জানুন কীর্তনের এক ইতিহাস—প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামী (পর্ব-১২) : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
1000

বর্তমান কিছুদিন যাবৎ কীর্তন-কীর্তনীয়া নিয়ে নানান কথা আলোচনা চলছে। এসব পড়তে, শুনতে আর তাতে একটু-আধটু অংশগ্রহণ করার ফাঁকেই মনে এল , এত সবের মাঝে কীর্তন নিয়ে কিছু ইতিহাস আপনাদের কাছে তুলে ধরি। আমি আমার পরমেষ্ঠী শ্রীগুরুদেব ভারত বিখ্যাত ভক্তিশাস্ত্র ব্যাখ্যাতা প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামী সিদ্ধান্ত রত্নকে নিয়ে এযাবৎ বেশ অনেকগুলি পর্বে লেখা প্রকাশ করেছি। আজ কীর্তন জগতে ওঁনার এক বিশেষ অবদানের কথা আপনাদেরকে জানাবো‌। আমি নিশ্চিত আপনারা জেনে আনন্দ যেমন পাবেন তেমনই বিস্মিত হবেন যে এমনটা তো জানা ছিল না(!), এই ভেবে।
১৩২৪ বঙ্গাব্দ। অর্থাৎ কিনা ওই ১৯১৭ বা ১৯১৮ সালের কথা বলছি। কলকাতার ২নং প্যারীমোহন লেনে শ্রীবুদ্ধ কুন্ডুর বাড়িতে প্রভুপাদের পাঠ চলছে বেশ কয়েকদিন ধরে। একদিন বুদ্ধবাবু অনুরোধ রাখলেন প্রভুপাদের কাছে, “প্রভু, একটি কম বয়সী ছেলের সঙ্গীত পরিবেশন করার কথা আজ আসরে। আপনি যদি ওর গান একটু শোনেন কৃপা করে। খুব ভালো হয়।” প্রভুপাদ রাজী হলেন। সন্ধ্যায় ছেলেটি সেজেগুজে আসরে প্রবেশ করলেন। আসর থেকেই প্রভুপাদের উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করলেন। ব্যস অমনই দূরদর্শী প্রভুপাদের তাঁকে মনে ধরে গেল, বুঝে গেলেন যাঁকে তিনি এতদিন ধরে সন্ধান করছিলেন, এই সেই আদর্শ কীর্তনীয়া। তাঁর বিচক্ষণ অভিজ্ঞ নয়ন চিনে নিল তাঁকে। প্রভুপাদের দু-চোখ তখন এদিক ওদিক চেয়ে বুদ্ধবাবুকে খুঁজছে। বুদ্ধবাবু প্রভুপাদের চাহনি দেখে ছুটে এলেন, “প্রভুপাদ, কিছু বলবেন?” প্রভুপাদ ছেলেটি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। শুনলেন নবদ্বীপেই নাকি বাস তাঁর। আরও যেন আনন্দ পেলেন শুনে। তিনি আদেশ দিলেন কীর্তন শেষে যেন তাঁর সাথে দেখা করেন ছেলেটি।
আসর শেষ হলে ছেলেটি এলেন প্রভুপাদের কাছে। প্রভুপাদ তাঁকে বললেন, “ শোন , আমি তোমাকে দিয়ে এক বিশেষ ধরণের কীর্তন গাওয়াতে চাই। সেই কীর্তনে শুধু কীর্তন নয় নৃত্যও থাকবে, অভিনয়ও থাকবে। আর ঠিক তোমায় আমি যা যা বলবো তেমনটা করতে হবে। আমার নির্দেশ মেনে চলতে হবে প্রথম থেকে শেষ অবধি । আমার দেখানো পথেই তোমায় হাঁটতে হবে । স্বতন্ত্রতা চলবে না। তুমি রাজী আছো ? আর হ্যাঁ ,তোমার ভরণ-পোষণের সব দায়িত্ব এখন থেকে আমার হবে ।”
ছেলেটি অনুধাবন করে নিলেন এবার তিনি মহদাশ্রয় পেতে চলেছেন। আর তাঁর নিজের জন্য কিছু চিন্তা করতে হবে না। এবার এই নিতাইচাঁদই সব করিয়ে নেবেন তাঁকে দিয়ে। তাই ছেলেটি শুধু বললেন, “আপনি আমায় গড়েপিটে নেবেন মনোমত করে, যেমন আপনার ইচ্ছে হয় করবেন ।” একথা বলেই প্রভুপাদের চরণে পড়ে প্রণাম করলেন‌।
