স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আলোচনায় মনোচিকিৎসক ডাঃ জিষ্ণু ভট্টাচার্য।

0
2486

আমরা জানি আজ গোটা পৃথিবী এক অজানা ভাইরাসের আক্রমনে নাজেহাল হয়ে পড়েছে। করোনা ভাইরাস। ইতিমধ্যেই বহু দেশে এই ভাইরাসের আক্রমনে বহু মানুষের প্রানহানী হয়েছে। আমারিকা, ইতালী, ফ্রান্স, চিন দেশ গুলিতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত কয়েক হাজার। ভারতেও এই করোনা ভাইরাসের ছোবল পড়েছে। যেহেতু এখনো পর্যন্ত এই ভাইরাসের সঠিক কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয় নি, তাই প্রতিরোধের পদ্ধতি হিসেবে দেশগুলিতে চলছে লকডাউন। ভারতও দ্রুত এই পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রতিরোধ করে চলেছে। আমাদের গোটা দেশ আন্তরিকতার সহিত এই ভাইরাস মুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টায় সামিল। কিন্তু কিভাবে এই ভাইরাসের বিস্তার থেকে মুক্তিপাব, কিভাবে শরীরের যত্ন নেবো, লকডাউন পদ্ধতি মেনে চলা কতটা জরুরী তা নিয়ে বিষদে আমরা আলোচনা করব। আর এই আলোচনায় আজ আমরা মুখোমুখি হয়েছি, সিউড়ি সদর হাসপাতাল (বীরভূমে) কর্মরত এবং পেশায় মনোচিকিৎসক  (MBBS.DPM) ড. জিষ্ণু ভট্টাচার্য।

প্রশ্ন: ডাক্তার বাবু বর্তমানে গোটা বিশ্বে একটাই আলোচিত নাম করোনা ভাইরাস। এই ভাইরাস সম্পর্কে কিছু যদি বলেন।

উঃ করোনা একপ্রকার RNA virus ( nuclic acid capsule) যেটি বিভিন্ন প্রাণী (স্তন্যপায়ী ও পাখি) মানুষকে আক্রমণ করে এবং প্রধানত Respiratary tract Infection করে। এটি একটি বড় প্রজাতি ORTHO CORONA VIRUSE।
বর্তমানে যেটি নিয়ে এত আলোচনা covid-19। এটি এক প্রকার ছোঁয়াচে রোগ। SARS cov- 2 (Sevre Act Respirutors Syndrome Corona Viruse 2) দিয়ে হয়।

প্রথম 2019 সালে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী হুয়ান (wuhan) এ সংক্রমিত হয় এবং আস্তে আস্তে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এটি একটি প্রাণীর মাংস বিক্রির বাজার থেকে ছড়িয়ে পড়ে এরকম মনে করা হচ্ছে।

রোগের লক্ষণ- জ্বর, শুকনো কাশি, বা কাশির সাথে অল্প কফ, শ্বাসকষ্ট (যেটা আগে কোনদিন হয়নি), এছাড়া গা হাত পা ব্যথা, Diarrhoea, গলা খুসখুস, Anosmia (গন্ধ না পাওয়া), স্বাদ না পাওয়া, পেটে ব্যথা হতে পারে——-অল্প সংখ্যাক রুগী যাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম(ডায়াবেটিস, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, ক্যান্সার রোগী, HIV positive রোগী) তারা নিউমোনিয়া এবং পরে Multi organ Failure এ যেতে পারেন।

ছড়ায় কিভাবে—মানুষ থেকে মানুষে, হাঁচি কাশির মাধ্যমে, চোখে মুখে হাত দেওয়া থেকে, বাতাসের মাধ্যমেও ছড়ায়।

প্রশ্নঃ এই ভাইরাস থেকে মুক্তি পাবে কিভাবে মানুষ?

উঃ আসলে SARS Covid —-করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়াটাই চিন্তার। কারণ খুব তাড়াতাড়ি
হলেও 2021 আগে এর কোন প্রতিশোধক বের করা সম্ভব নয়। তাই আমাদের উদ্দেশ্য হবে রোগ প্রতিরোধ করা।
##যতটা পারা যায় ঘরে থাকুন, অযথা কারণ ছাড়া বাইরে না বেরোনো, কোনরকম জামায়েত না করা, আড্ডা তে যোগ না দেওয়া এবং ভীড়ের মধ্যে না যাওয়া… সে যেভাবেই হোক।
##বারবার হাত পা মুখ ধোয়া, সাবান বা ৬০% আলকোহল যুক্ত স্যানিটাইজার দিয়ে হাত কুড়ি থেকে 22 সেকেন্ড পর্যন্ত হাত পরিষ্কার করা।
##কখনো অজান্তে হাত চোখে মুখে না দেওয়া।
##-Respiratory hygiene– হাঁচি বা কাশি হলে রুমাল, টিসু পেপার বা কুনুই এর মধ্য দিয়ে নাক ও মুখ ঢেখে নেওয়া এবং অন্য কেউ করলে ও সাবধানতা অবলম্বন করা।
##সামাজিক দূরত্ব মানা– দোকানে দরকারি জিনিস বা ওষুধ কিনতে গেলেও দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ানো, দকার হলে বৃত্ত করে করে দাঁড়ান। স্কুল-কলেজ বেশিরভাগ কর্মক্ষেত্র বন্ধ করে দেওয়া বাড়িতে থেকে কাজ করা।

