মানুষ অভ্যাসের দাস — দুটি কথা : দিলীপ রায়।

0
10

ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি মানুষ অভ্যাসের দাস । সুতরাং স্ত্রী-পুরুষ, জাতি-বর্ণ এবং বয়স নির্বিশেষে সকলের কাছে অভ্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । আসলে আমাদের অভ্যাসগুলি ধীরে ধীরে স্বভাবে বা চরিত্রে পরিণত হয় । তাই চলমান ও নতুন অভ্যাসের ব্যাপারে একটু ভেবেচিন্তে এগোনো দরকার । ইতিবাচক অভ্যাস নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, বরং বলা ভাল ইতিবাচক অভ্যাস মানুষকে অনেক শান্তি দেয় । আবার খারাপ অভ্যাস দৈনন্দিন জীবনে একটা মানুষকে বিষাদে ভরে দিতে পারে । সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত চব্বিশ ঘন্টার কর্মকাণ্ডে খারাপ ও অপ্রীতিকর অভ্যাসগুলি বর্জন করা যুক্তিসঙ্গত । সকালে উঠে ব্যায়াম করা যেমন একটা ভাল অভ্যাস, ঠিক তেমনি ধূমপান করা খারাপ অভ্যাস । সততা, নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাপরায়ণতা, বেশী রাতে ঘুমাতে না-যাওয়া, ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, নিয়মিত শরীর চর্চা করা, বড়দের সম্মান করা, অপরের উপকার করা, বাবা-মার প্রতি সযত্ন হওয়া, সকলের সাথে সু-ব্যবহার বজায় রাখা, এগুলো ভাল অভ্যাস । স্বাস্থ্য সচেতনার নিরিখে নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া, ট্রেনে-বাসে-হাসপাতালে মুখে মাস্ক পরা, এগুলি ভাল অভ্যাস । অন্যদিকে মদ্যপান, ধূমপান, মাদক দ্রব্য গ্রহণ, মিথ্যা কথা বলা, বেশী খাওয়া, কর্মক্ষেত্রে উৎকোচ গ্রহণ করা, হিংসা, লোভ, অপরের প্রতি অকারণে ঈর্ষা, এগুলি খারাপ অভ্যাস এবং এগুলি মানুষের জীবনে ধ্বংসের কারণ ।
(২)
অভ্যাস আবার পরিবর্তনশীল । যদি আমাদের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন চাই তাহলে আমাদের নিজেদের বদলাতে হবে । যেমন আমাদের চলমান জীবনে পুরানো অভ্যাস ত্যাগ করে সৃষ্টিমূলক ইতিবাচক নতুন অভ্যাস তৈরী করা ভীষণ জরুরি । তেমনি বর্তমান অভ্যাসের উন্নতিসাধন করাটাও সমভাবে দরকার । কোনো অভ্যাস পরিবর্তনের প্রথম ধাপ হল কোনো কিছু ছেড়ে দেওয়া বা ত্যাগ করা । যত তাড়াতাড়ি পুরানোটাকে ছেড়ে দেওয়া যাবে, ঠিক তত তাড়াতাড়ি নতুনটিকে গ্রহণ করা সম্ভব হবে । কিন্তু বিভিন্ন কারণে পরিবর্তনটা মানা অনেক সময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায় । যেমন নিজের শোয়ার খাটটির স্থান পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে মন কিছুতেই সায় দিতে চায় না । কেননা আমরা একটা গণ্ডির মধ্যে থেকে অভ্যস্ত, সেটার পরিবর্তন চটজলদি মন থেকে মানা কঠিন ।
অভ্যাসের পরিবর্তন, নতুন অভ্যাস গঠন এবং খারাপ অভ্যাস বর্জন — এসবের জন্য চাই আমদের ইচ্ছাশক্তির বিকাশ । এটা ঘটনা, যখন আমরা কোনো অভ্যাস
বা স্বভাব পরিবর্তন করার সংকল্প করি, তখন শুরুটা ভাল হয় । কিন্তু কিছুদিন পর আমাদের উৎসাহ এবং মনোবল নিস্তেজ হয়ে যায় । কী কারণে এরূপ পরিণাম হয় ? ঠিক এই প্রশ্নটাই গীতাতে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে করেছেন, “কী কারণে, যন্ত্রচালিতের মতো, অনিচ্ছা সত্ত্বেও লোকে অন্যায় ও অকাজে লিপ্ত হয় ?” এটা স্বাভাবিক, আমরা সকল ইচ্ছাশক্তির অধিকারী নই । আসলে আমাদের ইচ্ছাশক্তি হল আমাদের আভ্যন্তরীণ সংক্রমণরোধক ক্ষমতা । অন্যদিকে ভোগ্য ইন্দ্রিয় বিষয়গুলি হলো আমাদের প্রলোভনস্বরূপ । তারা আমাদের ঐ সংক্রমণব্যবস্থাকে আক্রমণ বা আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে গ্রাস করে । আসলে ইচ্ছাশক্তি হচ্ছে এমন এক দক্ষতা, যা ক্রমাগত অনুশীলন করে আয়ত্ত করা বা অর্জন করা সম্ভব । যতই ইচ্ছাশক্তির চর্চা করা যায় ততই তা দৃঢ়তর হতে থাকে । তাই প্রথমে ছোট কাজের অভ্যাস গড়ে ওঠে, তারপর সেই অভ্যাস ক্রমশ দৃঢ় হয় । সুতরাং অভ্যাস গঠন ও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ইচ্ছাশক্তির ভূমিকা অপরিসীম ।