এখন নিশ্চয়ই আমার প্রিয় পাঠককুলের মনে প্রশ্ন জাগছে , প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামী তাহলে কোন কীর্তনের সূচনা করলেন? তাই না! হ্যাঁ, জানবো তো বটেই। আসুন ফিরে দেখি।
খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতক থেকে আমাদের গৌড়দেশে পদাবলীর মাধ্যমে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের লীলাকাহিনী কখনো কাহিনীর আকারে, কখনো গানের আকারে বাঙ্গালী সমাজকে মজিয়ে রেখেছিল । তবে পদাবলী কীর্তনের মাধ্যমে রাধাকৃষ্ণলীলা প্রচার বা আস্বাদন ব্যাপক ভাবে শুরু হয় শ্রীমন্মহাপ্রভুর আগমনের পর থেকে। কারণ, সর্বাবতার অবতারী শ্রীমন্মহাপ্রভুর মহাবদান্যতা গুণেই ভক্তি আন্দোলন প্রভাব বিস্তার করে শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প থেকে শুরু করে কীর্তনে ও সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। ফলস্বরূপ পদাবলী সাহিত্যে এবং পদকীর্তন পরিবেশনে এক নবোদ্দীপনা আসে ও নবদিগন্ত সূচীত হয়। শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধিত বহু বহু পদ-পদাবলী রচিত হতে থাকে সে সময়ের পদকর্তাদের দ্বারা। বলা যায় পদ রচনা ধারায় যেন এক নব জোয়ার চলে আসে। শ্রীযুগলের নানান সময়ে নানান লীলাকে আশ্রয় করে অষ্টকালীয় পদ রচিত যেমন হতে থাকে, তেমন আবার সেসব পরিবেশিতও হতে থাকে পদাবলী কীর্তনের মাধ্যমে। কিন্তু শ্রীমন্ মহাপ্রভু যখন ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে অপ্রকট হয়ে গেলেন, তখন তাঁর পরবর্তী যুগে তাঁকে স্মরণের জন্য আকুল প্রাণ পার্ষদেরা, ভক্তেরা তথা পদকর্তারা রচনা করতে থাকলেন নানা গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ আপন আপন ভাবের ভিয়ানে। ১৫৮৩ খ্রীস্টাব্দে শ্রীল ঠাকুর নরোত্তমের উদ্যোগে যখন খেতুরী মহোৎসব হল , যা কিনা বৈষ্ণব ইতিহাসের প্রথম বৈষ্ণব মহাসম্মেলন বা মহাসঙ্গীতী তখন সেই উৎসবে শ্রীমন্নিত্যানন্দ পত্নী মা-জাহ্নবা, পুত্র প্রভুপাদ বীরচন্দ্র, আচার্য শ্রীনিবাস ঠাকুর, নরোত্তম ঠাকুরসহ অন্যান্য বৈষ্ণব মহাজনবৃন্দের উপস্থিতিতে স্থির করা হল যে, এখন থেকে কীর্তনে প্রথমে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে স্মরণ করা হবে, তারপরে রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক কীর্তন গাওয়া হবে। অর্থাৎ, প্রথমে হবে গৌরচন্দ্রিকা বা গৌরগুণ বর্ণনা-গৌরাঙ্গের কথন। তারপর শ্রীযুগলকীর্তন করতে হবে। সেসময় থেকে কথাবার্তা বা গানের মধ্য দিয়েই গৌরস্মরণ চলতো কীর্তনের আসরে। কিন্তু, রাধাকৃষ্ণের ক্ষেত্রে যেমন অষ্টকালীয় লীলার পদ ছিল, তেমনটি শ্রীগৌরসুন্দরের ক্ষেত্রে ছিল না। প্রথম গৌরলীলা পালাকীর্তন রচনা করেন