷
পুরী ছাড়াও উড়িষ্যার বহু শহরে, পশ্চিমবঙ্গের মাহেশ, মহিষাদল, গুপ্তিপাড়া রথ সুপ্রাচীন ও বিখ্যাত৷ আর এখন ভারতবর্ষে সব গ্রামে শহরে ও পৃথিবীর সব বড় শহরে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ৷

বিশেষ শুভদিনে সবাইকে জানাই শুভেচ্ছা। ভগবান সবাইকে ভালো রাখুন, সুস্থ রাখুন। জগৎ গুরু ভগবান স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ ও প্রভু জগন্নাথদেবের শুভ ও মঙ্গলময় আশির্বাদ আপনাদের সকলের শিরে বর্ষিত হোক… এই প্রার্থনা করি…! জয় শ্রী জগন্নাথ। জয় বলরাম ও সুভদ্রার জয় ৷
জয়তু রথযাত্রা ৷
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্ ।