বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী জয়িতা বল চ্যাটার্জীর একান্ত সাক্ষাৎকার।

0
7266

নমস্কার, আমি দেবশ্রী হাজরা। আমি সব খবর এর পক্ষ থেকে একান্ত আলাপচারিতায় মুখোমুখি হয়েছি বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী জয়িতা বল চ্যাটার্জীর। শুনে নেব শিল্পীর গান আর তার সাথে মনের কিছু কথা। জয়িতাদি স্বাগত তোমাকে।

– ধন্যবাদ দেবশ্রী। সব খবর কে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

সম্প্রতি তুমি তারা নিউজ চ্যানেল থেকে সম্মানিত হয়েছ। এই ব্যাপারে তোমার অনুভূতি কিরকম?

– যে কোন সম্মাননাই আনন্দের। সেটা যখন তারা নিউজের মত একটা জনপ্রিয় চ্যানেল থেকে দেওয়া হয় তখন সেই আনন্দের অনুভূতিটা অবশ্যই একটু অন্যরকম হয় আর এটা ছিল আন্তর্জাতিক সম্মাননা। শিক্ষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিকিৎসা, সমাজ কল্যাণ সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের প্রায় ছ’শো ব্যক্তিকে ওরা একই মঞ্চে সম্মাননা জানায়। এদের মধ্যে সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে ওরা তিনজনকে মনোনীত করে। সেই তিনজনের মধ্যে আমি থাকতে পেরে অবশ্যই ভীষণ আনন্দ পেয়েছি আর ব্যক্তিগতভাবে আমার আরো ভালো লেগেছে আমার গানের এলবাম ‘মনতারা’ স্বীকৃতি পেয়েছে বলে। আমার গাওয়া ‘মনতারা’ এলবামটির জন্যই ওরা এই সম্মাননার জন্য আমাকে মনোনীত করে। ‘মনতারা’ হওয়ার পিছনে বহু মানুষের বহু পরিশ্রম রয়েছে। সকলের এই পরিশ্রম স্বীকৃতি পেয়েছে এটাই আমাকে সবথেকে বেশি তৃপ্তি দিয়েছে।

পুরস্কার বা সম্মাননা একজন শিল্পীর কাছে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ?

– খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভবিষ্যতে আরো ভালো কাজ করার প্রেরণা দেয় এই পুরস্কার বা সম্মাননা। নিজের কাজের স্বীকৃতি পেলে একটা আত্মবিশ্বাসও জন্মায় মনে।

মনতারা এলবামের একটা গান আমাদের শোনাও

– গান

 গানের প্রতি ভালবাসাটা কিভাবে জন্মায়?

– ছোটবেলা থেকেই আমি সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বড় হয়েছি। আমার জন্ম যেখানে সেই ত্রিপুরার খোয়াই শহরটি ছিল সংস্কৃতির পীঠস্থান। আমার মামা সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন আর আমার বাবু (বাবা), মা অসম্ভব গান ভালবাসতেন। ওনারাই আমাকে গানের কম্পিটিশন, গানের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। সেই সময় টাউন হলে গীতিনাট্য, গীতিআলেখ্য, নৃত্যনাট্যের অনুষ্ঠান হত। বন্ধুবান্ধব, দাদা- দিদিদের সঙ্গে আমিও অংশ নিতাম। বাড়িতে সারাদিন রিহার্সাল হচ্ছে, গান বাজছে, নাচ হচ্ছে, আবৃত্তি হচ্ছে; বিশাল হইহই ব্যাপার। এই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বড় হয়েছি বলেই খুব ছোট থেকেই গানের প্রতি একটা ভালবাসা জন্মে গেছে।

শৈশবের কোন অনুষ্ঠানের স্মৃতি?

– আমি তো খুব ছোট থেকেই প্রোগ্রাম করতাম। বড়দের অনুষ্ঠানের আগে আমার একটা গান বা নাচ কিংবা আবৃত্তি থাকত। তখন আমার তিন বছর বয়স। সেটাই ছিল আমার প্রথম মাইক ধরা। আমি গান গেয়ে স্টেজ থেকে নেমে আসতে যাচ্ছি তখন দেখি একজন ভদ্রলোক পিছন থেকে এসে আমায় কোলে তুলে নিয়ে খুব উৎসাহ দিলেন। ওই ছোট্ট বয়সে আমার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না ওই ভদ্রলোক কে বা কত বড় মানুষ। শুধু মনে আছে সেটা দেখার পর সারা হলের লোক উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে আর স্টেজ থেকে নামার পর আমাকে কোলে তুলে নিচ্ছে, আদর করছে। পরে জেনেছি সেই ভদ্রলোক ছিলেন বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক মৃণাল সেন।

এমন কোনও অনুষ্ঠানের স্মৃতি যেটা এখনো মনে দাগ কাটে?

