অনন্তশ্রী প্রভুপাদ শ্রীজীব গোস্বামীর দিব্য জীবন (পর্ব-৩) :: রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
630

(ইনি বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামীবৃন্দের অন্যতম শ্রীজীব গোস্বামীপাদ নন্। ইনি হলেন শ্রীধাম নবদ্বীপের শ্রীবাস অঙ্গনের শ্রীনিমাই চাঁদ গোস্বামী প্রভুর পুত্র। সিদ্ধ তিনকড়ি গোস্বামী প্রভুর থেকে ভজনশিক্ষা করা একান্তভাবে রাধাদাস্যনিষ্ঠ সাধক। তাঁর দিব্য জীবনী স্মরণ করা হচ্ছে।)

শ্রীজীব গোস্বামী প্রভুর এমন এক অদ্ভুত দিব্য ভাবময় ব্যক্তিত্ব ছিল যে, তাঁর শ্রীমুখের কথা শ্রবণ করে অভক্তজনাদের হৃদয়ও বিগলিত হয়ে যেত ভক্তি-বাসনার উত্তাপে।

একবার নবদ্বীপের একজন ভদ্রলোক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আচ্ছা, প্রভু ! বলুন তো, এই যে সাধুরা বা আপনাদের মত মহাজনেরা সব সময় বলেন ভজন কর, ভজন কর—-তা, ভজন ব্যাপারটা আসলে কি ? একটু বুঝিয়ে দেবেন ?”

শ্রীজীব গোস্বামী বললেন, “হ্যাঁ, সে না হয় দেব । কিন্তু , তার আগে আপনি বলুন তো আপনি আমার কাছে মাঝে মধ্যেই যে আসেন– তার কারণ কি ? কেন আসেন ?”

ভদ্রলোক মুখে একগাল নির্মল হাসি বিস্তার করে বললেন, “আপনাকে ভাললাগে, ভালোবাসি। তাই আসি । আপনার কথা শুনতে আসি।”

শ্রীজীব প্রভু বললেন, “এইতো ! এই ভালোবাসাটাই হল গিয়ে ভজন। আসলে একজন অপরজনকে ভালবাসলে যেমন তার খুশির জন্য সে যা-যা ভালবাসে তাই করে, তেমন ভগবানকে ভালবেসে তাঁর প্রীতির জন্য যা-যা করা হয় সেটাই হল ভজন। ভালোবাসার মানুষটিকে প্রসন্ন করে আনন্দ পাই, তার মুখের হাসি দেখতে চাই আমরা। তেমন ভগবান ভালবাসেন নাম শ্রবণ করতে , আপনি যদি তাঁর নাম করতে করতে তাঁকে আকুলভাবে স্মরণ করেন, ভাবেন— তখন সেটাই আপনার ভজনের একটি অঙ্গ। আপনি নাম করতে করতে আপনার প্রিয়জন ভগবানের জন্য কাতর হয়ে তাঁর বিরহে কাঁদবেন যখন, জানবেন, তখন তিনিও আপনার ভালোবাসাকে অনুভব করে আপনার ভাবে ভাবিত হয়ে আবেগের আশ্রুতে ভাসছেন । এটাই তো ভালোবাসার টান! আপনার আকর্ষণে তিনি বাঁধা পড়বেন আর আপনি তাঁর টানে আরো নিবিড় ভাবে তাঁর ভজনে নিমজ্জিত হবেন। এখন প্রশ্ন হল নাম কার করবেন বা কোন নাম করবেন? নাম করবেন শ্রীকৃষ্ণের।”

ভদ্রলোক জিজ্ঞাসু নয়নে প্রশ্ন করলেন, “কেন, শ্রীকৃষ্ণের নামই কেন করবো ? ”

শ্রীজীব গোস্বামী—-“কারণ আমাদের নবদ্বীপের নায়ক নিমাই যে সেই আজ্ঞাই দিয়ে গিয়েছেন। শ্রীচৈতন্য ভাগবতে সে কথা রয়েছে। শোনেন তাহলে বলি কী কথা লেখা সেখানে —-

আপন গলার মালা সবাকারে দিয়া ।
আজ্ঞা করে প্রভু সবে কৃষ্ণ গাও গিয়া।।
বোল কৃষ্ণ, ভজ কৃষ্ণ, গাও কৃষ্ণ নাম ।
কৃষ্ণ বিনু কেহো কিছু না ভাবিহ আন।।
যদি আমা প্রতি স্নেহ থাকে সবাকার ।
তবে কৃষ্ণ ব্যতিরিক্ত না গাইবে আর।।
কি শয়নে, কি ভোজনে কিবা জাগরণে।
অহর্নিশি চিন্ত কৃষ্ণ বোলহ বদনে ।।

আর, মহাপ্রভু এ উপদেশ কাকে করেছেন? শুধু কী নবদ্বীপবাসীর জন্য করেছেন ? না , তা তো নয় । যাঁরাই কৃষ্ণকে ভালোবাসেন , প্রাণমন্দিরে বসিয়ে তাঁকে প্রেমপূজা করেন— তাঁদের সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন।”——- এসব কথা বলতে বলতেই শ্রীজীব প্রভুর দু-আঁখিতে অশ্রুর শ্রাবণধারা বর্ষণ হতে থাকলো। আবেগে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে উঠতে থাকলো। নয়নবারিতে তাঁর বক্ষ ভেসে যেতে থাকলো। আঁখি রক্তিম হয়ে উঠলো।

যে ভদ্রলোক জানতে চেয়েছিলেন ভজন কী , তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তিনিও অশ্রু বিসর্জন করতে থাকলেন নীরব থেকে।

কিছুক্ষণ পর সেই ব্যক্তি বললেন, “প্রভু, আমায় দীক্ষা দেবেন? আমি কথা দিচ্ছি মহাপ্রভুর আজ্ঞা পালন করব সারাজীবন।”

——–ক্রমশঃ

ভক্ত-কৃপাপ্রার্থিনী
নম্রানতা
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক