সৈরিন্ধ্রী : ডঃঅশোকা রায়।

0
610

এ এক তৃতীয় লিঙ্গের গল্প। এ আমার গল্প। যে আমি ভালোবাসার জন্য বোধহয় মাতৃ গর্ভ থেকে লালায়িত।মনে হয় জঠরের জলের স্রোতে ফিসফিস করেছি, চাই ভালোবাসা। কিন্তু
যে ভালোবাসার বাসনায় পৃথিবীতে প্রথম আলোর মুখ দেখেছিলাম,
সে ভালোবাসা কি পেয়েছি ?
না বোধহয়। সর্বত্র খালি বঞ্চনা আর প্রতারণা। ছোটোবেলায় মা আমার জন্য লজ্জা পেতো। আর ঠাকুমা বিরক্তি প্রকাশ করতো। এই বিরক্তি তার প্রাতঃকালে শুরু হতো, থামতো গিয়ে মধ্য রাতে নানাবিধ আক্ষেপের পর । ঘুম আসতো না বয়সোজনোচিত নিদ্রা হীনতায় ভোগার কারণে। সুতরাং তখন তার আমার জন্মের ব্যাপারে বিষোদ্গার খুব স্বাভাবিক। সুতরাং ঠাকুরমার ভালোবাসা আমার কাছে অলীক স্বপ্ন।যদিও আমি ভালোবাসার কাঙাল,তবুও এতোটা বুরবক নই যে, আশা করবো, আজ না হয়, কাল ঠাকুরমা তার ভুল বুঝে হঠাৎ একদিন আমায় ভালোবাসতে শুরু করবে।
বাবা পারতপক্ষে আমার মুখ দেখতে না। আর দেখার দরকারও হতো না।
আমার বাস চিলেকোঠার ঘরে। আমি না পুরুষ, না নারী। হিজড়া। তাই ভদ্রলোক বাড়িতে আসন্তি- যাওন্তি দের সামনে বেরোনো আমার বারণ। আমি জন্মেছি আঠারো বছর ন মাস আগে। আমার জন্মদিন পালন হয় না।কিন্তু মা ঠিক খেয়াল করে আমার জন্মদিনে একটু পায়েস বানিয়ে দুপুরে আঁচলের আড়ালে বাটি নিয়ে চিলেকোঠার আসে। আমি পায়েস খাই। মায়ের চোখে আনন্দের বৃষ্টি,আমার মনে আনন্দবাজারের কলরোল। পরে বুঝেছি এ’ মায়ের আনন্দ নিজের প্রথম গর্ভের প্রতি কর্তব্য পালনের জন্য।তবু মায়ের প্রতি আমার আকর্ষণ আছে। তার আঁচলের গন্ধের জন্য আমি অধীর হই। মা বোঝে না সে কথা। অবশ্য আমাকে হিজরাপল্লীতে যেতে হয় নি, আমার মায়ের জন্য আর মায়ের প্রতি এ ‘ ব্যাপারে বাবার প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের জন্য। আর এই কারণে ঠাকুমার আমার সম্পর্কে বীতরাগ তুঙ্গে। বাবার সামনে কিছু বলতে পারে না ঠাকুমা, নিজের একমাত্র সন্তানের অসন্তোষের ভয়ে। তাই বাবার বাড়িতে গরহাজিরার সময়ে ঠাকুরমার রোষের অনলে পুড়ি আমি। নীচে নামি না। মানে নামার দরকার হয় না।ঠাকুরমা ছুতোনাতায় দূরে আসে ছাতে নানা অছিলায়।শুরু হয় আমার প্রতি তুচ্ছাতাচ্ছিল্যের বহর। ছাতেরএক কোণে আমার বাথরুম। একান্ত ভাবে আমার নিজস্ব। তাই ওটা আমার বড়ো প্রিয়। ওখানে আমার কথা হয় আমার কারিগরের সাথে। তবে কারিগর বড়ো অবুঝ। কানে একরাশ তুলো, আর পিঠে এক বিশাল কুলো। ক্ষোভ ওগরানো বৃথা। তবুও ওগরাই নিভৃতে। সমাধান কিছু বাতলে দেয়ার ইচ্ছেটা তার নেই। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন, যেদিন মা সর্বাঙ্গ ঠিকঠাক এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিল। ভগবান নামের কারিগর কে নালিশ জানিয়েছিলাম, “আমাকে গড়তে তোমার ব্যতিক্রমী সাধ হলো কেনো? ”
যথারীতি তার কাছ থেকে কোনো উত্তর আসেনি। তবে ভাই হওয়ার পর ঠাকুরমার আমার প্রতি রোষে অনেকটাই খামতি ঘটে। তার কারণ আমার ওপরে ঠাকুরমার মানসিকতার পরিবর্তন নয়, খুঁত বিহীন নাতি নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ততা। অবশ্য ঠাকুরমার আমার সম্পর্কে বিরক্তি চিরকালই আমাদের বাড়ির আবহাওয়ায় ঘুমশুম নিম্নচাপ হয়ে অবস্থান করেছে। সরেনি, অথচ তোলপাড় ঝড়বৃষ্টিও হয়নি। কারণ সংসারের কূটনীতি ভালোভাবে আয়ত্ত থাকা আমার ঠাকুরমা চেতন বা অবচেতনে চায়নি, আমার খামতির কারণে আমাদের পরিবার পাড়ার লোকদের বা আত্মীয় স্বজনদের কূটকচালির সম্মুখীন হোক। তাই ভাই হয়ে আমি একদিক দিয়ে ভালোই ছিলাম। আপনমনে থাকতাম। তা ছাড়া উপায় কি? বুঝতাম বাবা মুখে কিছু না বললেও, আমার এই জন্ম