– বেশ কয়েক বছর আগে আমি রেওয়া পত্রিকার আমন্ত্রণে কলকাতায় এসেছিলাম। সেটাই ছিল আমার কলকাতায় করা প্রথম গানের অনুষ্ঠান। রেওয়া পত্রিকা থেকে সেবার আমাকে সারস্বত সম্মানে সম্মানিত করা হয়। পাণ্ডব গোয়েন্দার স্রষ্টা সাহিত্যিক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় আমার হাতে স্মারক সম্মাননা তুলে দেন। সেই অনুষ্ঠানটাও খুব জমজমাট হয়েছিল। বেশ মনে আছে আমার লোকগানের তালে তালে বহু মানুষ আসন ছেড়ে উঠে নাচতে শুরু করেছিল।

তুমি গানের অনুষ্ঠান করার পাশাপাশি বেশ কিছু স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রেও গান গেয়েছ। সেগুলোর সম্পর্কে কিছু বলো?

– আমি এখনো অবধি ‘কৃত্রিম বেলি,’ ‘সুখের ঠিকানা’ আর ‘অন্ধের প্রেম’ এই তিনটে স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রে গান গেয়েছি। আরো একটা ফিল্মে গান গাওয়ার কথা চলছে।

এপার বাংলা ওপার বাংলার শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তুমি বেস্ট প্লে ব্যাক সিঙ্গার এওয়ার্ড পেয়েছিলে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা?

– ডিজিটাল ওয়ান্ডারল্যান্ড আয়োজিত দুই বাংলার শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে নির্মাল্য বিশ্বাসের কথা ও সুরে ‘ভোলামন’ গানটির জন্য আমি বেস্ট সিঙ্গার এওয়ার্ড পাই। জুরি ছিলেন বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক কমলেশ্বর মুখার্জি, সুদেষ্ণা রায়, অভিজিৎ গুহ এবং শিল্প নির্দেশক তন্ময় চক্রবর্তী। হাওড়ার শরৎ সদনে এই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে কমলেশ্বর মুখার্জির হাত থেকে যখন পুরস্কার নিচ্ছিলাম তখন নিজেরই অবিশ্বাস্য লাগছিল। উনি আমার গানের প্রশংসা করেছিলেন, সেটাও আমার কাছে একটা মস্ত বড় পুরস্কার।

তোমার এলবাম ‘মনতারা’। মর্মস্পর্শী গানের এই এলবামটি তৈরি হওয়ার পিছনে তোমার মনের খবর জানতে চাই?

– ‘মনতারা’এলবামটি তৈরি হওয়ার পিছনে অনেক দিনের একটা গল্প আছে। আমার দীর্ঘ দিনের বন্ধু নির্মাল্য বিশ্বাস বেশ কিছু গান লেখে এবং তাতে সুরারোপ করে। ও আমাকে বলল, ‘আমার অনেকগুলো গান রেডি হয়েছে। আমি একটা এলবাম করতে চাই। তুই এই গানগুলো গাইবি।’ তখন আমার নিজের প্রতি সেই আত্মবিশ্বাস ছিল না যে আমি গানগুলো গাইতে পারব। আমি তখন রাজী ছিলাম না। বললাম, ‘আমি এখনো তৈরি হইনি। আমার অনেকটা সময় লাগবে।’ কারণ এই এলবামে এগারোটা গান আছে। এতোগুলো গান গেয়ে তৈরি করা খুবই কঠিন ছিল। তখন মনে হত না যে আমি পারব। কিন্তু নির্মাল্য ধীরে ধীরে আমাকে সাহস দিল সেই সাথে এই এলবামটির মিউজিক যিনি কম্পোজ করেছেন সেই শ্রদ্ধেয় বিল্ব স্যারও আমাকে সাহস দিলেন এবং গানগুলোর অপূর্ব সুর তৈরি হল। সেই সুর শুনে আমার মনে হল গানগুলো আমিই গাইব; এই সুরগুলো আমার জন্যই তৈরি করা হয়েছে।

গায়িকা না হলে কী হতে?

– চাকরিই করতাম হয়তো। একটা সময় ত্রিপুরার স্কুলে শিক্ষকতা করেছি আবার একটা সময় ত্রিপুরা দূরদর্শন এবং আকাশবাণীতে এনাউন্সার ও সঞ্চালনার কাজ করেছি। গানের জগতে না এলে এই দুটোর মধ্যে কোন একটা কাজই করতাম।

পরিবারের সম্পর্কে দু-এক কথা বলো।

– বাবু আর মা’র কথা প্রথমেই বলি। ছোট থেকে ওদের উৎসাহ ছাড়া গান নিয়ে এগোনো সম্ভব হত না। বিশেষ করে বাবুর উৎসাহ ছিল সবথেকে বেশী। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমি বাবুর সাথে যেতাম। ওনাকে প্রতি মুহূর্তে মিস করি। এখন হাজব্যান্ড আর মেয়ে রয়েছে পাশে। গানের ওরাও আমার জীবন।

তোমার এলবাম মনতারার গান দিয়ে আজকের আড্ডা শেষ করি।

– গান