প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীই। শ্রীগৌরের লীলা ভিত্তিক কীর্তন রচিত হয় তাঁর দ্বারাই। সর্বপ্রথম উদ্যোগী এ ব্যাপারে তিনিই হন। কিন্তু, রচনা করলেই তো হবে না, সেগুলির কীর্তন করা না হলে তো রচনাই সার। তাই প্রয়োজন গৌরভাবে ভাবুক উপযুক্ত কীর্তনীয়ার। আর তাই প্রভুপাদের অন্তর্নয়ন তেমন কীর্তনীয়ার সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল । প্রবন্ধের প্রারম্ভে প্রভুপাদ ও সেই কীর্তনীয়া ছেলের যে গল্প করলাম—- সেই ছেলেটিই হলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা কীর্তনীয়া ‘সংকীর্তন কলানিধি’ শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ পাঠক– যিনি প্রভুপাদের হাতে তৈরী ।
প্রভুপাদ বুঝলেন যে এই ব্রজেন্দ্রনাথের‌ দ্বারাই কার্যসিদ্ধি হবে। তাই প্রভুপাদ তালিম দেওয়া শুরু করলেন নিজস্ব উদ্যোগে। পদাবলী লেখেন, সুর সৃষ্টি করে, নৃত্যের তালিম দিয়ে সরস, প্রাঞ্জল এক অভিনব কীর্তন আঙ্গিকের সূচনা করলেন—– যা হল গৌরলীলা পদাবলীকীর্তন।
প্রায় সাত-আটটি গৌরলীলা পালা কীর্তন লেখা হল ও তালিম দিয়ে শেখানো হল। যেমন নিতাই-গৌর মিলন লীলা ,জগাই-মাধাই উদ্ধার লীলা, চাপাল-গোপাল উদ্ধার লীলা, হরিদাস নির্য্যান লীলা ইত্যাদি। টানা এক বছর তালিম দেবার পর, এবার জনসমক্ষে আসার উপযুক্ত হলেন ব্রজেন্দ্রনাথ। কলকাতার চিৎপুর থেকে সাজগোজের সরঞ্জাম আনানো হল। ১৩২৫ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৯১৮ সালে নবদ্বীপে মদনমোহন মন্দিরেই কীর্তনাসর আয়োজিত হল। এক শুভ দিনে নবদ্বীপের পন্ডিত সমাজসহ সকল ভক্তদের আমন্ত্রণ করা হল গৌরলীলা পালাকীর্তন দর্শনের জন্য।
প্রভুপাদ একটু চিন্তিত ছিলেন এই নব আঙ্গিকের গৌরলীলা পালাকীর্তন কেমন লাগবে নবদ্বীপের বিদগ্ধ পন্ডিতজনেদের, বা তাঁরা বিষয়টা কতখানি গ্রহণ করবেন তা নিয়ে! নবদ্বীপের সকল বৈষ্ণবরা উপস্থিত হলেন। সকলের সম্মুখে গৌরলীলা পালাকীর্তন শুরু করলেন ব্রজেন্দ্রনাথ । দেখা গেল কীর্তন শুরু হতে না হতেই আসর যেন জমে গেল। আনন্দিত হয়ে মাথা-নেড়ে, হাত-শরীর দুলিয়ে, তাল ঠুকে কীর্তনের রসাস্বাদন করতে থাকলেন দর্শকেরা। মধ্যে মধ্যেই হরিধ্বনিতে ভরিয়ে দিতে থাকলেন তাঁরা। প্রভুপাদ প্রাণগোপাল নিশ্চিন্ত হলেন যে তাঁর প্রয়াস সফল হয়েছে তাহলে। মানুষ মন থেকে স্বাগত জানিয়েছে এই ধরনের গৌরলীলা পালাকীর্তনকে।সকলে ধন্য ধন্য করে আবেগাশ্রিত হলেন, প্রেমাপ্লুত হলেন।
শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের অষ্টকালীয় লীলার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তবে থেকে সহজ সরল ও সর্বসাধারণের উপভোগ্য অথচ সুসিদ্ধান্তপূর্ণ গৌরলীলা পালা কীর্তনের প্রবর্তন হল। অতএব আজ যে গৌরলীলা পালাকীর্তন শ্রবণের আনন্দাবেগে আমরা ভাসি——তার পথিকৃৎ বা স্রষ্টা কিন্তু নিত্যানন্দ বংশাবতংস ভারত বিখ্যাত ভক্তিশাস্ত্র ব্যাখ্যাতা প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীই। যদিও আমরা তা জানি না অনেকেই। না, শুধু আমরা নই অনেক কীর্তনীয়ারাও হয়তো বা জানেন না।
প্রভুপাদ ভাবলেন , শ্রীধাম নবদ্বীপে যখন সকলের মনে ধরেছে, ছাড়পত্র পাওয়া গেছে এমন কীর্তনের , তবে এবার বৃন্দাবনের ভজনানন্দী, ভজনানুরাগী বৈষ্ণবদেরও মতামত প্রয়োজন। তাই, প্রভুপাদ বৃন্দাবনে গৌরলীলা পালাকীর্তনের আসর বসালেন। বৃন্দাবনের সকল বৈষ্ণবগণ আমন্ত্রিত হলেন অভিনব আঙ্গিকে গৌরলীলা আস্বাদনের জন্য। সেই পালাকীর্তন শ্রবণ করে শ্রীবৈষ্ণবগণ এত আনন্দ পেলেন যে নয়ন জলে ভেসে যেতে থাকলেন গৌরলীলা স্মরণ করে।
সেসময়ে সিদ্ধ পন্ডিত রামকৃষ্ণ বাবা কারোর প্রণাম নিতেন না বা কখনও দিতেন না কারোকে প্রণাম করতে। তিনি পর্যন্ত ব্রজেন্দ্র পাঠকের দিকে নিজের শ্রীচরণ দুটি বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘লে লে বাবা, যিত না খুশ লে লে!” আপ্লুত, আনন্দিত হয়ে সকলে তাঁরা ব্রজেন্দ্র পাঠককে উপাধি দিয়েছিলেন ‘সংকীর্তন কলানিধি’।
গৌরলীলা পালা প্রভুপাদ কী ভাবে লিখতেন জানেন? শ্রীমধুসূদন দাস বাবাজী মহারাজ সর্বক্ষণ বাবার ছায়াসঙ্গী হয়ে ঘুরতেন হাতে কাগজ কলম নিয়ে । প্রভুপাদের যেই এক লাইন, এক কলি কিছু মনে আসতো, তিনি অমনই বলতেন , আর তা লিখে নিতেন মধূসুদন বাবা । প্রভুপাদের তো আহারে, বিহারে, শয়নে, স্বপনে, জাগরণে সর্বদা ওই এক চিন্তা, এক ধ্যানজ্ঞান গৌরলীলা ভাবনা। এমনও হত যে, হয়তো প্রসাদ পেতে বসেছেন, হয়তো বা বিশ্রাম নিচ্ছেন, সেসময় প্রভুপাদের মনে পড়লো কোন কলি, সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলতেন, “মধুসূদন, তাড়াতাড়ি এখুনি লেখো, ভুলে গেলে আর ফিরে পাবো না।” একবার তো এমন হল ঘুমন্ত মধুসূদন বাবাকে ডেকে তুলে তাঁকে দিয়ে লেখালেন—-“সুরধনী তীরে ও কে যায় ধূলিমাখা দুটি রাঙ্গা পায়…” প্রভুপাদ গৌরলীলার পদ রচনা করতেন, আর তাতে সুরারোপ করে তারপর নিজে নৃত্য করে, হাত-পায়ের অঙ্গভঙ্গী করে ব্রজেন্দ্র পাঠককে তালিম দিতেন। অথচ, বিস্ময়ের ব‍্যাপার এটাই যে, প্রভুপাদ নিজে কখনো নিত্য-সঙ্গীত শেখেননি বা অভ্যাসও করেননি।
আবার শ্রীমন্মহাপ্রভু মুখোদ্গীর্ণ হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র যে উচ্চৈঃস্বরে কীর্তন করা হয়—-এর হোতাও কিন্তু এই প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীই। তিনি না থাকলে এতদিনে মহামন্ত্র কীর্তন হয়তো বা পুরোপুরি বন্ধই হয়ে যেত। পড়ে নিশ্চয়ই পাঠক অবাক হচ্ছেন! পুরো ঘটনা কোন এক সংখ্যায় প্রভুপাদ কৃপা করলে আবার জানবো আমরা।

———-ভক্তকৃপা প্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।