নিয়ে খুশি নয়। আমার ন্যুনতম প্রয়োজন পূরণ করত। অতিরিক্ত কিছু নয়। অতিরিক্ত বিলাসবহুল জিনিসের প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল না। চাইতাম বাবারা তাদের মেয়েদের যেমন ভালোবাসে, তেমনি বাবা আমাকে কাছে ডাকুক, একটু ভালোবাসুক। মায়ের আমার প্রতি বত্রিশ নাড়ির টান একটা ছিল মানছি। কিন্তু আমার মনে হতো, সেই টান ঠিক সে অর্থে ভালোবাসা নয়। মা’ ইচ্ছে করলে বাবা ঠাকুমা কে রাজি করিয়ে আমাকে চিলেকোঠার বন্দী জীবন থেকে অনায়াসে মুক্তি দিতে পারত। কারণ মা বাবার কাছে স্ত্রীর মর্যাদা পায়। আর ঠাকুরমার কাছে পুত্রবধূর ভালোবাসা। কিন্তু মা সে চেষ্টা আজ পর্যন্ত করেনি। তবে আমাকে কটূক্তিও করেনি। তবুও বলব মায়ের ভালোবাসা আমি পাই নি। ভালোবাসার খিদে আমাকে কুরে কুরে খেতো। কিন্তু মেনে নিয়েছিলাম ভালোবাসা হীন সে জীবন। বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, হিজড়েদের ভালোবাসতে নেই, ভালোবাসা পেতে নেই। কিন্তু একসময় ভালোবাসা এলো জীবনে। ভাই তখন বছর ছয়ের, আর আমি ঊনিশ পেরিয়ে গেছি। ভাই হৈ হৈ করে ছাতে। সেদিন বিশ্বকর্মা পুজো। ভায়ের পেছনে এক পুরুষ, হাতে এক গোছা ঘুড়ি। ভায়ের হাতে মাঞ্জা সুতো ঠাস করে পেঁচানো লাটাই। আমি থাকি নারী বেশে। ছাতের পাঁচিলে শাড়ি মেলতে এসে আর পালাতে পারি নি। কাঁচপোকার মতো আগন্তুকের দুচোখে আমার দুচোখ আটকে গেছে। কয়েক মুহুর্তের পর নিজেকে ফিরে পেয়েছি। আগন্তুক ভাই কে প্রশ্ন করেছে, ” উনি? ” ভাই শেখানো বুলি কপচেছে নিরাসক্ত মুখে, ” দিদি। ” বুঝেছি ঐ শিশুও আমাকে ভালোবাসে না। তবু বলেছি,
” উনি কে ভাই? ” ভায়ের ভারি দায় পড়েছে, আমার কথার জবাব দেয়ার, ” ও মাস্টার মশাই, চলুন, চাঁদিয়ালে কল বাঁধি। ” মাস্টার মশাইয়ের মৃদু ধমক ভাইকে, ” ছি: এরকম করে না। বড়ো দের কথার উত্তর দেয়া সহবত।” তারপর আমার কথার উত্তর নিজেই দিয়েছে, ” আমি সম্বিত, সম্বিত বসু। তপুর মাস্টার মশাই। আসুন না ঘুড়ি ওড়ানো দেখবেন।” অমান্য করতে পারি নি তার কথা। সেই শুরু। এরপর সম্বিত পড়ানোর শেষে এসেছে আমার চিলেকোঠার ঘরে। নানা গল্প হাসিতে সময় কেটেছে।মাস ছয়েক। আমি স্বপ্ন দেখতে শিখেছি।নীল সমুদ্র কে কাছে পেতে চেয়েছি, যে সমুদ্রের সাথে আমার পরিচয় ছবিতে।হঠাৎ একদিন মা- বাবা যুগলে আমার কাছে এসেছে। দুজনেই গম্ভীর। জেনেছি, সম্বিত বিয়ে করতে চেয়েছে আমাকে। আমি বলেছি, ” তা কি করে হয়? ” মা স্পষ্টতঃ বিরক্ত, ঝাঁঝালো জবাব এই প্রথম,” গল্প করার সময় মনে ছিল না? এখন এই ফ্যাসাদ কাটাই কি করে? ” বাবার স্বল্প কথা, ” সম্বিত কে তোমার কথা লুকোই নি। ”
মা বলেছে, তাতেও ও তোমাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু তার পরিবারের কাছে এখন গোপন থাকবে তোমার জন্ম- বৃত্তান্ত। পরে জানাবে। তাতে আরো বিপদ। জেনেশুনে তবু একরকম। কিন্তু সম্বিত একবগ্গা। বলে, আমার পরিবারের ব্যাপার, আমি বুঝব। ” চুপ করে থেকেছি। সম্বিত আমায় ভালোবাসে, বড়ো লোভ আমার সেই ভালোবাসার প্রতি। আপত্তি করতে পারিনি। এই প্রথম একজন আমায় ভালোবেসেছে। ফেরার কি করে?