জনসচেতনতা বাড়ানো—যে পাড়াতে বা ফ্ল্যাটে বা কেউ যদি বিদেশে বা অন্য রাজ্যে থেকে আসে তাহলে তিনি নিজেকে বা হাসপাতালে Fever Clinic এ নিয়ে যাওয়া।
##বাইরে খুব বাধ্য হয়ে বেরোলে অবশ্যই মুখে মাক্স পড়ুন। যদি কিছু না পাওয়া যায় তাহলে মুখে দুটি রুমাল বা কাপড় দিয়ে মুখ ও নাক বেঁধে বেরোনো।
##বাইরে থেকে এসে সমস্ত জামাকাপড় সাবান জলে ডুবিয়ে ধুয়ে ফেলা এবং পারলে ঘরে ইস্ত্রি করে পড়া এবং বাকি দরকারী জিনিস গুলি ঘরে ঢোকার পরই একটি বালতিতে বা পাত্রের মধ্যে রাখা এবং মোবাইলকে পরিষ্কার করে রাখা।

প্রশ্ন লকডাউন কি একমাত্র পথ?

উঃ হ্যাঁ, প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় শেষ পর্যন্ত একটাই পথ লকডাউন এবং গৃহবন্দী (quarantine) থাকা মানে non-contact isolation পালন করা।

প্রশ্নঃ- লকডাউন মেনে চলাটা কতটা জরুরী?

উঃ-প্রচন্ডভাবে কঠোরভাবে মেনে চলা উচিত। একটু বুঝিয়ে বলা যাক,  এখনো পর্যন্ত রোগটির প্রকৃত নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি——-তাই যদিও ক্ষতিকারক ক্ষমতা ক্ষয় হলেও এই রোগটি মারাত্মক সংক্রামক। তার অর্থ  যদি প্রচুর মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে যায় সেক্ষেত্রে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সেই পরিকাঠামো উপযুক্ত নেই। যে সবাই চিকিৎসা পেতে পারবে। কারন ভেবে দেখুন প্রথম বিশ্বের ইউরোপের এবং আমেরিকায় কি পরিণতি হয়েছে।

…….ছবি

প্রশ্নঃ ভিড় থেকে প্রভাব কেমন রোগ বিস্তারে?উঃ  মনে রাখতে হবে এই রোগটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াই,  শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে, স্পর্শ (মানবিক এবং বাস্তু সম্বন্ধীয়) এগুলো‌ দিয়েই ভাইরাসটি ছড়ায়।

প্রশ্নঃ সরকারকে আরো কতটা কঠিন হতে হবে লকডাউন নিয়ে?

উঃদেখুন এটা প্রশাসনিক ও আইনানুগ বিষয়। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী দুই সরকার সচেতনার্থে জায়গায় বলে চলেছেন পুলিশ প্রশাসন এবং বাকি প্রশাসনিক প্রধানরা যথেষ্ট কড়া এই বিষয়ে। তবে আমার ব্যক্তিগত মত লকডাউন না মানলে কিছু ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক এবং যারা গুজব ছড়াচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রেও একই।

প্রশ্নঃ শরীরের যত্ন কিভাবে নেবে?

উঃ বেশি পরিমাণে জল খাওয়া, লক্ষ্য রাখতে হবে জ্বর সর্দি-কাশি যেন না হয় এবং পারলে মাঝে মাঝে গরম জলে নুন মিশিয়ে তা দিয়ে গারগেল করা এবং অযথা ঠান্ডা জল না খাওয়া বা এসি না চালিয়ে ফ্যান হালকা চালিয়ে রাখা। পারলে একটু রোদে দাঁড়ানো এবং ভালো করে গরম জলে স্নান করা, বাড়ির মেঝে ডেটল বা ফিনাইল দিয়ে মোছা এবং বাচ্চাদের খেলনা গুলিও পরিষ্কার রাখা।

প্রশ্নঃ প্রতিদিনের খাদ্য অভ্যাস?

উঃ ১) খাবার বানানোর আগে রান্না যিনি করছেন তিনি যেন হ্যান্ড হাইজিং পালন করেন।
২) প্রচুর পরিমাণে জল, ডাবের জল, বাড়িতে তৈরি নুন চিনির শরবত খান।
৩) পাতলা খাবার খাওয়া অর্থাৎ কম মশলাপাতি দিয়ে ভালো করে সেদ্ধ করে খাবার খাওয়া।
৪) প্রচুর সবুজ শাকসবজি খাওয়া এবং পারলে যেকোনো একটি করে ফল খাওয়া, এতে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্টস থাকে।
৫) অনেকে হেলথ ড্রিংকস নিয়ে প্রশ্ন করেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে এর বিরুদ্ধে – সাধারণ খাবার ভালো করে খান।

প্রশ্নঃ মানুষ ভয়ে রয়েছেন কি বলবেন তাঁদের উদ্দেশ্যে?