(৩)
আমরা অভ্যাস গঠনের দিকে তাকালে দেখতে পাই, স্কুল-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে অভ্যাস গঠনের সর্বোৎকৃষ্ট জায়গা । এটা ঘটনা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল অভ্যাস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে । তাই স্কুল ও অভিভাবকের পারস্পরিক সহযোগিতা শিশুদের সুষমভাবে বেড়ে ওঠা এবং ভালো অভ্যাস গঠনে যথেষ্ট সহায়ক । একটা কথা প্রচলিত আছে “সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ”, আর কিশোর (১৪ বছর থেকে ১৭ বছর) বয়সে এই প্রবাদটার প্রতিফলন আমরা দেখি বেশী । কেননা এই সময়টাতে কিশোরদের দৈনন্দিন জীবনের দিকে অভিভাবকদের নজর দেওয়া ভীষণ প্রয়োজন । নজরদারির অভাব ঘটলে কিশোরেরা খুব সহজেই বদ অভ্যাসগুলির প্রতি ঝোঁকে । অন্যভাবে বলা যায়, সৎ সঙ্গ একজন জীবনের পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায় আর অসৎ সঙ্গ তার সুনাম, সাফল্যকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয় ।
পরিবর্তনমুখী অভ্যাস নিয়ে কয়েকটি সুন্দর কথার অবতারণা । যেমন আপনার বা আমার চোখ আছে, তাই আপনি একটি সুন্দর জিনিস দেখলেন বা কোনো মুখ দেখলেন । চোখ রয়েছে দেখার জন্য । তাই আপনি ঐ জিনিসটা বা মুখটার দিকে তাকিয়েছেন । এটাকে বলা হবে আপনি ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন । তারপরে যদি আপনি আবার তাকান, তাহলে বলা হবে আপনি আগ্রহী । বারবার তাকালে বলা হবে আপনি অনুরক্ত । পরিশেষে যদি দেখা যায় আপনি ঐ মুখটা না দেখে থাকতে পারছেন না, তাহলে বুঝতে হবে আপনি আসক্ত হয়ে পড়েছেন । এটা অভ্যাসেরই নামান্তর । এই অভ্যাস কীভাবে ধীরে ধীরে গড়ে উঠে তার মনস্তাত্ত্বিক বর্ণনা দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলেছেন,”বিষয়সমূহ চিন্তা করতে করতে তাতে মানুষের আসক্তি জন্মে, আসক্তি থেকে কামনা বা তৃষ্ণা জাত হয় । কামনা প্রতিহত হলে তা ক্রোধে পরিণত হয় ; ক্রোধ থেকে জাত হয় মোহ অর্থাৎ কর্তব্য-অকর্তব্যরূপ বিবেকনাশ । মোহ থেকে আসে স্মৃতির বিলোপ, স্মৃতিবিভ্রম থেকে আমাদের বুদ্ধি বিনষ্ট হয় । আর পরিশেষে বিনষ্টবুদ্ধি আমাদের বিনাশের গহ্বরে ঠেলে দেয় ।“
(৪)
আসক্তির ক্ষেত্রে অভ্যাসের ভূমিকা অনস্বীকার্য । ধরা যাক একজন ধূমপান শুরু করলো । ধূমপানে তার খুব শান্তি । ধূমপান ক্রমশ অভ্যাসে পরিণত হল । যাকে বলে ধূমপানে তার আসক্তি জন্মালো । এটা মদ্যপানের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে । এগুলি এখনও সমাজের চোখে খারাপ অভ্যাস ।
নলিনীডাঙা গাঁয়ের নরহরি দত্ত সদ্য অবসর নিয়েছেন । অল্প বেতনের জন্য সারাজীবন দুপুরের টিফিন হিসাবে মুড়ি ও কাঁচা লঙ্কা খেতেন । সেই অভ্যাস এখনও বহমান । দুপুরবেলায় মুড়ি ও কাঁচা লঙ্কা না খেলে তাঁর নাকি শরীর আনচান করে । তাঁর মুখে অনবরত শোনা যায় “মানুষ অভ্যাসের দাস”, যেমন তিনি নিজে । মুড়ি ছাড়া দুপুরবেলায় তাঁর অন্য খাবার রুচে না ।
অবশেষে বলা যায়, “মানুষ অভ্যাসের দাস” কথাটি সঙ্গত । তেমনি আমার ব্যক্তিগত মতে, অভ্যাসও পরিবর্তনশীল । যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন সবসময় কাম্য । তাতে নিজের মঙ্গল তথা সমাজের মঙ্গল । (তথ্যসূত্রঃ তথ্য সংগৃহীত ও উদ্বোধন-শ্রাবণ ও ভাদ্র, ১৪2৮)