বিয়ে হয়ে গেলো এক হিজড়ের এক পূর্ণ পুরুষের সাথে। সম্বিত পাগলের মতো ভালোবাসে আমাকে। শ্বশুর শ্বাশুড়ী খুশি আমার ব্যবহারে আর কাজকর্মে। কেউ প্রশ্ন তোলেনি আমার জন্ম নিয়ে। ভেবেছি সম্বিতের কাছে শুনেছে সব। আমার সংকোচ হবে বলে আমাকে জানায় না। আমার কারিগর অলক্ষ্যে বসে হাসলো, ‘ওরে পাগলি, ভালোবাসা সকলে কি পায়? ‘
সেদিন বসন্তের দুপুর। আমি চুল এলিয়ে রাস্তায় চোখ রেখে জানলার গরাদ ধরে। বাপের বাড়িতে থাকতাম একটেরে চিলেকোঠায়। রাস্তা দেখা যেত না সেখান থেকে, এমনকি ছাত থেকেও নয়। কারণ আমার বাবার বাড়ির সামনে বিশাল বাগান। তাই বাসিন্দাদের আব্রু যথেষ্ট পরিমাণে। আর আমার শ্বশুর বাড়ি আধুনিক ধাঁচের। হাওদা-হাট সব কিছু। ঘরের সকলের ভালোবাসা পেতে এত লালায়িত আমি, বাইরের পানে এতোদিন দৃষ্টি বিশেষ যায়নি। আজ জানালায় দাঁড়িয়ে দেখি একদল হিজড়ে বটতলার চাতালে ঢোলক বাজাচ্ছে। হঠাৎ তাদের একজন হাততালি দিয়ে নাচতে শুরু করলো, “কার হলো গো? বেটা না বেটি? ” আমারও হাততালি দিতে ইচ্ছে করলো। হিজড়েরা আমার শ্বশুর বাড়ির বেল বাজাচ্ছে। আমি দেখছি, শ্বাশুড়ির গালে হাত, “ওমা, তাই না কি! আমারও যেন প্রথম থেকে কেমন কেমন লাগতো। ছেলেকে বিশ্বাস করতাম, তাই সন্দেহ হলেও মনকে সান্ত্বনা দিই। ” শ্বশুর বলে, “তোমরা নিয়ে যাও ওকে। ” আমার গোত্রের মানুষ গুলো বলে, ” এ সব জায়গা তোমার জন্য নয়। চলো আমাদের সঙ্গে। ” অস্ফূটে বলেছি, “সম্বিত কে আসতে দাও।ও আমাকে বড়ো ভালোবাসে। ” শ্বশুর বলেছে, ” তুমি এসো বাছা। আমাদের ছেলে আমরা বুঝে নেবো। ”
আমি এখন হিজড়া পল্লীতে।
সম্বিত দেখা করতে এসেছিল আমার সাথে সস্ত্রীক বছর খানেক বাদে। সম্বিতের এখনকার স্ত্রী পরিপূর্ণ নারী। ভারি মিষ্টি স্বভাব। হাত ধরে বলেছে আমার, ” দিদি, তুমি চলো তোমার বাড়ি। ” হেসেছি আমি, ” আমি তো দিদি নই বোন। আমি সৈরিন্ধ্রী। ” হেসেছে জয়ী, সম্বিতের এখনকার বৌ, তোমাকে আমি চোরকাঁটা বলে ডাকব। সম্বিতের মনে যে তুমি চুরি করে প্রথম ভালোবাসার কাঁটা বিঁধিয়ে দিয়েছিলে তোমার চিলেকোঠার ঘরে। ভেবেছো বুঝি কিছু জানি না? ” হেসে লুটোপুটি জয়ী। আমি বলেছি, সম্বিত কে তুমি জয় করেছেন জয়ী। ” ” এমা ভালোবাসার তুমি কিচ্ছু বোঝো না। সম্বিত তার সৈরিন্ধ্রী বিনা কিছু জানে না।” আমার চোখ নীচু শ্রাবণ- মেঘের ভারে। টপটপ করে জল গড়াচ্ছে। জয়ী হাতের অঞ্জলিতে সেগুলো ধরছে আর ভাবছে, এ যে ভালোবাসার মুক্তো। অনেক অনেক দামি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here