উঃ দেখুন যে কোনও মহামারী মানসিক অসুবিধা নিয়ে আসে। এই চারিদিকে করোনা রোগ সম্বন্ধে সচেতনতা (যেটা অবশ্যই দরকার) এবং বিভিন্ন খবর, মানুষের গুজব, সব মিলিয়ে খুব স্ট্রেস এবং উদ্বেগ তৈরি হয়। আর সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশি বা ফ্লু এর মতই লক্ষণ এইSARS Covid রোগটির।
——–মানুষের উদ্দেশ্যে বক্তব্য অযথা আতঙ্কিত হবেন না। মাননীয় কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার WHO চিকিৎসক মহল যা যা নিয়মাবলী বলেছে তা মেনে চলুন—–জ্বর বা অন্য কোনো উপসর্গ হলে কাছাকাছি হাসপাতালে গিয়ে Fever Clinic এ নিজের পরীক্ষা করান। নিজেকে আনন্দে রাখুন বা ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করুন।জমে থাকা কাজ করুন, গান শুনুন, গল্পের বই পড়ুন, হালকা ব্যায়াম করুন, এই কাজগুলি মেনে চলুন। আর গুজবে কান দেবেন না এবং গুজব ছড়াবেন না।

প্রশ্নঃ সিজন চেঞ্জ হচ্ছে কি কি করা উচিত?

উঃ ১) যেকোনো মানুষের সর্দি-কাশির থেকে Sensible distance অর্থাৎ দূরত্ব বজায় রাখুন এবং অন্য কেউ কাশলে নিজের মুখ এবং নাক রুমাল দিয়ে চেপে ধরুন।
২) সারাদিনে অনেকবার (পারলে আধঘন্টা অন্তর) ভালো করে সাবান, স্যানিটাইজার (60% এলকোহল যুক্ত) দিয়ে হাত, পা, মুখ ভালো করে ২০ থেকে 22 সেকেন্ড ধরে ধোয়া এবং মাঝে মাঝে হালকা গরম জলে পুরো গা হাত পা ধোয়া বা স্নান করা।
৩) বাইরে থেকে এলে সমস্ত জামাকাপড়, মোজা, রুমাল ধোয়ার জায়গায় দিন এবং মোবাইল, টাকার ব্যাগ বা পার্স ঘরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রাখুন।
৪) পারতপক্ষে গরম খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন।
৫) বাইরে থেকে এসেই খুব গরম লাগলেও ফ্রিজ থেকে বার করে ঠান্ডা জল বা নরম পানীয় খাওয়া নয় এবং খুব ঘেমে থাকা অবস্থায় জোরে ফ্যানের নিচে বা এসি নিচে বসা উচিত না।
৬)ভালোভাবে সময় করে পরিমাণমতো ঘুমোতে হবে এবং সেটি নিশ্চিন্ত ঘুম হতে হবে। দরকার হলে মোবাইল ফোনটি সাইলেন্ট অবস্থায় রাখুন এবং স্লিপ হাইজিন মেনে চলুন।
৭) সমীক্ষায় দেখা গেছে ভিটামিন D3 যাদের কম থাকে তাদের যে কোনো রকমের ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা হওয়ার প্রবণতা থাকে। তাই বেশি করে সূর্যালোক উপভোগ করুন এবং প্রকৃতির সংস্পর্শে আসুন।
৮) এমনি সময় (লকডাউন ছাড়া) প্রাতঃভ্রমণ এবং সান্ধ্য ভ্রমণ করুন আর মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিন।

প্রশ্নঃ শিশুদের যত্ন কিভাবে?

উঃ শিশুরা খুব সহজ-সরল। তাদের ভালো করে যত্ন নিতে হবে।এই সময়ের জন্য বাচ্চাদের একটা নতুন রুটিন বানিয়ে দিন (খুব কঠোরভাবে নয়)। শিশুদের কথা মন দিয়ে শুনুন। খেয়াল রাখুন যাতে করে শিশুরা বাবা-মা ও পরিবেশের সাথে বেশিরভাগ সময় কাটাতে পারে। পরিবারের লোকজন ওদের সাথে খেলুন (ইনডোর গেমস) লুডো, ক্যারাম, শব্দজব্দ ।
বাচ্চার মধ্যে নিজস্বতা (‌‌Creativity) আছে, তাকে সেই গুলি নিজের মত করতে দিন। বাচ্চার সাথে কার্টুন, সিনেমা, মজার সিরিয়াল দেখুন।বাচ্চাদেরকে অহেতুক ভয় দেখাবেন না, আশ্বস্ত করুন। শিশুদের বয়স অনুযায়ী তাকে সত্যটা তার মত করে জানান। বাচ্চাদের সামনে কোন ভয়ের আলোচনা বা টিভি জোরে চালাবেন না। বারবার পড়তে বস বা কোন কাজ জোর করে করাবেন না।

অসংখ্য ধন্যবাদ ডাক্তারবাবু। আপনিও সুস্থ থাকুন, নিজের যত্ন নিন।